ঢাকা, শুক্রবার   ১৫ নভেম্বর ২০২৪

একজন জাপানি খান সাহেব

নাসিম হোসেন

প্রকাশিত : ২২:০৯, ৩১ আগস্ট ২০২১ | আপডেট: ১৭:১৭, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২১

নাসিম হোসেন একজন (অব.) সেনা কর্মকর্তা। বর্তমানে তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। 

‘আপনি জাপান থেকে কেন ফিরলেন?’
প্রচণ্ড কৌতুহল দমাতে না পেরে জাহাঙ্গীর খানের সঙ্গে পরিচয়ের শুরুতেই তাকে ঐরকম একটা প্রশ্ন করে বসি।

‘ভাই  আমি মুসলমান হিসাবে মরার জন্য বাংলাদেশে এসেছি’

স্থানীয় লোকজনের কাছে যিনি জাপানি খান সাহেব নামে পরিচিত তিনি খুব স্বাভাবিক ভাবেই আমার প্রশ্নের জবাব দিলেন। তবে তার জবাবটা আমার কৌতুহল আরো বাড়িয়ে দিলো।
খুব ব্যক্তিগত প্রশ্ন হয়ে যাওয়ায় তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেই। উনি হাসতে হাসতে জবাব দিলেন-

‘ভাই আমি বাংলাদেশে পরিবার নিয়ে ফেরত আসার পর মানুষের এরকম কৌতুহলজনক প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আমি এখন এসবই খুব স্বাভাবিকভাবে নেই।’

মহাখালী ডিওএইচএসের বাসার বারান্দায় বসে তার সঙ্গে আমার আলাপ শুরু হয়। জাহাঙ্গীর সাহেব যুবক বয়সে জাপান চলে যান। উনি একজন মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার। কাজের সূত্রেই তার সঙ্গে পরিচয় হয় জাপানি মেয়ের। এক পর্যায়ে তাকেই বিয়ে করেন তিনি। তার চার কন্যা এক পুত্র। দীর্ঘ ২৪ বছর কাটিয়েছেন সেদেশে।  

বড় ছেলেটি জাপানে থাকে ওখানেই বিয়ে করেছে। একসময় তার মনে হলো জাপান তার দেশ নয়, জাপানে তার স্থায়ী বসবাসের অনুমতি আছে, কিন্তু তিনি কখনোই জাপানের নাগরিক হতে পারবেন না। তিনি অর্থ উপার্জনের জন্য জাপান গিয়েছেন। জীবন চালানোর অর্থ সঞ্চয় করেছেন, বাড়ি করেছেন।

তার এক সময় মনে হলো জাপানে মারা গেলে তিনি মুসলমানদের মতো শেষকৃত্য পাবেন না। তার সন্তানেরা মুসলমান হিসাবে বেড়ে উঠবে না। বেড়ে উঠবে শিন্টো কালচারে। 
তিনি তার স্ত্রীকে রাজি করালেন বাংলাদেশে স্থায়ী হতে। তিনি চান তার স্ত্রী সন্তানেরা মুসলমান হিসাবে বেড়ে উঠুক। বাংলার কাদামাটিতে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ’ উচ্চারণের মধ্যে তার দাফন হোক। 

দেশে ফিরে তিনি কোন 'আংরেজি' মিডিয়াম স্কুলে পড়াতে চাননি। জাপানে থেকে থেকে ‘কোয়ালিটি’ সম্পর্কে তার সচেতনতা তীব্র হয়েছে। তিনি চান ভালো শৃঙ্খলাযুক্ত কোন স্কুলে পড়াতে। ‘অক্সফোর্ড’ ‘ক্যাম্ব্রীজ’ নামযুক্ত বনেদী পাড়ার টাকার কুমীরের কাছে তার সন্তানদের সপে দিতে তিনি রাজী নন। তার উপর মেয়ে বলে কথা। বেশ ক’বছর এদিক সেদিক ঘুরে তিনি সেনাবাহিনীর ‘লেফট্-রাইট’ করানো স্কুলে টাইট পজিশনে বড় হবে আশায় আমার স্ত্রীর স্কুলে দিয়েছেন। 


