ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪

উপকূলীয় অঞ্চলে দিনবদলের হাতিয়ার কাঁকড়া চাষ

প্রকাশিত : ১৫:২৭, ৩ নভেম্বর ২০১৭ | আপডেট: ১২:৩১, ৯ নভেম্বর ২০১৭

দেশে চাহিদা না থাকলেও বিশ্বের অনেক দেশে কাঁকরা সুস্বাদু ও পুষ্টিকর খাবার হিসেবে সমাদৃত।কাঁকড়া রফতানি করে একদিকে দেশ পাচ্ছে মোটা অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা, অপরদিকে উপকূলীয় অঞ্চলের দরিদ্র মানুষের বিকল্প আয়ের উৎস হচ্ছে এই কাঁকড়া।

দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় সেখানকার কৃষি উৎপাদন এখন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এর ফলে স্থানীয়দের বিকল্প আয়ের উৎস খুঁজতে হচ্ছে। আয়ের বিকল্প উৎস হিসেবে তাই ক্রমেই বাড়ছে কাঁকড়ার চাষ। এতে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ একদিকে যেমন অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হচ্ছেন অন্যদিকে তেমনি বেকারত্বের হারও কমছে উল্লেখযোগ্য হারে।

ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের তথ্য মতে, বতর্মানে দেশের দক্ষিণাঞ্চল থেকেই কাঁকড়া রফতানির মাধ্যমে বছরে ৬০ থেকে ৮০ কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা আসছে। সারা দেশ থেকে এ রফতানি আয়ের পরিমান বছরে প্রায় ১৭০ কোটি টাকা।

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে উপকূলীয় অঞ্চলে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে কাঁকড়ার চাষ। কাঁকড়া চাষের সুবিধা হচ্ছে, এতে পরিশ্রম কম। কাঁকড়া চাষের উৎপাদন ব্যয় কম, পাশাপাশি কাঁকড়ার বংশবৃদ্ধিও ঘটে দ্রুত। বিভিন্ন এনজিও’র মাধ্যমে পিকেএসএফ’র সহযোগিতায় উপকূলীয় এলাকায় কাঁকড়া চাষ করে অনেকেই এর সুফল পাচ্ছেন।

যেভাবে কাঁকড়া চাষ হয়

কাঁকড়ার উৎস : দেশে দুই ধরনের (লোনাপানি ও মিঠাপানি) কাঁকড়া পাওয়া যায়। মিঠাপানির কাঁকড়া তুলনামূলক কম পাওয়া যায়। তবে লোনাপানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ যত বেশি থাকবে, কাঁকড়ার উৎপাদনও বেশি হবে। দক্ষিণাঞ্চলের সাতক্ষীরা, খুলনার নদী-নালা, খাল-বিল, বিস্তৃত চিংড়িঘের ও সুন্দরবনের গোটা বনাঞ্চলে লোনাপানিতে এ কাঁকড়া পাওয়া যায়। লোনাপানির কাঁকড়ার গড় আয়ু এক থেকে দেড় বছর।

যেভাবে ধরা হয় : সুন্দরবন অঞ্চলের জেলেরা দোন দিয়ে (স্থানীয় ভাষায়) পানি থেকে কাঁকড়া ধরেন। দিনে একজন জেলে দোন দিয়ে ২০ থেকে ৩০ কেজি কাঁকড়া ধরে থাকেন। আবার চিংড়িঘেরের গই (পানি বের হওয়ার পথ বা ছোট ছিদ্র) মুখে জাল পেতে চিংড়ি ধরার সময় ঘেরে থাকা কাঁকড়া ধরা পড়ে।

প্রজনন : এসব কাঁকড়া ধরে চিংড়িঘেরে পৃথক পৃথক চৌবাচ্চায় রাখা হয়। আবার চিংড়িঘেরেও কিছু কাঁকড়া পাওয়া যায়। যেগুলোর মধ্যে বড় হওয়া কাঁকড়ার ৯০ শতাংশই ধরা পড়ে। প্রাকৃতিকভাবে বড় হওয়া কাঁকড়ার ২০ থেকে ২৫ শতাংশ আহরণ করা সম্ভব হয়। আবার প্রজননের সময় উপকূলীয় অঞ্চল ও সুন্দরবনের বিস্তৃত এলাকার জলাশয় ও তীরে প্রচুর কাঁকড়ার পোনা পাওয়া যায়।

চাষ : পুকুরে ছোট ছোট চৌবাচ্চা রেখে মোটাতাজা করা হয় কাঁকড়া। বড় বড় ঘেরে চিংড়ির সঙ্গে কাঁকড়ার পোনা ছেড়ে বড় করা হয়। আবার উন্মুক্ত জলাশয়ে খাঁচায় আটকে রেখেও চাষ করা হচ্ছে কাঁকড়া। এর মধ্যে খোলস ছাড়ানো কাঁকড়াগুলো চিংড়িঘেরে আলাদা চৌবাচ্চায় রাখা হয়। সেখানে কাঁকড়ার খাবার হিসেবে ছোট ছোট মাছ দেওয়া হয়।  

এভাবে খোলস ছাড়ানো কাঁকড়া রাখলে মাত্র ১৫/১৬ দিনের মধ্যেই এসব কাঁকড়ার ওজন দ্বিগুণ হয়। এ ধরনের কাঁকড়ার দামও দ্বিগুণ। প্রতিটি কাঁকড়া এক থেকে দুই কেজি বা তিন কেজি ওজনের হতে পারে। যা স্থানীয় বাজারে ১ হাজার থেকে ১২শ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়।

আহরণ :  সাতক্ষীরা উন্নয়ন সংস্থার (সাস) এর তথ্য মতে, দক্ষিণাঞ্চলে প্রায় দেড় লাখ জেলে প্রাকৃতিক উৎস থেকে কাঁকড়া ধরে জীবন যাপন করছেন। শুধু সুন্দরবন এলাকায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার জেলে কাঁকড়া ধরে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

সাতক্ষরার তালা উপজেলার কাঁকড়া চাষি সাইফুল ইসলাম ইটিভিকে অনলাইনকে জানান, প্রতি বছর ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি এবং জুন থেকে জুলাই হচ্ছে কাঁকড়ার প্রজননকাল। এ সময় গভীর সমুদ্রে ও সুন্দরবনের মধ্যে ডিম থেকে কাঁকড়া জন্ম নেয়। এসব পোনা পানিতে ভেসে এসে নদ-নদী, খাল ও মাছের ঘেরে আশ্রয় নিয়ে বড় হয়। প্রজননের সময় উপকূলীয় অঞ্চল ও সুন্দরবনের বিস্তৃত এলাকার জলাশয় ও তীরে প্রচুর কাঁকড়ার পোনা পাওয়া যায়।

দক্ষিণাঞ্চলে কাঁকড়া চাষ ও মোটাতাজাকরণস প্রক্রিয়া সম্প্রসারণে পল্লীকর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিসেএসএফ) সহযোগিতায় দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে সাতক্ষীরা উন্নয়ন সংস্থা (সাস) ও উন্নয়ন প্রচেষ্টা। এসব সংস্থা চাষিদের সহযোগিতার পাশাপাশি সার্বক্ষণিক তৎবধায়নে রাখেন ঘেরসহ চৌবাচ্চাগুলো।

এ বিষয়ে উন্নয়ন প্রচেষ্টার সহকারি ভ্যালোচেইন ফ্যাসালেটর প্রজেক্ট ম্যানেজার সোহরাব হোসেন ইটিভি অনলাইনকে বলেন, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ফসলি জমিতে লবণাক্ততা বাড়ছে। লবণাক্ত পানিতে কাঁকড়া চাষ করে এ সংকট অনেকাংশে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। মাত্র এক বিঘার কাঁকড়ার ঘেরে বছরে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা লাভ করা যায়। দুই থেকে আড়াই মাস বয়সের কাঁকড়া ঘেরে ছাড়ার পর ২০ থেকে ২৫ দিনেই তা বিক্রির উপযোগী হয়। ঘেরে চিংড়ি চাষের সঙ্গে কাঁকড়াও চাষ হবে।

তিনি বলেন, এক শতাংশ জমিতেও পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা বিনিয়োগ করে বছরে গড়ে ৩০০ কেজি কাঁকড়া উত্পাদন করা সম্ভব। এর মূল্য প্রায় এক থেকে দেড় লাখ টাকা। বিদেশে বাংলাদেশের কাঁকড়ার খুব চাহিদা রয়েছে; বিশেষ করে চীন, তাইওয়ান, হংকং, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডে।

বাড়ছে রপ্তানি-আয় : বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ সূত্রে জানা যায়, ১৯৭৭ সালে প্রথম কাঁকড়া রফতানি শুরু হয়। সে সময় রফতানি বাজার ছিল ২ হাজার ডলারের। যা ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এসে দাঁড়ায় প্রায় ২ কোটি ৪০ লাখ ডলারে। পরিমানের দিক দিয়ে গত বছর প্রায় ৬ হাজার টন কাঁকড়া রফতানি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি রফতানি হয় চীনে। তাছাড়া মালয়েশিয়া, জাপান, হংকং, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে রপ্তানি হচ্ছে কাঁকড়া।

বাংলাদেশ কাঁকড়া রপ্তানিকারক সমিতি (খুলনা, পাইকগাছা) সূত্রে জানা যায়, ১৯৭৭-৭৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে অপ্রচলিত পণ্য হিসেবে শুধু খুলনা থেকে ২৩ হাজার টাকা মূল্যের কাঁকড়া বিদেশে প্রথম রফতানি করা হয়। গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১৭০ কোটি টাকার কাঁকড়া রফতানি করা হয়েছে।

ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সচিব আবুল বাসার ইটিভি অনলাইনকে বলেন, প্রথমে আমাদের দেশ থেকে প্রাকৃতিকভাবে যে কাঁকড়া পাওয়া যেত সেগুলোই রফতানি হতো। এখন এটা বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে। প্রথমে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাটে চাষ হলেও এখন কক্সবাজারেও এর চাষ হচ্ছে। বিশ্বে আমাদের দেশের কাঁকড়ার চাহিদা বেশি। নতুন করে কিছু দেশ কাঁকড়া কেনার আগ্রহ দেখিয়েছে। বর্তমানে ১৮টি দেশে এই কাঁকড়া রফতানি হচ্ছে বলে জানান তিনি।

আর/ডব্লিউএন


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি