একজন ডাঃ বিধান রায়ের কথা
প্রকাশিত : ২১:৩৬, ৮ এপ্রিল ২০২১ | আপডেট: ২২:০৫, ৮ এপ্রিল ২০২১
ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়
ডাঃ নীলরতন সরকারের কন্যা শ্রী মতি কল্যানীর প্রতি শ্রী বিধান চন্দ্র রায়ের ভালোবাসার কথা হয়তো সবাই কম-বেশি জানেন। কিন্তু ডাঃ নীলরতন সরকার তখন ছিলেন ভারতবর্ষের খ্যাতনামা ডাক্তার। বিধান রায়ের মতো নতুন প্রজন্মের সাথে নিজের মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি হননি।
বিধান রায়ের নিজেকে বড় ডাক্তার তৈরি করার জেদ তখন থেকেই পরিলক্ষিত হয়। সেই সময় বড় ডাক্তারি ডিগ্রি পাওয়া মানেই, গন্তব্য লন্ডন।বড় ডাক্তার হওয়ার তাগিদে বিধান রায়ের লন্ডন গমন। কিন্তু একটু দেরি করে ফেলেছিলেন। বিধান রায় তখন কিন্তু অলরেডি ডাক্তার হয়ে গিয়েছিলেন। লন্ডনে এসেছিলেন ডাক্তারী শাস্ত্রে আরো উচ্চ ডিগ্রি লাভের জন্য। কিন্তু লন্ডনে এসে দেখেন ভর্তি হওয়ার তারিখ পার হয়ে গেছে। বিধান রায়ের তো মন খারাপ। বিলেতের মেডিকেল কলেজের চত্বরে ঘোরাঘুরি করছেন। এমন সময় ঐ হাসপাতালে একজন রুগি আসলেন।হাসপাতালের সুপার, বিধান রায় কে ঘোরাঘুরি করতে দেখে বললেন এই যে ইয়ং ম্যান, তুমি কি বলতে পারবে এই রুগিটির কি হয়েছে? বিধান রায় কিন্তু সেই রুগিকে না ছুঁয়েই বলে দিয়েছিলেন ওর চিকেন পক্স হয়েছে। যদিও রুগিটির শরীরে কোন বসন্তের গোটা তখনও ওঠেনি। এরপর সুপার সাহেব, বিধান রায় কে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়ং ম্যান তুমি কি করে বুঝলে, ওর চিকেন পক্স হয়েছে।
বিধান রায় বললেন, রুগির স্মেল (গন্ধ) থেকে তিনি এটা বলেছেন। এরপর একদিন পর দেখা গেলো রুগীটির সারা শরীরে চিকেন পক্সে ভরে গিয়েছিলো। সুপার সাহেব তখন সেই ইয়ং ম্যান, মানে বিধান রায়কে তলব করলেন এবং তারিখ চলে যাওয়া সত্বেও ভর্তি নিলেন। পরে এখান থেকেই ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় মেডিসিন এবং সার্জারী দুই ক্ষেত্রেই গোটা বিশ্বে প্রথম হয়। মানে এফআরসিএস এবং এমআরসিপি দুটোতেই প্রথম!! মুখ দেখে রোগীর চিকিৎসা করতেন ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়।
আর বিধান রায়ের মুখ্যমন্ত্রীত্বের সময়েই বাংলার প্রকৃত উন্নয়নের জন্ম হয়। তার হাতেই গড়ে উঠেছিলো লবনহ্রদ থেকে আজকের বিধাননগর, কিংবা দুর্গাপুর, হলদিয়া, অশোকনগর, কল্যানীর মতো আধুনিক শহর। কলকাতা মেট্রো রেলের জন্মও হয় সেই বিধান রায়ের হাত ধরেই।
চিকিৎসা করবেন বলে স্বেচ্ছায় সশ্রম কারাদণ্ড চেয়ে নিয়েছিলেন বিধান রায়। পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায় কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য হিসেবে ১৯৩০ সালে ইংরেজ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন দিল্লি থেকে। তারপর তাঁকে আনা হয় কলকাতার আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে। জেলে ওই সময় বন্দি ছিলেন বর্ধমানের এক গান্ধীবাদী শিক্ষক বিজয়কুমার ভট্টাচার্য। বিজয়বাবু লিখেছেন, তিনি বর্ধমান জেলে থাকাকালীন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। ওজন কমে প্রায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছিল। সর্বক্ষণ জ্বর থাকত। এই সময় তাঁকেও আনা হয় আলিপুর জেলে।
বিধান রায় জেলে এসেছিলেন প্রথম শ্রেণির বন্দি হিসেবে। কিন্তু তিনি স্বেচ্ছায় সশ্রম কারাদণ্ড চেয়ে নিয়েছিলেন জেল কর্তৃপক্ষের কাছে। সাধারণত এটা করা যায় না, কিন্তু সম্ভবত বিধান রায়ের ব্যক্তিত্বের সামনে ওঁরা না বলতে পারেননি। ফলে ডাঃ বিধান রায়ের ডিউটি পড়ল জেলের হাসপাতালে।
কিছু দিনের মধ্যেই বোঝা গেল জেলে রোগীর মৃত্যুসংখ্যা কমে গেছে। নিউমোনিয়া, টাইফায়েড ইত্যাদি কিছু কঠিন অসুখের ওষুধ জেলে থাকত না। সে সব বিধান রায় তাঁর দাদা সুবোধ রায়ের মাধ্যমে বাইরে থেকে নিজের টাকায় আনাতে শুরু করলেন।
প্রায়ই দেখা যেত ছ’ফুট ছাড়ানো লোকটা স্টেথো গলায় দিয়ে জেলের হাসপাতালে বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছেন, পেছন পেছন চলেছেন জেলের সরকারি ডাক্তার।
গান্ধীবাদী সেই শিক্ষক বিজয়কুমার ভট্টাচার্য লিখেছেন, “বিধানবাবু চেয়ারটা টেনে নিয়ে আমার বিছানার পাশে বসলেন। মিনিট কয়েক চেয়ে রইলেন আমার দিকে। তারপর অসুখ নিয়ে কয়েকটা প্রশ্ন করলেন। মুখের দিকে তাকালাম। একটু যেন চিন্তিত বলে মনে হল। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে মুখখানা আবার প্রফুল্ল হয়ে উঠল। হেসে বললেন, ‘কিছু না। সেরে যাবে।’ মনে হল এর মধ্যেই অসুখের সব কিছু বুঝে ফেলেছেন।
বিজয়কুমার ভট্টাচার্যই এরপর জানিয়েছেন, কোনও রোগীর চিকিৎসা শুরুর আগে বিধান রায় কিছুক্ষণ সেই রোগীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। সেই অন্তর্ভেদী দৃষ্টি দিয়ে তিনি রোগ নির্ণয় করতেন।
ওই জেল হাসপাতালে তখন ১১০ জন রোগী। একদিন জেলের ডাক্তার বঙ্কিমবাবু (উপাধি লেখেননি বিজয়কুমার ভট্টাচার্য) কোনও কারণে আসতে দেরি করছেন। বিধান রায় একাই এক এক করে ১১০ জন রোগীকে দেখলেন। তার পর ছুটতে ছুটতে বঙ্কিমবাবু এসে হাজির। কাঁচুমাঁচু মুখে বন্দি বিধান রায়কে বলছেন, স্যার একটু দেরি হয়ে গেল। বিধান রায় হেসে বললেন, না না ঠিক আছে, রোগী আমি দেখে নিয়েছি, আপনি ওদের টিকিটগুলো আনুন, পথ্য আর ওষুধটা আমি বলে দিচ্ছি।
বিজয়কুমার ভট্টাচার্য লিখেছেন, তিনি অবাক বিস্ময়ে দেখলেন, আধঘণ্টা আগে দেখা ১১০ জন রোগীর প্রত্যেকের জন্য ওষুধ, পথ্য প্রায় মুখস্থ এক এক করে বলে গেলেন ডাঃ বিধান রায়। এমনই অসামান্য স্মৃতিশক্তি ছিল তাঁর।
বিধান রায় জেলে থাকাকালীন পেয়ে গেলেন বন্দি কানাই গাঙ্গুলিকে। কানাইবাবু ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ডক্টরেট করেছিলেন জার্মানি থেকে। খুব ভালো জার্মান ভাষা জানতেন তিনি। তিনি বরিশালের শঙ্কর মঠের স্বামী প্রজ্ঞানন্দের বিপ্লবী দলের সদস্য ছিলেন। পরে গ্রেফতার হন ব্রিটিশ পুলিশের হাতে।
এই কানাই গাঙ্গুলির কাছে জেলের ভিতর বিধান রায় শুরু করলেন জার্মান ভাষা শেখা। এই নিয়ে কানাইবাবু লিখেছিলেন, ছ’মাস জেলে থাকাকালীন বিধান রায় একদিনও বাদ দেননি জার্মান শেখার ক্লাস। এবং যখন জেল ছেড়ে চলে গেলেন, তখন তাঁর এই বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ হয়ে গেছে।
জেলে বিধান রায়ের খাবার আসত ওয়েলিংটনের বাড়ি থেকে। আলিপুর জেলে তখন সিনিয়র ডেপুটি জেলার ছিলেন রায় সাহেব অনিলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। সব রাজনৈতিক বন্দির দায়িত্বে ছিলেন তিনি। নিয়ম অনুযায়ী বাড়ি থেকে খাবার এলে আগে তা ‘টেস্ট’ করে দেখবেন ডেপুটি জেলার। তার পর তা বন্দিকে দেওয়া হবে। এক রাতে অনিলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়িতে বসে খবর পেলেন, বিধান রায়ের খাবার আসেনি। ছুটে গেলেন জেলে। গিয়ে দেখলেন, খাবার এসেছিল, কিন্তু তা এত সুস্বাদু ছিল যে টেস্ট করতে করতে সবটাই খেয়ে ফেলেছেন ডেপুটি জেলার। লজ্জার মাথা খেয়ে অনিলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় বিধান রায়ের ঘরে গিয়ে সব জানালেন।
বিধান রায় হেসে বললেন, আগে বললে তো আমি ওর জন্যেও খাবার পাঠাতে বলে দিতাম। অনিলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় বিধান রায়কে বললেন, তিনি বিধান রায়ের বাড়িতে ফোন করে দিয়েছেন, নতুন করে খাবার পাঠানো হচ্ছে। সেই খাবার এল রাত ১১টায়। বিধান রায় খেলেন। তার পর বাড়ি গেলেন অনিলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়।
একবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির সঙ্গে বিধান রায়ের মিটিং চলছে। মিটিং শেষে বিধান রায় বললেন, মিস্টার প্রেসিডেন্ট আমার মনে হচ্ছে আপনার পিঠে মারাত্মক পেইন আছে। কেনেডি অবাক বিস্ময়ে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, How do you know that?
বিধান রায় বিনীতভাবে বললেন, আমি পেশায় ডাক্তার, নেশায় রাজনীতিবিদ। কেনেডি তাঁর সেক্রেটারিকে চিকিৎসা সংক্রান্ত সকল কাগজ বিধান রায়কে দেখাতে বললেন। বিধান রায় নতুন করে প্রেসক্রিপশন দিলেন। দৃঢ়চিত্তে বললেন, নিয়ম করে খাবেন। না সারলে আমাকে জানাবেন। আমি আবার আসবো আমার নিজ খরচে।
মিটিং শেষে বিদায় নেয়ার আগে হ্যান্ডশেক করতে করতে বললেন, মিস্টার প্রেসিডেন্ট আমার ফী তো দিলেন না! কেনেডি জানতে চাইলেন, কত দিতে হবে ফী? বিধান রায় মওকা পেয়ে পশ্চিম বঙ্গের উন্নয়নের জন্য ৩০০ কোটি টাকা চাইলেন। সাথে সাথে মঞ্জুর করে দিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
উল্লেখ্য ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় (জন্ম ১ জুলাই ১৮৮২ – মৃত্যু ১ জুলাই ১৯৬২) ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে থেকে আমৃত্যু তিনি ওই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। চিকিৎসক হিসেবেও তাঁর বিশেষ খ্যাতি ছিল। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইংল্যান্ড থেকে এমআরসিপি এবং এফআরসিএস উপাধি অর্জন করার পর কলকাতার ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুলে (বর্তমানে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ) শিক্ষকতা ও চিকিৎসা পেশা শুরু করেন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট সদস্য, রয়্যাল সোসাইটি অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড হাইজিন এবং আমেরিকান সোসাইটি অফ চেস্ট ফিজিশিয়ানের ফেলো নির্বাচিত হন।
১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের প্রভাবে রাজনীতিতে যোগ দিয়ে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচনে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে পরাজিত করেন। পরে কলকাতা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক ও কলকাতা পৌরসংস্থার মেয়র নির্বাচিত হন। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে মহাত্মা গান্ধির ডাকে আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দিয়ে কারাবরণ করেন। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মনোনীত হন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন কেন্দ্র থেকে কংগ্রেস প্রার্থীরূপে আইনসভায় নির্বাচিত হন। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে গ্রহণ করেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন পাঁচটি নতুন শহর দূর্গাপুর, বিধাননগর, কল্যাণী, অশোকনগর-কল্যাণগড় ও হাবড়া। তাঁর চৌদ্দ বছরের মুখ্যমন্ত্রিত্বকালে নবগঠিত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের প্রভূত উন্নতি সম্ভব হয়েছিল। এই কারণে তাকে পশ্চিমবঙ্গের রূপকার নামে অভিহিত করা হয়। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভারতের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ভারতরত্নে ভূষিত হন। মৃত্যুর পর তাঁর সম্মানে কলকাতার উপনগরী সল্টলেকের নামকরণ করা হয় বিধাননগর। তাঁর জন্ম ও মৃত্যুদিন ১ জুলাই দিনটি সারা ভারতে "চিকিৎসক দিবস" রূপে পালিত হয়।
(ফেসবুক থেকে নেয়া)
এসি