উখিংনু রাখাইন এবং একটি স্বপ্নের মৃত্যু
প্রকাশিত : ২২:১৯, ৩১ জুলাই ২০১৯
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পাহাড় চূড়ায় কবিতাটি বহুবার পড়েছি। সেই পাহাড়ের পায়ের কাছে থাকবে গহন অরণ্য আমি সেই অরণ্য পার হয়ে যাব, তারপর শুধু কঠিন রুক্ষ পাহাড়। উখিংনু সেই কঠিন রুক্ষ পাহাড় পার হয়ে চলে গেছে মেঘের ওপারে নীল আকাশে। এখন আর কেউ তাকে খুঁজে পাবে না ।
প্রিয় ঢাকার দুই নগর পিতা আপনারা কি পাহাড়ি মানুষের কান্নার শব্দ শুনতে পান ? কিংবা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ঢাকায় বসবাসরত সমতল ভূমির মানুষের হাহাকার । জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী বিভাগের মেধাবী ছাত্রী উখিংনুর মৃত্যুতে আপনাদের কি কোন শোক নেই । কোন সমবেদনা নেই । কোন ভাষা নেই তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি । আপনারা কি বধির নাকি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ? এটা আমার কথা নয় । এটা তাদের কথা যারা তাদের স্বজন হারিয়েছেন ।
মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে রাজধানীর বুকে । কোন পর্যাপ্ত প্রতিরোধ নেই ,ভ্রুক্ষেপ নেই কার্যকর ব্যবস্থা নেই । হাতপাতালে কোন শুন্য বেড নেই । ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে ।
এটা কোন ছেলেধরার গুজব নয় । এটা সত্যি । আপনাদের প্রতি ডেঙ্গু আক্রান্ত পরিবারের মানুষদের চরম ক্ষোভ, ঘৃণা ও অভিশাপ প্রতিনিয়ত বাড়ছে । আপনারা সম্পূর্ণ ব্যর্থ । কিন্তু পদত্যাগ করছেন না কেন ? আপনাদের পদত্যাগের দাবিতে রাজু ভাস্কর্যের সামনে মানববন্ধন হচ্ছে । আপনাদের কুশপুত্তলিকা দাহ করছে বিভিন্ন সংগঠন । আপনাদের ৪৮ ঘন্টার আল্টিমেটাম দিয়েছেন ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার জন্য । আপনারা কি নিতে পেরেছেন ? পারেননি । আপনাদের এই ব্যর্থতার দায় কি রাষ্ট্র নেবে ? নাকি জনগণ নেবে ? যাদের ভোটে আপনারা আজ নগর পিতা ।
সম্প্রতি ভারতে লোকসভা নির্বাচনে দলের বিশাল পরাজয়ের পর শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করলেন রাহুল গান্ধী।
যতই কংগ্রেসের নেতারা তাঁকে বারবার নিজের পদত্যাগপত্র ফিরিয়ে নিতে অনুরোধ করুন না কেন তাতে তিনি সাড়া দিতে অপরাগতা প্রকাশ করেছেন এবং নিজের সিদ্ধান্ত বদলানো সম্ভব নয় বলেও স্পষ্ট জানিয়ে দেন। ব্যর্থতার দায় কাঁধে নিয়ে পদত্যাগ করার সংস্কৃতি আমার দেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে এখনো চালু হয়নি ।
দুই মেয়রকে বলছি রাহুল গান্ধী আপনাদের জন্য উদাহরণ হতে পারে । আপনারা তার মত রাজনীতিবিদকে অনুসরণ করতে পারেন । জানি পারবেন না ।
আর কি বলার আছে আপনাদের ?
ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যকর ওষুধ ছিটাতে ঢাকার দুই সিটি মেয়রসহ স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারপরও তারা যদি দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয় তাহলে নগরবাসী মাঠে নামবে । নগরবাসীকে আর নতুন কোন প্রযুক্তির কথা বলবেন । লন্ডন থেকে ভদ্র মশা আমদানির কথা বলবেন । আপনারা নগরপিতা না হয়ে দুজন ভাল কৌতুক অভিনেতা হতে পারতেন । তাহলে আপনাদের দেখে মানুষজন বিনোদন নিত। অন্তত দু:খভারাক্রান্ত মানুষগুলো হেসে মনটাকে একটু হালকা করে নিত ।
মনে রাখবেন জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস । ইতিহাস বলে জনগণ একবার রুখে দাঁড়ালে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য ছিনিয়ে আনতে পারে । আমাদের মুক্তিযুদ্ধ তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত । বঙ্গবন্ধুর ডাকে বাংলার মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছিল বলেই আজ আমরা একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের আরেকজন মেধাবী শিক্ষার্থী ফিরোজের
কথাও কি আপনারা ভুলে গেলেন ? তাঁর পরিবার কি নিয়ে বাঁচবে আর কাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখবে । এখনো ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক শিক্ষার্থী ।
আদিবাসী রাখাইন জনগোষ্ঠীর সেই মেয়েটির পরিবারের স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল । সামনে ৯ আগস্ট বিশ্ব আদিবাসী দিবস । আদিবাসী মানুষের স্বপ্ন দেখার দিন । মায়ের ভাষায় কথা বলার দিন । অধিকার প্রতিষ্ঠার দিন । এই দিনটি বিশ্বের ৭০টি দেশের ৩৭ কোটি আদিবাসীদের বর্ণিল উৎসবের দিন ।
প্রতিবছরের ন্যায় এবারও রাখাইন জনগোষ্ঠীর সেই মেয়েটি হয়তো তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পড়ে শহিদ মিনারে আসতো তার প্রিয়জন, বন্ধুদের সাথে ভালবাসা ও শুভেচ্ছা বিনিময় করতে । কিন্তু এবার উখিংনুর আর আসা হলো না । রাখাইন জনগোষ্ঠীর সাংগ্রাই জলকেলি উৎসব হবে আবার । সে বন্ধুদের সাথে সেই উৎসবে মেতে উঠবে না আর । কখনো আর দেখা যাবে না উখিংনুকে বৌদ্ধ মন্দিরে । প্রীতিলতা হলের রুমমেটরা আর সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রতিদিনের মত তাকে দেখতে পাবে না ।
সে আর তার মায়ের ভাষায় তাঁর মাকে মা বলে ডাকবে না । সে আর তার মায়ের ভাষায় কবিতা লিখবে না ,গান গাইবে না । আর গল্প করবে না । বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীরা তাকে খুব মিস করবে । উখিংনু আর নেই এটা বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হবে তাদের ।
ক্লাসে তার সাথে আর কারো দেখা হবে না । কথা হবে না পাশাপাশি বসে । এই শুন্যতা সহপাঠীদের মনেও দাগ কাটবে । কেউ কেউ তার কথা মনে করে নিরবে নিভৃতে কাঁদবে । বন্ধুকে হারাবার কষ্ট প্রিয়জনকে হারাবার চেয়ে কম নয় ।
ওরা উখিংনুর স্মৃতি রোমন্থন করবে কোন এক নিস্তব্ধ সকালে কিংবা পাতাঝরা বিকেলে কিংবা বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যায় । তাঁর জন্য দীর্ঘশ্বাস বেড়ে যাবে । তার জন্য কেউ কেউ হয়তো বুকের ভেতর হঠাৎ ব্যথা অনুভব করবে । হোক সেটা ক্ষণিকের কিংবা অবারিত সময়ের জন্য । এই অবারিত সময়টির জন্য ব্যথা অনুভব করবে তার মা যে তাকে পরম আদর মমতায় কুলে পিঠে করে বড় করেছে । আর বাবা যে সব সময় তার ছোট্ট মেয়েটির আবদার মিটিয়েছে । চাওয়া পাওয়া যুগিয়েছে । একটি স্বপ্নের মৃত্যু হলো । দীর্ঘ আশাজাগানিয়ার সমাপ্তি হলো । আবার রাত শেষে ভোর হবে ।
পাহাড়ের বুকে লাল সূর্য উঁকি দিবে ।
শুধু উখিংনু সেই সূর্যের আলো স্পর্শ করতে পারবে না । সে চলে গেছে না ফেরার দেশে । মায়ের স্নেহের উঠোন ছেড়ে । তাঁর মাতৃভূমি প্রিয় বাংলাদেশ ছেড়ে ।
আদিবাসী মানুষের জীবনের গল্প রূপকথার মতো নয় । তাদের গল্প শোষণ ও বঞ্চনার আর লড়াই-সংগ্রামের ।
এই সংগ্রাম কখনো ভূমির জন্য । এই সংগ্রাম কখনো তাদের মায়ের ভাষায় পড়াশোনার সুযোগ পাওয়ার জন্য। আবার কখনো তাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য ।
আরকে/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।