সম্প্রতি দুই জাপানী শিশুকে নিজেদের কাছে রাখার আইনি লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছেন বাবা ও মা

চার কন্যার মধ্যে দ্বিতীয় কন্যা ৬ষ্ঠ শ্রেনীর ছাত্রী ‘মিজিকো’। আমার স্ত্রী মিজিকো’র ক্লাশ টিচার। ওর কাছ থেকেই মিজিকোর অনেক বিষয়ে আলাপ করতে শুনেছি। চার বিষয়ে ফেল-টিসি’র খড়্গ ওর মাথার উপর। 
প্রায় সময়ই তাকে মিজিকোর বাবার সঙ্গে ফোনে কথা বলতে শুনতাম। মিজিকোর টিসি ঠেকানোর জন্য ওর বাবা মরিয়া। আমার স্ত্রীর কাছে সপ্তাহে তিন দিন বিজ্ঞান গণিত পড়তে আসে। সারাদিন মেয়েদের স্কুলে আনা-নেওয়া, কোচিং-প্রাইভেট শিক্ষকের বাড়িতে বাড়িতে  ঘোরাঘুরি করাই জাহাঙ্গীর সাহেবের কাজ। 

তিনি কোন চাকরি করেন না, ব্যবসাতো নয়ই। মেয়েদের পিছনে ঘরে বাইরে সময় দেন। তার সর্ব সময়ের ধ্যান জ্ঞান চার কন্যার সুরক্ষা। জাহাঙ্গীর সাহেব বেশ ধার্মিক জাপানি স্ত্রীসহ হজ্ব করেছেন। 

জাহাঙ্গীর সাহেব বেশ করে চেপে ধরলেন মিরপুরের তার বাসায় চায়ের দাওয়াত নিতে।

যাবো যাবো বলে বেশ ক’দিন কাটিয়ে দিলাম। শুক্রবার ছাড়া সময় হয় না। সপ্তাহের একটি দিনই ছুটি। তবে তার ‘জাপান-বাংলা ফ্রেন্ডশীপ’ ফ্যামিলিটির আভ্যন্তরীণ পরিবেশ কেমন তা জানার আগ্রহ থেকে তাকে কথা দেই যাবো।

চার বোনের মধ্যে মিজিকো পড়াশোনায় খুবই অমনোযোগী। আমার স্ত্রী খুবই হতাশা ব্যক্ত করতো মিজিকোর ধীর গতি দেখে। ‘এই মেয়ে একদম অংক বোঝে না’।

আমার শুনে খটকা লাগতো ‘এতো জাপানি প্রোডাক্ট, Casio ক্যালকুলেটরের দেশে যার জন্ম, সে বাংলাদেশের অংক পারবেনা তাই হয় কি?

Made in Japan বলে একটা কথা আছেনা! জাহাঙ্গীর সাহেব দীর্ঘ দিন জাপান থেকে আনা নানা প্রকারের খাবার এনে এদেশে এদের ধীরে ধীরে ধাতস্থ করেছেন। কিন্ত বাংলাদেশের জলবায়ুতে এসে পড়ে মিজিকো গবেটে পরিণত হয়েছে। 


সুর্যোদয়ের দেশ জাপান। ছবি তুলেছেন জিমি মজুমদার

তবে মিজিকোর এই হালের পিছনে আগের স্কুলের (আসলে কোচিং সেন্টারের) ভূমিকা  উল্লেখযোগ্য। জাহাঙ্গীর সাহেব খুব হতাশ হয়ে জানালেন, আগের স্কুলে ভূয়া প্রগ্রেস রিপোর্ট দিতো পরীক্ষায় খারাপ করলেও ফেল দেখাতো না। অর্থাৎ Made in Jinjira টাইপের প্রগেস রিপোর্ট যাতে ছাত্রীর অভিভাবক মেয়েকে কোচিং সেন্টার থেকে ছাড়িয়ে না নেয়।

মাতৃভাষা বাংলা না হওয়ায় মিজিকোর বাংলা নিয়েও চরম সমস্যা। বিশেষ করে ব্যাকরণ‘তালিব শ’ ‘দন্ত্য স’ আর ‘মুর্ধণ্য ষ’ টাইপ বানানের চক্কর তার বাড়ির কাছের দশ নম্বর গোল চক্করের ট্রাফিক জ্যামের মতোই মনে হতো।
পরীক্ষায় ফেল মারলেও মিজিকোর শিষ্টাচারে একটা প্রবল জাপানি ভাব ছিলো। বাসায় ও পড়তে আসলে কলিং বেলের শব্দ শুনে দরজা খুলে দিলে জাপানি কায়দায় একটু ঈষৎ সামনে ঝুকেঁ অনুচ্চস্বরে সালাম দিতো। আগেই দরজার পাশে রাখা রেকে জুতো রেখে ঘরে ঢুকতো।

জাহাঙ্গীর সাহেবের সার্বক্ষণিক প্রহরার মাঝেও বাংলার উর্বর জলবায়ুতে বড় হওয়া সদ্য কিশোরী মিজিকোর জানালায় কোন এক ফাঁকে প্রেমের ঢিল ছুড়ে মারে পাড়াতো এক শাহরুখ খান।  

মুসলিম পরিবেশে বড় করবেন বলে উন্নত দেশের শীর্ষে থাকা জাপানের রোবট জীবনকে ফেলে এসেছেন। 
বাংলাদেশে থাকবেন, মসজিদের পাশে বাড়ি করবেন, আজান শুনে নামাজ পড়তে যাবেন। নিজের ধর্ম-সংস্কৃতিকে তার পরের প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিবেন বলে জাপানের জৌলুশ ছেড়ে এসেছেন। জাহাঙ্গীর সাহেব খুব করে বললেন যেন   মিজিকোর ক্লাশ টিচার মেয়েকে কাউন্সিলিং করে। 

এক শুক্রবার বিকেলে মিরপুরে জাহাঙ্গীর খান সাহেবের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হই। উনার ঠিকানার বিশদ বর্ননা দিয়ে বললেন এলাকায় উনাকে ‘জাপানি খান সাহেব’ হিসাবে চিনে।

জাপানি খান সাহেবের বাড়ির দরজায় জাপানি কিমানো পড়া কোন বউকে দেখবো বলে আশা করেছিলাম। আর একটা কৌতুহলও ছিলো উনার বাসায় নিশ্চয়ই একটা জাপানি সংস্কৃতির প্রবলভাব দেখবো বলে।

না সে-রকম কিমানো পড়া কাউকে দেখলাম না। আপাদমস্তক হিজাবে ঢাকা মিসেস জাপানি খান সাহেব স্মিত হেসে অভ্যর্থনা জানালেন। বাড়ির অন্দরমহলের কোথাও কোন জাপানি ডেকোরেশন বা গৃহ সজ্জার কোন চিহ্ন নেই। বসার ঘরে একটা কাবা শরীফের বড়সড় দেওয়াল চিত্র।

চারিদিকে চোখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে বুঝলাম মিসেস খান শুধু জাপানকেই ফেলে আসেননি তিনি তার আজন্ম লালিত সংস্কৃতিকেও প্রশান্ত মহাসাগরের ঐ দ্বীপ দেশটিতে ফেলে এসেছেন। ভালোবাসার সামুরাই জন্মভূমির সাথে তার নাড়ির বন্ধন কেটে দিয়েছে।

নব্বইয়ের কোঠায় বসবাস করা বাবা-মাকেও দেখেন না বেশ  ক’বছর। বেশভূষাতে বোঝা গেল তিনিও খান সাহেবের মতো ধার্মিক এবং মুসলমান হয়ে মরার জন্য বাংলাদেশে এসেছেন। 

খান সাহেবের ডাকে মিজিকোর অপরাপর বোনেরাও জাপান বাংলা যৌথ কায়দায় সালাম দিয়ে গেল। আমার স্ত্রী মিজিকোর সঙ্গে কথা বলতে ভেতরে চলে যেতেই খান সাহেবের সাথে আলাপচারিতায় লিপ্ত হই।

‘আপনার বাড়িতে জাপানি সংস্কৃতির কোন চিহ্ন নেই, কেন?-আমার প্রশ্ন।

‘আমি ইচ্ছে করেই জাপানি সংস্কৃতির কোন চিহ্ন রাখিনা। ওরা এদেশে এসেছে এই দেশের নিয়মে বড় হোক। আমাকে এ পর্যায়ে জাহাঙ্গীর সাহেবকে বেশ একটু গোড়াই মনে হলো। জাহাঙ্গীর সাহেবকে বললাম আপনি নিজে এদেশে চলে এসেছেন, কিন্তু বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ বিবেচনায় নিয়ে এরকম ফেরত আসার সিদ্ধান্ত মেয়েরা কিভাবে নেবে? আপনার বাসার সামনের রাস্তা সামান্য বৃষ্টির পানিতে ডুবে যায়। এতো সব গরীবির মধ্যে থেকে উন্নত দেশের হাতছানিকে কিভাবে উপেক্ষা করা যায়।

আমাদের এসব কথার মাঝে জাপানি ভাবী বললেন, তার চোখে সবচেয়ে বেশি বৈসাদৃশ্য মনে হয় যে বিষয়টা সেটা হলোঃ এদেশের মানুষের প্রতারণার বিষয়টি। ফল কিনতে গেলে তার কাছ থেকে বেশি দাম তো নেবেই, তারপরও পচা বা খারাপ ফল গছিয়ে দেয়। মসজিদের কাছের ফল দোকানীটা মাথায় টুপি পড়ে অবলীলায় তাকে ঠকায় দামে এবং ওজনে। স্বামীর হাত ধরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী এই জাপানি মহিলা জানালেন তার মেয়েদের তিনি ইসলামি শিক্ষা দিয়েছেন। 

ছোট্ট মেয়েটি কোরআন শিক্ষা করছে এমন একটি ছবিও দেখলাম। ছেলেকে দেশে এনে আবার ইসলামি প্রথা মোতাবেক বিয়ে করিয়েছেন। একমাত্র ছেলে এবং বউয়ের ছবি সগৌরবে দেওয়ালে ঝুলছে। 

খান সাহেবের জাপানি স্ত্রীকে প্রশ্ন করলাম আপনি খান সাহেবকে কি দেখে পছন্দ করলেন? 

উনি প্রশ্নটাকে ঘুরিয়ে উত্তর দিলেন, ‘উনি খুব ভালো বাবা, জাপানি বাবারা এতো কাজ করে না।
জাপানি খান সাহেব নিজ ধর্ম ও সংস্কৃতির টানে দেশে এসেছেন। তার কথা-‘আমি জাপানের কোন বৃদ্ধাশ্রমে মরতে চাই না। আমি সন্তান আত্মীয় পরিবেষ্টিত অবস্থায় মরতে চাই। 

আজ (২৬ আগস্ট ২০২১) টিভির সংবাদে বাংলাদেশী বাবা ইরফান শাহীনকে তার মেয়েদেরকে জড়িয়ে ধরা ছবি দেখে জাপানি খান সাহেবের কথা মনে পড়লো। সাড়া দিনমান মেয়েদের বুকের মাঝে আকড়ে রাখেন যেন বাংলার শত দূর্যোগের মধ্যেও ওরা মুসলিম সংস্কৃতির মধ্যে বড় হয়। বাবাকে যেন ফেলে না যায়।

জাপানি খান সাহেবের কন্যাদের প্রতি সার্বক্ষণিক নজর আর বাংলাদেশী ইরফানের সঙ্গে তার জাপানি স্ত্রীর সন্তানের দেখভালের মামলা দেখে মনে হলো মিক্সড ম্যারেজ সন্তানদের জীবনকে তাদের অজান্তে কি চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে দেয়।
বাংলাদেশী দুই বাবার সংগ্রাম দেখে হুমায়ুন আহমেদের একটা উক্তি মনে পড়লো,‘পৃথিবীতে অনেক খারাপ মানুষ আছে, কিন্তু একটাও খারাপ বাবা নেই।’ 

জাপানি খান সাহেবের সেই কথা ‘ও অনেক ভালো বাবা’ আর মেয়েদের আগলে রাখা সন্তানের অধিকার পেতে কোর্টের আঙ্গিনায় ক্রন্দনরত ইরফান শাহীনের ছবি হুমায়ুন আহমেদের কথাই মনে করিয়ে দেয়‘পৃথিবীতে একটাও খারাপ বাবা নেই।’


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি