উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ছিল গৌরবের
প্রকাশিত : ১২:৪১, ২৪ জানুয়ারি ২০১৯
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরপরই বাঙালিরা বুঝেছিল পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালিদের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে দেবে না। ষড়যন্ত্র করে, হামলা-মামলা দিয়ে বাঙালির অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে তারা দমিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিল। ভাষার জন্য সংগ্রাম, গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম, শিক্ষার জন্য সংগ্রাম, বৈষম্য অবসানের জন্য সংগ্রামের পথেই এসেছিল ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান। স্বাধীনতা আন্দোলনের সুদীর্ঘ পথপরিক্রমায় উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান একটি মাইলফলক। এই অভ্যুত্থান হলো শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে, স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে, বিদেশি প্রভুত্বের বিরুদ্ধে, সব ধরনের অনাচার, অন্যায় আর লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে একযোগে সর্বস্তরের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহ। যার ফলে পতন ঘটে আইয়ুব খানের। স্বৈরশাসনের নাগপাশ থেকে শোষিত-বঞ্চিত দেশকে মুক্ত করতে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান যে ভূমিকা রেখেছিল, জাতির জীবনে তা অবিস্মরণীয়। ১৯৬৬ সালে পাকিস্তানের শাসন, শোষণ ও বঞ্চনা থেকে বাঙালি জাতিকে মুক্ত করতে ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু। এতে স্বাধিকার আন্দোলনের গতি তীব্র হলে পাকিস্তানি শাসকরা একে নস্যাৎ করতে ছয় দফাকে পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যা দিয়ে শেখ মুজিবকে বন্দি করে এবং ছয় দফার আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার ও নির্যাতন শুরু করে। ১৯৬৮ সালে শেখ মুজিবকে প্রধান আসামি ও সামরিক-বেসামরিক অন্য ৩৪ জনকে আসামি করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করে আইয়ুব সরকার। ফলে ছয় দফার পক্ষে এবং শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন চাঙ্গা হয়ে ওঠে। দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে শহর এবং গ্রামের শ্রমিক-কৃষক ও নিম্ন আয়ের পেশাজীবীসহ বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষের মধ্যে। আইয়ুব খানের পদত্যাগের দাবি তুলে পাকিস্তানের সব অংশের মানুষ একযোগে পথে নামে।
১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে দেশের ছাত্রসমাজ আইয়ুবের স্বৈরশাসন উৎখাতের জন্য আন্দোলনকে দিন দিনই বেগবান ও বিস্তৃত করেছিল। ডাকসুর তৎকালীন ভিপি তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে ছাত্রসমাজ জোটবদ্ধভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল। ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রনেতারা ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে এবং তাদের ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে। ১১ দফার মধ্যে ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কিত ছয় দফার সঙ্গে ছাত্র সমস্যাকেন্দ্রিক দাবিদাওয়ার পাশাপাশি কৃষক ও শ্রমিকদের স্বার্থসংক্রান্ত দাবিগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বস্তুত ১১ দফা কর্মসূচির মাধ্যমে ছাত্রনেতারা যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, তা ছিল অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং এ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করেই গুরুত্বপূর্ণ বিরোধী দলগুলোর মধ্যে একটি আন্দোলনগত ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময় থেকেই শেখ মুজিবের মুক্তি ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের বিষয়টি প্রাধান্য পেতে শুরু করে। ১৭ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় অনুষ্ঠিত সমাবেশে ছাত্ররা দেশব্যাপী সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ডাক দেয় এবং পুলিশ ও ইপিআর বাহিনী কর্তৃক ছাত্র-জনতার ওপর বর্বর নির্যাতন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্রতা লঙ্ঘনের প্রতিবাদে ২০ জানুয়ারি প্রদেশব্যাপী পূর্ণ হরতাল পালনের আহ্বান জানায়। এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ছাত্র-জনতার সক্রিয় সহযোগিতায় সেদিন পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। সেদিন ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা ছিল। ওই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা আসাদ পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। আসাদের মৃত্যু সংবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে শহরে নেমে এসেছিল শোকের ছায়া। আসাদের জীবনাহুতির মধ্য দিয়ে অধিকারহারা জনতার মুমূর্ষু অন্তর যেন মৃত্যুঞ্জয়ী শক্তির বিজলি স্পর্শে জেগে উঠেছিল। অপ্রত্যাশিত এই মর্মান্তিক সংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন স্থান থেকে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা মেডিক্যাল কলেজের দিকে ছুটে আসেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণে উত্তোলন করা হয় একটি কালো পতাকা। স্বতঃস্ফূর্তভাবে বের হয় বিরাট শোক মিছিল। পরের দিন ২১ জানুয়ারি হরতাল পালিত হয় এবং পল্টন ময়দানে গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে লক্ষাধিক লোক নগ্নপদে মৌন মিছিল বের করে রাজপথ প্রদক্ষিণ করে। আসাদের মৃত্যুতে ডাকসু ভিপি ও সংগ্রাম পরিষদের মুখপাত্র হিসেবে তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন তোফায়েল ভাই। ২২ জানুয়ারি কালো ব্যাজ ধারণ, কালো পতাকা উত্তোলন। ২৩ তারিখ মশাল মিছিল আর ২৪ তারিখ ২টা পর্যন্ত হরতাল। কর্মসূচির শেষ দিনটি একটি স্বতঃস্ফূর্ত গণ-অভ্যুত্থানে রূপান্তরিত হয়।
২৪ তারিখের হরতালে সকাল থেকে ছাত্র-জনতা নেমে আসে ঢাকায়। বিক্ষোভে উত্তাল রাজপথ। সচিবালয়ের পাশে আবদুল গণি রোডে মন্ত্রীর বাড়িতে আক্রমণ, পুলিশের গুলিতে নবকুমার ইনস্টিটিউটের দশম শ্রেণির ছাত্র মতিউর এবং আলমগীর মনসুর, রুস্তম আলী ও জানু মিঞা নিহত হলে পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ঢাকার সব মানুষ যেন বিক্ষোভে নেমে আসে রাজপথে। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলল ঢাকায়। দৈনিক পাকিস্তান, মর্নিং নিউজ অফিসে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। এমএনএ লস্করের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। বিচারপতি এস এ রহমানের বাড়িতে আক্রমণ হলে তিনি লুঙ্গি পরে পালান।
আমি তখন ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র। ঢাকার এই আন্দোলনের দাবানল সেখানেও পৌঁছে গিয়েছিল। আমি অন্যান্য ছাত্রনেতার সঙ্গে সেই আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলাম। উনসত্তরের গণ-আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। সামনে থেকে সেনাপতির ভূমিকা পালন করেছেন আজকের তুখোড় পার্লামেন্টারিয়ান তোফায়েল আহমেদ ভাই। তা ছাড়া নাজিম কামরান চৌধুরী, সিরাজুল আলম খান, শামসুদ্দোহা, সাইফুদ্দীন আহমেদ মানিক, মোস্তাফা জামাল হায়দার, খালেদ মোহাম্মদ আলী, আবদুর রউফ, মাহবুব উল্লাহ, মাহবুবুল হক দোলন, নূরে আলম সিদ্দিকী, আবদুল কুদ্দুস মাখন, আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, রাশেদ খান মেনন, মতিয়া চৌধুরীসহ অন্যান্য ছাত্রনেতার (কারো নাম বাদ পড়লে তা অনিচ্ছাকৃত) ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। ওই দিন পল্টনে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। মানুষ, মানুষ আর মানুষ। বিকেল ৩টার পর পাকিস্তানি শাসকরা জারি করে সান্ধ্য আইন। মানুষ তা অমান্য করে বানের স্রোতের মতো নেমে আসে রাজপথে। ঘটে যায় গণ-অভ্যুত্থান। এবং সেই অভ্যুত্থানের ব্যাপকতা এতই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে স্বৈরাচারী সরকার একুশে ফেব্রুয়ারি সাজানো আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নেয়। এবং তারই ধারাবাহিকতায় ২২ ফেব্রুয়ারি গণদাবির জোয়ারে এই মামলার প্রধান আসামি দীর্ঘ ৩৩ মাস কারাগারে আটক প্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য আসামিকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় আইয়ুব সরকার। শুধু তা-ই নয়, গণ-অভ্যুত্থানের জোয়ারের মুখে টিকতে না পেরে শেষাবধি ২৫ মার্চ পাকিস্তানের ‘লৌহমানব’ হিসেবে খ্যাত প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের ফল ছিল সুদূরপ্রসারী। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পূর্ববাংলার জনগণের মধ্যে আলাদা রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি পায়। বাঙালি শুধু নিজেদের স্বাধিকার আন্দোলনের মধ্যে থেমে না থেকে ক্রমান্বয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং পাকিস্তানি শাসকদের হটিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে প্রতিষ্ঠা করে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।
লেখক: সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।