ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪

এক ধূসর স্বপ্ন

আহমেদ মুশফিকা নাজনীন

প্রকাশিত : ১৩:৩৯, ১৩ নভেম্বর ২০১৯ | আপডেট: ১৩:৪৫, ১৩ নভেম্বর ২০১৯

ছোটবেলায় আমাদের বিছানার চাদর ছিল সাদার মধ্যে নানা রঙের ষ্ট্রাইপ। রাতে শোয়ার সময় আমি আর আমার ছোট ভাই রাসেল হাত দিয়ে মেপে নিতাম। আড়াই আড়াই। চাদরের নীল দাগটা ছিল বর্ডার। কেউ ক্রস করবে না। গভীর রাতে যখন রাসেল কোলবালিশ নিয়ে এক পা বর্ডারে রাখতো ঠিক তখনই ঠাস করে চড় মারতাম ওর পায়ে। সঙ্গে সঙ্গেই তাড়াতাড়ি করে সরে যেত সে।

কখনো বা আমি যদি কোনো রাতে বর্ডার ক্রস করে পা রাখতাম ও ঝটকা দিয়ে সরিয়ে দিত। সকালে ওঠে দুজনই এমন ভাব করতাম যেন বর্ডার ক্রস কোনোকালেই হয়নি। অথচ প্রতিরাতেই তা হতো। রাতে মশারি টানাতাম দুই কোনা করে। ও দুইটা, আমি দুইটা। মাঝে মাঝে আলসেমি করে আমি আমার কোনা না টানিয়ে শুয়ে পরতাম। বলতাম আমার মশা তোমাকে কামড়াবে না। ওদের নেতাকে বলে দিয়েছি। অর্ধেকভাবে মশারি ঝুলছে । ঘুমানো সম্ভব না, বাধ্য হয়ে রাসেল ৪ কোনাই টানাতো। মশা গুনতাম। ৬টা থাকলে ও ৩ টা আমি ৩টা। বেজোড় থাকলে ৪/ ৩। এভাবে ওলোট-পালট করে আমরা সব কাজ করতাম।

আশ্বিনের দুপুরবেলা আম্মা-আব্বা ঘুম। পা টিপে টিপে দুজন রান্না ঘরে গিয়ে দুধ দিয়ে সেমাই বানাতাম। তারপর বাটিতে ভাগ করে গরম গরম খেতাম। বিলাতী দুধ (গুড়ো দুধ) খাতার মধ্যে নিয়ে চাপ দিয়ে শক্ত করতাম। কখনো কখনো চিনি দিতাম তাতে। এরপর চকলেটের মতো সেই দুধ মুখে নিয়ে খেতাম। দেখতাম কার ভাগে বেশি পড়েছে। সেই ছোটবেলায় মনে হতো আম্মা বেশি গুড়ো দুধ খেতে দেন না। বড় হয়ে চাকরি করে সব টাকা দিয়ে দুধ কিনে আরাম করে খাব। মন ভরে খাব আইসক্রিম। আমাদের দুই ভাইবোনের একটা স্বপ্ন ছিল টফির ঘর। আমরা প্রতিদিন মুঠো মুঠো টফির ঘর থেকে টফি খাব কিন্তু কোনদিন তা শেষ হবে না।

আমাদের টফির ঘর আর হয়নি। দোকানে এখন কত টফি। আমাদের আর খেতে ইচ্ছে করে না। আমাদের মন মরে গেছে। আমার ছোট ভাইটা মন বিষণ্ণ করে এখন আকাশ দেখে। আমি দেখি ওকে। একবার রাজশাহীতে আমার হাওয়াইন গিটারের তার ছিঁড়ে যায়। ঠিক করার পরেও বারবার ছিঁড়ে যায়। আব্বা টাকা দিয়েছেন নতুন গিটার কেনার। সে টাকা নাই। খেয়ে ফেলেছি।

রাসেল তখন রাজশাহী বিআইটিতে পড়ে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। ভার্সিটির বাসে করে ওর ওখানে যাই। বললাম গিটার কিনতে হবে কিন্তু টাকা নাই। খেয়ে ফেলেছি। আব্বাকে বলতে হবে। ও বলে আপু, কোনোভাবে কয়েকটা দিন চালাও। আমি তোমাকে পরে একটা পিয়ানো কিনে দিব। আমি ভার্সিটি যাবার সময় পুরো রাস্তা রিক্সায় বসে কাঁদতে কাঁদতে গেলাম। আমার ছোট ভাইটা এত ভালো কেন? আমি ওকে কালটু বলতাম, এখনো বলি। ও হাত ধরলে বলতাম এই রে আমার এই জায়গাটা এখন কালো হয়ে গেছে। ও হাসতো। ওর বন্ধুদের নাম নিয়ে ছড়া কাটতাম। ও আমার ভয়ে বন্ধুদের নাম আর বলতো না।

লাল নীল দুষ্টামি করে আমাদের দিন কাটতো। রংপুরের বাসায়, মাইকে যেই বাজতো আমি যে কে তোমার তুমি তা বুঝে নাও...... এই গান শুনলেই দুজনই দৌঁড়ে যেতাম বাসার পেছনে। একতালা বাসার কর্ণারে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে ১০ পয়সা, ৫০ পয়সা আর ১ টাকা দিয়ে আইসক্রিম খেতাম। ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে নারিকেল দেয়াটা খেতাম। নিজেরটা শেষ করে কখনো ওরটায় ভাগ বসালে বেশিরভাগটাই কামড়ে খেয়ে ফেলতাম। ও কিছু বলতো না। শুধু চোখ ছলছল করে থাকতো।


ভাইয়ের ছেলে পান্থকে কোলে নিয়ে রাসেল।

এখনো চোখ ছলছল করে থাকে। ওর দিকে আমি তাকাতে পারিনা। পালিয়ে বেড়াই। ওর কাছ থেকে, নিজের কাছ থেকে। আমার অভিমানী ভাইটার মাথায় টিউমার বাসা বেঁধেছে। দ্রুত সরাতে হবে ওকে। সারা পৃথিবীতে আকাশে বাতাসে কত জায়গা। মাথাতেই বাসা বাঁধতে হলো ওর! কেন? প্রশ্ন করি সৃষ্টিকর্তার কাছে, উত্তর পাই না। মন ভেঙেচুরে যায়।

ভাইটাকে বললাম, বাবু, তুই ভালো হলে আমরা একটা ফার্ম দিব। তারপর সবাই চাকরি ছেড়ে আমরা ৫ ভাইবোন আর সবার বর বউ বাচ্চা কাচ্চা সবাই মিলে ফার্মটা চালাবো। দাদাবাড়ি চলে যাবো সবাই। ঠিক আছে? ও আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। সেই ছোটবেলার মতো। ছলছল চোখে।

ওর সেই ছলছল চোখ মনের গভীরে রেখে আমরা মলিন মুখে দৌড়াই এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে। ব্রেন টিউমারটাকে সরাতে হবে। সুস্থ করতে হবে ভাইটাকে। অবশেষে নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে অপারেশন হয় ওর। হাসপাতালে গিয়ে আমরা অবাক। এতো রোগী। এতো এতো রোগী ব্রেন টিউমারের। ছোট ছোট শিশুদের বড় মাথা দেখে কান্না পায়। 

চিকিৎসক জানান, টিউমারের কারণে মাথায় পানি জমে এ  অবস্থা তাদের। বাবা মার করুণ মুখগুলো দেখে মন বিষাদে ভরে ওঠে। রাসেলের অপারেশনের পর বায়োপসি করতে পাঠানো হয় কয়েকটি ল্যাবে। একেক ল্যাব থেকে একেক রকমের রিপোর্ট আসে। আমরা হতবাক। দিশেহারা হয়ে পড়ি। কোন রিপোর্ট বিশ্বাস করবো! স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চরম দুর্দশা অনুভব করি। নির্ভুল রিপোর্ট পেতে চলে যায় কটা মুল্যবান দিন। শুরু হয় ওর ক্যান্সার হাসপাতালে রেডিওথেরাপী। ৬টা দেয়ার পর ভাইটা আর নিতে পারে না। খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দেয়। আবার ভর্তি হয় হাসপাতালে। ৫দিন পর ১ নভেম্বর সে চলে যায় না ফেরার দেশে।
 
আমি আর রাসেল কখনো একসাথে ঢাকা থেকে বাড়ি যাইনি। এবার গেলাম। তবে দুটো আলাদা গাড়ীতে। ও সামনে আমরা পিছনে। যখনই বাড়ি যেতাম আব্বা আর রাসেল বারবার ফোন করতো, আর কতদূর। এখন কোথায়। ওর ফোনে আমরা হাসতাম। গোবিন্দগঞ্জে নেমে দেখতাম কুয়াশার মধ্যে মাথায় মাফলার জড়িয়ে ও দাঁড়িয়ে আছে। হাত থেকে ব্যাগটা নিতো। রিকশা রেডি করাই থাকতো। আমাদের মনে সুর বাজতো বাড়ি এলাম। আহ কি শান্তি!

এবার মনে সে সুর নেই। শান্তিও নেই! রাসেল আর ফোন দেয়ার জন্য ব্যস্ত হয় না। আমরাই ব্যস্ত ওকে নিয়ে। ওর গাড়িটা সারারাত ছিল বাসার শিউলি গাছের নীচে। মাঝরাতে কয়েকটা ফুল দেই গাড়িতে। ভোরের দিকে দেখি শিউলিরা ঝরে আছে সামনে। একটা পাখি ওর ঘরের দরজার পাশে। মনে হলো এই পাখিটা কি ও! এতো আপন লাগছে কেন? ভালো করে তাকাতেই মাথার উপর দিয়ে দ্রুত উড়ে গেল। কেন গেলো, কই গেল, কে জানে! তাকিয়ে রইলাম। আর খুঁজে পেলাম না।


রাসেলের কবর

বাবার পাশে থাকতে চেয়েছিল ও। তাই থাকল। আমগাছের নীচে বসে থাকি আমরা। লাল জবা টুপটাপ ঝরে। কান্না আসে। অনুভব করি বাবা দাদা দাদী আর ভাইটাকে। ওরাও কি দেখে আমাদের! বিশ্বাস দেখে। রাসেল নিশ্চয় আব্বাকে বলছে, দেখো, তোমার ছোট মেয়ের কাণ্ড দেখো। বড় আর হলো না। খালি ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদে। সাধে কি আর সব দায়িত্ব আমি নিতাম। এরা ৪ ভাই বোন কিচ্ছু বোঝেনা।

ভাইয়ার ছোট ছেলে শ্রেয় পার্টিতে বসে একনাগারে ইয়াসিন সুরা পড়ে। সে সুর ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে। জান্নাতি নামে এক পিচ্চি হাড়ি পাতিল নিয়ে বসে খেলতে। বলে এখানে রাসেল বাবা ঘুমায়। ভয় নেই কোনো। চোখ বন্ধ করলেও রাসেল বাবা লজেন্স দিবে ওদের। এমনই বিশ্বাস। দেবশিশুদের বিশ্বাস ভাঙি কি করে। বাচ্চাদের পছন্দ করতো ও। পাঞ্জাবির পকেট ভরা থাকতো চকলেট। কেউ বলতো লজেন্স চাচু, কেউ বলতো রাসেল বাবা, কারও কাছে ম্যাও চাচ্চু, কারও কাছে বন্ধু, কেউবা আবার বলতো গ্রামের বাতি।

অবাক হয়ে দেখি ওর মিলাদে অংশ নেয়া প্রায় ২ হাজার মানুষের মধ্যে শিশুর সংখ্যাই বেশি। মিলাদে এতো শিশু একসাথে আমি আমার জীবনে দেখিনি। সৃষ্টিকর্তার অপার রহস্য জানা নেই। অথেনটিক নামে এক ফার্ম দেয়ার স্বপ্ন দেখতো ও। ওর স্বপ্ন এখন আমরা দেখি। বিনে পয়সায় কারও বাড়ি কারো মসজিদের ডিজাইন করতো। টাকা নেয়ার কথা বললে হাসতো। মাঝে মাঝে হতো বিরক্ত। যেন আমরা কি বোকা। কারও কাজ করে দিলে কি মূল্য নিতে হয়! মূল্য নিতো না বলেই বুঝি ও ছিল মূল্যবান। আমরা হারিয়ে ফেললাম আমাদের মূল্যবান সেই ভাইটাকে। হাজার কেঁদেও যাকে আর পাইনা খুঁজে। পুকুর পাড়ে, আমগাছের ছায়া, তাল পাখার বাতাস আর লাল জবা গাছের নীচে ঘুমিয়ে আছে সে।

লেখক-সাংবাদিক


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি