ঢাকা, শুক্রবার   ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪

ঊনসত্তরের শহিদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা

অধ্যাপক আ ব ম ফারুক

প্রকাশিত : ১৫:১২, ২১ জানুয়ারি ২০২৩

২০ জানুয়ারি ছিল শহিদ আসাদ দিবস। ১৯৬৯ সালের এই দিনে পাকিস্তানের কুখ্যাত স্বৈরাচার আইয়ুব খানের কুশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত ছাত্র-গণমিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণে আসাদ (পুরো নাম আমানউল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান) শহিদ হন। তিনি ছিলেন ঊনসত্তরের তীব্র গণ-আন্দোলনে পথিকৃত শহিদ। এই আন্দোলনে অগণিত শহিদদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত অন্য দুজন হলেন শহিদ রুস্তম ও শহিদ মতিউর। 

১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ৬-দফা দাবিনামা পেশের পর থেকে বাঙালি এর স্বপক্ষে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। এই আন্দোলনে ৬-দফাকে সমর্থন করে তার সাথে গণমুখী শিক্ষার দাবি একত্রিত করে দেওয়া ছাত্রদের ১১-দফা দাবি পেশ এই আন্দোলনকে সুতীব্র করে। এই আন্দোলন-হরতালের সাথে আইয়ুব খানের ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ দায়ের ও কথিত এই মামলায় ‘প্রধান আসামী’ শেখ মুজিবসহ (তিনি তখনও ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি লাভ করেননি) মোট ৩৫ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে ছাত্র নেতৃবৃন্দ ৬-দফা ও ১১-দফার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে ১৯৬৯ সালের ৪ঠা জানুয়ারি। দেশের সর্বত্র এই প্রতিবাদ-আন্দোলন আরো বেগবান হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভা থেকে ছাত্র-নেতৃবৃন্দ কর্তৃক ১৭ই জানুয়ারি দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ডাকে । এর বিরুদ্ধে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের কুখ্যাত গভর্নর মোনায়েম খান দেশব্যাপী ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ২০শে জানুয়ারি দুপুরে এক ছাত্র-গণমিছিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের পাশে চাঁন খাঁর পুলে সমবেত হলে পুলিশের গুলিতে আসাদ শহীদ হন। এর প্রতিবাদে লাখো ছাত্র-জনতা কান্না ও ক্ষোভে  পুনরায় আসাদের রক্তমাখা শার্ট পতাকার মতো নিয়ে সমবেত হয়ে মিছিল নিয়ে শহিদ মিনারে আসে। সেখানে ছাত্র নেতৃবৃন্দ ২২, ২৩ ও ২৪শে জানুয়ারি শহিদ আসাদের স্মরণে সারা দেশে ধর্মঘট ও গণ-বিক্ষোভের ডাক দেয় এবং দেশবাসী তা শ্রদ্ধার সাথে পালন করে। এর শেষ দিনে অর্থাৎ ২৪শে জানুয়ারি পুলিশ আবার ক্ষোভে উত্তাল ছাত্র-জনতার উপর গুলিবর্ষণ করে এবং ঢাকার মালিবাগ মোড়ে মতিউর রহমান শহিদ হন। 

ঊনসত্তরে সারা দেশব্যাপী এই গণ-আন্দোলনের ফলস্বরূপ বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন আরো বেগবান হয়, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা তুলে নিতে সরকার বাধ্য হয়, বাংলার অবিসংবাদিত জননেতা শেখ মুজিব ষড়যন্ত্রমূলক মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে আসেন এবং স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকারের পতন হয়।

শহিদ আসাদ, শহিদ মতিউর ও ঊনসত্তরের আরো অগণিত নাম না জানা শহিদদের আত্মদান দেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের জন্য প্রবল শোক ও সেই সাথে প্রবল অনুপ্রেরণার উৎস। এই ঐতিহাসিক গণ-আন্দোলন পাকিস্তানের অমানবিক শোষণের প্রতি বাঙালির তীব্র ঘৃণা ও প্রতিবাদের প্রতীক এবং অধিকার আদায়ের আন্দোলনের প্রেরণা হয়ে বেঁচে থাকবে।

আসাদের আত্মদানের খবরে সমগ্র দেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বিক্ষুব্ধ জনতা সর্বত্র আইয়ুবের ছবি অপসারণ করে, ঢাকার আইয়ুব গেটের নামফলক ভেঙ্গে নতুন নামকরণ করে ‘আসাদ গেট’, আইয়ুব রোডের নাম রাখে ‘আসাদ রোড’ এবং আইয়ুব পার্কের নাম রাখে ‘আসাদ পার্ক’।

এই গণ-আন্দোলন ও আত্মত্যাগের স্মরণে আমাদের কবি-সাহিত্যিকরাও অনেক প্রবন্ধ-কবিতা-গল্প লিখেছেন। কয়েকটি বিখ্যাত কবিতা হলো কবি শামসুর রাহমানের ‘আসাদের শার্ট’, কবি হেলাল হাফিজের ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ এবং তখনকার পাকিস্তানি সৈন্য আর পুলিশ বোঝাই  অসংখ্য ট্রাক নিয়ে কবি আল মাহমুদের নিম্নরূপ কবিতাটি -

‘ট্রাক ট্রাক ট্রাক
শুয়োরমুখো ট্রাক আসছে 
দুয়োর বেঁধে রাখ।
বাঁধবো কেন দুয়ার ওগো
তুলবো কেন খিল।
আসাদ গেছে মিছিল নিয়ে
আসবে সে মিছিল।

ট্রাক ট্রাক ট্রাক 
ট্রাকের বুকে আগুন দিতে
মতিউরকে ডাক।

কোথায় পাবো মতিউরকে
ঘুমিয়ে আছে সে।
তোরাই তবে সোনা মাণিক
আগুন জ্বেলে দে।’

বঙ্গবন্ধু পরিষদের পক্ষ থেকে শহিদ আসাদ ও শহিদ মতিউরসহ ঊনসত্তরের সব বীর শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা ও তাঁদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।

জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু।
এসএ/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি