উত্তরবঙ্গবাসীকে নতুন করে স্বপ্ন দেখাচ্ছে তিস্তা
প্রকাশিত : ২০:১৮, ২০ অক্টোবর ২০২০
রাকিবুজ্জামান আাহমেদ
বাংলা ‘তিস্তা’ শব্দটি এসেছে ‘ত্রি-স্রোতা’ শব্দ থেকে, যার অর্থ ‘তিন প্রবাহ’। নদীমাতৃক ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই বাংলাদেশের উত্তরের জনপদে বিস্তৃত হয়ে আছে তিস্তা নদী। এদেশের মানুষের জীবন আর নদী যেন ছুটে চলে সমস্রোতে। তাই নদীর সঙ্গে এত ভাব বাঙালির! কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগের বাংলাদেশে বাঙালির জীবনে দুর্ভোগও কম ডেকে আনেনি নদী। কখনো বন্যায় ভাসিয়েছে, কখনো খরায় শুকিয়ে জেলেদের করেছে বঞ্চিত- এই যেন বাংলাদেশের মানুষের জীবন। তিস্তাও তার ব্যতিক্রম নয়। আমরাও কেউ প্রকৃতির এই অনিবার্য নিয়মের বাইরে নই।
তিস্তার উৎপত্তি উত্তর সিকিমের হিমালয় পর্বতমালার ৫ হাজার ৩৩০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত সো লামো হ্রদে। এই হ্রদটি শেসচেনের কাছে ডোংখা গিরিপথের উত্তরে অবস্থিত। পশ্চিমবঙ্গে জলপাইগুড়ি থেকে রংপুর জেলা হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে তিস্তা। মিশেছে গিয়ে ব্রহ্মপুত্রে।
১৫০০ সালের পর থেকে বাংলার অনেক নদীর নদীখাতই ভৌগোলিক কারণে পরিবর্তিত হয়েছে। তিস্তা নদীর তাদের মধ্যে একটি। এই নদী আগে জলপাইগুড়ির দক্ষিণে তিনটি ধারায় প্রবাহিত হতো: পূর্বে করতোয়া, পশ্চিমে পুনর্ভবা ও মাঝখানে আত্রাই। এই তিনটি ধারার কারণেই ‘ত্রি-স্রোতা’ শব্দটি এসেছিল, যেটি কালক্রমে বিকৃত হয়ে দাঁড়ায় তিস্তা।
তিনটি ধারার মধ্যে পুনর্ভবা মহানন্দায় মিশতো। আত্রাই চলন বিলের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে করতোয়ায় মিশতো। আর আত্রাই-করতোয়ার যুগ্মধারাটি জাফরগঞ্জের কাছে মিশতো পদ্মায়। ১৭৮৭ খ্রিষ্টাব্দে এক অতিবৃষ্টি ব্যাপক বন্যার সৃষ্টি করেছিল দেশের উত্তরের জনপদে। সে সময় তিস্তা গতিপথ পরিবর্তন করে লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম এবং গাইবান্ধা জেলার মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হয়ে চিলমারী নদীবন্দরের দক্ষিণে ব্রহ্মপুত্র নদে পতিত হয়। তিস্তার মোট দৈর্ঘ্য ৩১৫ কিলোমিটার, যার মধ্যে ১১৫ কিলোমিটার বাংলাদেশ ভূখণ্ডে অবস্থিত।
তিস্তা নিয়ে এই কথাগুলো বলার কারণ- সম্প্রতি বাংলাদেশের জাতীয় পরিসরে তিস্তা ফের একটি আলোচিত বিষয় হয়ে উঠেছে। শুধু বাংলাদেশ অবশ্য নয়, প্রতিবেশী দেশগুলোতেও আলোচনা হচ্ছে তিস্তা নিয়ে। আর এই তিস্তার সম্ভাবনা ও সমস্যার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে আমাদের লালমনিরহাট জেলা। তিস্তা ব্যারেজটিও অবস্থিত জেলার হাতীবান্ধা উপজেলায়। তিস্তা রেলসেতুরও একটি অংশ পড়েছে লালমনিরহাট সদর উপজেলায়। এই জেলার একজন সন্তান হিসেবে হলেও তিস্তা নিয়ে কিছু লেখার দায়বদ্ধতা বোধ করেছি, যদিও বিষয়টি আঞ্চলিক নয়; জাতীয়।
সম্প্রতি তিস্তা নদীকে ঘিরে সরকার ‘তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন’ একটি প্রকল্প হাতে নিতে যাচ্ছে বলে গণমাধ্যমে নানামুখী আলোচনা হচ্ছে। এই প্রকল্পে সরকারকে সহায়তা করবে চীন। একে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি দূরদর্শী কূটনৈতিক সিদ্ধান্তই বলা যায়। অর্থনৈতিক কূটনীতির এই যুগে ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের প্রশ্নে কোনও দেশই অন্য দেশকে ছাড় দিতে চায় না। তবে নিজের অংশটা বুঝে নিতে হয় কূটনীতির সুদক্ষ লড়াইয়ে। তিস্তা নদী ঘিরে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে ভারতের সঙ্গে তিস্তা চুক্তির খুব একটা প্রয়োজন হবে না।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে লালমনিরহাট জেলাসহ উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে কাকিনার মহিপুরে তিস্তা নদীতে তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্প নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলেন। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে লালমনিরহাট জেলা তিস্তা ব্যারাজের সেচ প্রকল্পের আওতায় আসত। কিন্তু পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যার পর কাকিনায় সেই সেচ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়নি। তবে অপূর্ণ সেই স্বপ্ন এবার পূর্ণ করতে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা।
২০১৯ সালের জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেইজিং সফরের সময় রোহিঙ্গাদের বিষয়ে আলোচনার পাশাপাশি আরও কয়েকটি বিষয়ে চীনের সহায়তা চেয়েছিলেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: ডেল্টা প্ল্যান- ২১০০, ক্লাইমেট অ্যাডাপটেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠা এবং তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রজেক্ট। সেই সফরে চীন আশ্বাস জানিয়েছিল, তারা জলবায়ু অভিযোজন বিষয়ক কেন্দ্র এবং তিস্তা প্রকল্পে বাংলাদেশকে অর্থায়ন করবে।
আপনারা অনেকেই হয়তো জানেন, এক সময় হোয়াংহো নদীকে বলা হতো ‘চীনের দুঃখ’। প্রতিবছর হোয়াংহোর পানি ভাসিয়ে দিতো দেশটির শত শত মাইল জনপদ। ভেঙে নিয়ে যেত বহু গ্রাম-পথ-ঘাট জনপদ। কিন্তু সেই দুঃখ সফলতার সঙ্গে ঘোচাতে পেরেছে চীন। হোয়াংহোতে যথাযথ নদীশাসনের ফলে তার তীরবর্তী মানুষের দুঃখই শুধু ঘোচেনি; চীনের কৃষকদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে নদীটি।
বাংলাদেশের তিস্তাও অনেকটা হোয়াংহোর মতো। চীনের সহায়তা নিয়ে বাংলাদেশের এই হোয়াংহোকে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে কোটি মানুষের দুঃখ ঘোচানোর পরিকল্পনা নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই মুজিব বর্ষে তিস্তা নদী ঘিরে উত্তরাঞ্চলের মানুষকে এক মহাপরিকল্পনা উপহার দিতে চলেছেন তিনি।
প্রায় আট হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে। প্রকল্পের আওতায় তিস্তা নদীর দুই পাড়ে ২২০ কিলোমিটার গাইড বাঁধ নির্মাণ করা হবে। বাঁধের দুই পাশে থাকবে সমুদ্রসৈকতের মতো মেরিন ড্রাইভ, যেখানে পর্যটকরা লং ড্রাইভে যেতে পারবেন। নদী তীরের দুই ধারে গড়ে তোলা হবে হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট ও পর্যটন নগরী। গড়ে তোলা হবে রংপুর ও লালমনিরহাট টাউন নামের আধুনিক পরিকল্পিত শহর। সমাধান হবে বন্যা সমস্যার।
তিস্তা এখন লালমনিরহাটের মানুষের জন্য এক স্বপ্নের নাম। তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে তিস্তা পাড় হয়ে উঠবে সুইজারল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরের মতো সুন্দর নগরী, যেখানে থাকবে দেড়শ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র। গড়ে উঠবে আধুনিক সেচ সেবা ও আধুনিক যন্ত্রপাতিসমৃদ্ধ কৃষি খামার। চালু করা হবে নৌপথ।
এছাড়া এই প্রকল্পের আওতায় বালু সরিয়ে কৃষি জমি উদ্ধার ও ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার সম্পদ রক্ষা এবং প্রতি বছরে ২০ হাজার কোটি টাকার ফসল উৎপাদন, তিস্তার তীরে নৌবন্দর, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নদীর দুইপাড়ে থানা, কোস্টগার্ড এবং সেনাবাহিনীর জন্য ক্যাম্পের ব্যবস্থা রাখার প্রস্তাবও রাখা হয়েছে। চলতি বছরেরই নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে চীনের সঙ্গে চুক্তি এবং টেন্ডার প্রক্রিয়া শুরু করবে সরকার। পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরে তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রকল্পটি হবে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রকল্প।
প্রকল্প বাস্তাবায়িত হলে নিঃসন্দেহে তার উপকারভোগী হবে লালমনিরহাট জেলা ও জেলার প্রতিটি মানুষ। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল হলেও ঐতিহ্যবাহী এই জেলা বর্তমান সরকারের গত এক দশকের বেশি সময়ে উন্নয়নের নানা সুফল ভোগ করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০ বছরের ঐকান্তিক চেষ্টায় নানা সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে তিস্তা পাড়ের মানুষকে নিয়ে আসেন। চরের বাড়িঘর বন্যামুক্ত করতে ভিটা উঁচু করে দেয়া হয়। বাড়িতে বাড়িতে খামার করতে সরকার কর্মসূচী হাতে নেয়। কৃষকদের দেয়া হয়েছে বিনামূল্যে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি, এবং চাষাবাদের জ্ঞান। প্রায় প্রতিটি চরে জনসংখ্যার অনুপাতে প্রাথমিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে গত দশ বছরে। চরবাসীর স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে ৬ হাজার জনবসতির জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিক। এসব নানা উদ্যোগে এখন তিস্তা পাড়ের মানুষ মঙ্গা মুক্ত হয়েছে। এখন আর মৌসুমী মঙ্গা নেই।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় এবং আমার শ্রদ্ধেয় পিতা মাননীয় সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের তত্ত্বাবধায়নে লালমনিরহাটে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয় (প্রস্তাবিত)। এটি হবে আকাশ বিজ্ঞান প্রকৌশল সম্পর্কিত বাংলাদেশের প্রথম উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বর্তমান সরকার ২০১৯ সালের ১৩ মার্চ পুনরায় লালমনিরহাট বিমান বন্দরটি চালুর পরিকল্পনা করে।
এছাড়া লালমনিরহাটের তিনবিঘা করিডোর সমস্যার সমাধানও করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১১ সালের আগে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতায় কোন হাসপাতাল ছিল না। ২০১১ সালের ১৯ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী দহগ্রামে একটি দশ শয্যার হাসপাতাল ও দহগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের উদ্বোধন করেন।
তাই, আপনারা আস্থা রাখুন- আল্লাহর রহমতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আপনাদের তিস্তা সমস্যারও সমাধান করে দেবেন। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে লালমনিরহাট তথা উত্তরাঞ্চলের মানুষ তো বটেই সারাদেশের মানুষই উপকৃত হবেন। সমৃদ্ধ হবে জাতীয় অর্থনীতি।
লেখক: প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি করিম উদ্দিন পাবলিক কলেজ, কালীগঞ্জ, লালমনিরহাট।
এসি
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।