এক কাপ চায়ে ..
প্রকাশিত : ১৯:৪০, ২৯ ডিসেম্বর ২০২২ | আপডেট: ১৯:৫৬, ২৯ ডিসেম্বর ২০২২
ছোটবেলায় রংপুরের বাসায় সাহায্যকারি মেয়ে রাশেদার খুব শখ চা বানানো শেখার। শিখলো। প্রথমেই বাজিমাত। প্রথমদিনেই খুবই ভালো চা বানালো সে। দুধ, চিনি, চাপাতা সব ঠিকঠাক। ঘন কড়া চা। খেয়ে সবাই মুগ্ধ। একটু পর পর শুরু হলো হাঁকডাক রাশেদা চা বানাও। রাশেদা চা খাবো। লাফাতে লাফাতে চা বানাতে যায় ও। খুবই খুশী সে। সবাই তার কাছে চা চায়।
পরদিন সকাল থেকে বাসায় গেস্ট। আব্বার ছাত্র- ছাত্রীরা আসে। রাশেদা চা বানাও। পাশের বাসার আন্টি আসে, রাশেদা ৫ কাপ চা। আপুর বান্ধবী আসে রাশেদা ৩ কাপ চা নিয়ে আয়। দুপুর বেলা ছাত্রী আর ছাত্রীর মা আসে রাশেদা ২ কাপ চা চিনি কম। বিকেলবেলা একের পর এক আসে নানাধরনের অতিথি। আর চায়ের নানা রকম আব্দার। রাশেদা রান্না ঘরে যায়, কাপ ধোয় চা বানায়। দৌড়ে দৌড়ে ট্রেতে করে চা আনে। কারো পছন্দ লিকার, কারো কড়া দুধ চা। কেউ চিনি ছাড়া, কেউ চিনি কম; কেউ চিনি বেশি।
আমরা সোফায় আয়েশ করে চা খাই। মাঠে ঘুরতে ঘুরতে চা খাই। বাসায় গেস্ট আসলে আগে চা বানাতে হতো আমাদের। এখন রাশেদা বানায়। বই পড়ি আর চায়ে চুমুক দেই। রাতে রান্না ঘরে গজগজ আওয়াজ। শুনি ও বকবক করছে কেন যে চা বানানো শিখতে চাইলাম! মানুষ এতো চা’ও খায়। এরা কোনো খাওয়ার জিনিস পায়না। সারাদিন খালি রাশেদা চা আর চা। বাপরে বাপ। আগে জানলে শিখি নাকি এই কাজ! আমাদের চোখ ছানাবড়া।
চা। বাঙালির প্রিয় এক পানীয়। রাগে চা, দু:খে চা, মন ভালোতে চা। আড্ডায় চা, কুটনামিতে চা, মাথা গরমে চা। বৃষ্টি কিংবা শীতে চা। কাজে চা, ফাঁকিতে চা। ঘুমে চা, ঘুম না আসায় চা। কেনা চা, বাকীতে চা। কিসে চা নাই?
চায়ের কাপে চুমুকে বাঙালি। ধারণা ছিলো এতো এতো চা!! আসে কোথা থেকে। ভাবতাম গাছের ডাল পুঁতে দিলেই চা গাছ হয়। শ্রীমঙ্গলে যেয়ে প্রথম জানলাম পাতা থেকে হয় চা গাছ। এই বিষয়টা জানতে লাগলো এতো বছর।
যত ধরনের চা আছে সবই তৈরি হয় ক্যামেলিয়া সিনেসিস থেকে। এই চির-হরিৎ গুল্ম বা ছোট গাছ থেকে পাতা এবং পাতার কুঁড়ি সংগ্রহ করে তা চা উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন ধরনের চায়ের পার্থক্য হয় উদ্ভিদের চাষের ধরণ, পরিস্থিতি এবং উৎপাদন প্রক্রিয়াতে। চা এর প্রাকৃতিক আকার হয় ৯-১৫ মিটার উঁচু। চা উৎপাদনের জন্য নির্দিষ্ট সময় পর পর গাছ কাটা হয় যার কারণে এই গাছটি প্রায় ৬০-১৫০ সেন্টিমিটার আকারে হয়।
চা পাতার জন্য দুটি পাতা এবং এর সামনের অংশের একটি কুঁড়ি ব্যবহার করা হয়।
চায়ের আদি নিবাস চীন, জাপান, শ্রীলঙ্কা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। ১৭ শতকে ইংল্যান্ডের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলাদেশে চায়ের প্রচার শুরু করেছিলো। গেলাম চা পাতার গাছ দেখতে। আরে বাবা সারি সারি পাতা, সেডের নীচে। সেখান থেকে মাথা ফুঁড়ে বের হচ্ছে একটি কুঁড়ি দুটি পাতা। অলস ভাবে পরে রয়েছে সেগুলো। প্রাণে প্রাণে বড় হচ্ছে তা। এক পাতা থেকে এক গাছ। কি যে সুন্দর সব।
ফিরছি চা গাছ নিয়ে। হঠাৎ দেখি হলুদ আলোর আভা মাঠের এক কোনে। গাড়ি থামিয়ে দৌঁড়। এরকম হলুদ ফুল জীবনেও দেখিনি। যেন স্বর্গ থেকে আসা।
ঘুরতে ঘুরতে দেখা মেলে সাত রঙের চা বানানোর কারিগরের। দু:খ করে তিনি বললেন, তার বানানো চায়ের পদ্ধতি আজ অনেকেই নকল করে বিক্রি করে। তাতে ক্যামিকেল দেয়া হয়। ক্রেতারা ঠকে যায়। জানতেও পারেনা তারা! খেলাম এখানে সাদা চা।
সাদা চা খেতে খেতে দু:খ লাগলো সাদা মনের মানুষদের জন্য। সারাজীবন তারা কষ্ট করে যা অর্জন করেন কালো মনের মানুষরা তা একনিমিষে নিজের বলে দাবী করে। তাদের মিথ্যে দাপটের কাছে অসহায় সাদা মনের মানুষরা।
তবে প্রকৃতি শুদ্ধ বলেই আজো প্রাণে বাঁচা। তাঁর হিসেব নিকেষ বিচার বড় সুক্ষ! সময়ই সে করে দেয় সময়ের কাজ।
ভাবতে ভাবতে বসি এক কাপ চা নিয়ে। মাধবপুর লেকে তখন ডুবছে লাল সূর্য। আমরা একপা একপা করে ঘরে ফিরি। গাড়ী রেডি। সময় কম। ষ্টেশনে যেতে হবে। কোনোরকমে খেয়ে গাড়ীতে উঠবো রেস্ট হাউজের শিবলী ভাই ডাকলেন নিতাই দাকে। বললেন আচারের বৈয়াম তুলে দাও গাড়ীতে।
ঠিক সেইসময়, সেইসময়ই আমার মনে হলো বাবার কথা, মার কথা, ভাইয়ের কথা। বাসা থেকে আসার সময় এমন করেই বেঁধে দিতেন আব্বা-আম্মা। শেষ মুহুর্তেই চলতো সব তাড়াহুড়া বাঁধাছাদা।
গাড়ি ছেড়ে দিলো। শিবলী ভাই দাঁড়িয়ে থাকলেন একা রেস্ট হাউসের বারান্দায়। মনে মনে বললাম ভালো থেকো কড়ই গাছ, হলুদ ফুল আর চায়ের দেশের নির্মল মানুষরা। ভালো থেকো।।
লেখক: সাংবাদিক
এসি
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।