ঢাকা, সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪

একজন মতিনের ভালোবাসার গল্প

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২১:০৫, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ০৯:২২, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

একজনের কষ্টে যখন অন্যের চোখে অশ্রু আসে, একের সুখে যখন অন্যের মুখে হাসি ফোটে, একজনের ব্যথায় যখন অন্যে ব্যথিত হয়, তাকেই বুঝি ভালোবাসা কয়।

অন্যের অনুভবের সঙ্গে মনের অজান্তেই যখন নিজের অনুভূতিও মিলে যায় তাকেই হয়তো ভালোবাসা বলা হয়। আর সেই ভালোবাসার টানে স্বপ্ন নিয়ে মানুষ আপন গতিতে জীবন পরিচালনা করেন। যতিও ভালোবাসার প্রকৃত সংজ্ঞা কোনো পুস্তকে আছে কি না জানা নেই । থাকলে হয়ত এমটাই হতো।

ভালোবাসার ইতিহাসে লায়লী-মজনু, শিরি-ফরহাদ, মমতাজ-শাহজাহানের নাম অনেক পুরনো অধ্যায়। আধুনিক যুগের ভালোবাসা বিভিন্ন দিবসের বেষ্টনীতে বাঁধা পড়লেও ভালোবাসাকে জয় করা এমনি এক যুগল মতিন-রেবেকা। বয়সে পিতৃ-মাতৃতূল্য হওয়ায় চাচা-চাচি বলে সম্মধোন করলে হয়ত ভুল হবে না। তাদের বয়স নির্দিষ্ট করে বলতে না পারলেও আনুমানিক মতিন চাচার বয়স ৭৫/৭৬ বছর। তার ভাষ্যমতে, ব্রিটিশদের থেকে ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভ করার সময় তার বয়স পাঁচ কি ছয় বছর। আর রেবেকা চাচিতো মতিন চাচার থেকে ছয় বছরের ছোট।

এই যুগল বর্তমানে রাজধানীর মিরপুর মাজার রোড এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকলেও প্রকৃত বাড়ি রংপুর জেলার মিঠাপুকুর গ্রামে। আলাপ করতে করতে শোনা হলো ভালোবাসার জন্য তাদের জীবনে ত্যাগের বর্ণনা। ভালোবাসোকে জয় করতে গিয়ে জীবনে অনেক ক্ষেত্রে কিভাবে পরাজয় বরণ করতে হয়েছে সেগুলো সম্পর্কে।

জন্মসূত্রে পাশাপাশি গ্রামের বাসিন্দা ছিলন মতিন চাচা ও রেবেকা চাচি। নদীতে গোসল শেষ করে গাঁয়ের মেঠো পথ ধরে ভেজা কাপড় হাতে নিয়ে নিজের বাড়ির দিকে যাওয়ার সময় রেবেকা চাচিকে প্রথম দেখাতেই ভালোবেসে ফেলে মতিন চাচা। সেই থেকেই প্রায়ই উঁকি-ঝুকি মারতে থাকে রেবেকা চাচির বাড়িতে। একদিন সুযোগ বুঝে লোক চক্ষুর আড়ালে চাচির সঙ্গে কথাও হয় তার। এভাবে দিন যায়, মাস যায় ভালোবাসার বন্ধনে কঠোরভাবে আবদ্ধ হন দুজন। এক সময় রেবেকা চাচির জন্য বিয়ের সম্বন্ধ আসার খরব শুনতে পেয়ে পাত্র পক্ষ দেখতে আসার আগের রাতেই রেবেকা চাচিকে নিয়ে পালিয়ে চলে আসেন মতিন নিজের বাবার বাড়িতে।

মতিন চাচার বড় ভাইয়ের বিয়ে না হওয়ায় তাদের ভালোবাসাকে মেনে নিতে পারেনি তার বাবা-মা। কিন্তু মতিন চাচা কঠোর লোক। যাকে একবার বিয়ে করবেন বলে ঠিক করছেন তাকেই তিনি বিয়ে করবেন-এমন সিদ্ধান্তই তার। তাই তিনি বাড়ির সঙ্গে সব সর্ম্পক ছিন্ন করে স্থানীয় মৌলভীর মাধ্যমে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে রেবেকা চাচিকে নিয়ে অজানা পথেই পা বাড়ায়। নিজের ভালোবাসাকে পাওয়ার জন্য গৃহস্থ বাবার সব সম্পত্তির মায়া ত্যাগ করে শূন্য হাতে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। ঢাকায় পৌঁছে অশিক্ষিত এই মানুষটি কাজ খুঁজে না পাওয়ারই কথা। হলোও ঠিক তাই। আকাশ ভেঙ্গে মাথায় পরার মতো অবস্থা তার। হাতে টাকা নেই, থাকার জায়গা নেই। তার মধ্যে আবার সঙ্গে নতুন বউ। এমনই অবস্থায় তার কথা হয় রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হারেন নামে এক কুলির সঙ্গে। তার মাধ্যমেই অগ্রিমে ছাড়া বাসা ভাড়া পেলেও অভুক্ত অবস্থায় কাজ খুঁজে না পেয়ে প্রেয়সীর শুকনা মুখের দিকে তাকিয়ে হারেন কুলির পরামর্শে কাঁচা পণ্য সরবরাহের কাজে ব্যবহৃত ঠেলা ভ্যান চালাতে শুরু করে মতিন চাচা। এ ভ্যান চালানোর মাধ্যমে রাজধানীর আড়ৎগুলো থেকে খুচরা বাজারে কাঁচামাল সরবরাহ করা হতো। মতিন চাচার বাসা তখন মিরপুর এলাকাতেই।  এভাবে চলতে থাকল তাদের সংসার। এভাবে বছর কাটতে না কাটতেই রেবেকা চাচির গর্ভে সন্তান আসে। কিন্তু সন্তান পেটে আসার ছয় মাস পর হঠাৎ একদিন পা পিছলে মাটিতে পড়ে পেটে আঘাত পেলে মারা যায় গর্ভের সন্তান। সেই সঙ্গে সন্তান ধারনের ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেন রেবেকা চাচি। এভাবেই সন্তানহীন দুজনের সংসার চলতে থাকে একটু একটু করে।

কয়েক বছর বাদেই দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে ভোর বেলা মতিন চাচা কাঁচামাল সরবরাহ করে সারাদিন বাসার পেছনে মাটির ছোট গর্তের মধ্যে দুজনে লুকিয়ে থাকতো মিলিটারিদের ভয়ে। গভীর রাতে ফাঁকা মাঠে রান্না করে ভাতের হাড়ি নিয়ে মাটির গর্তে নিয়ে সারাদিন সেই ভাত খেতো তারা। এভাবেই যুদ্ধের দিনগুলোর কথা স্বরণ করছিলেন তিনি। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর আবার আগের মতো কাজ করতে শুরু করেন।

এভাবে দিনগুলো কাটতে থাকলেও গত দুই বছর হলো শরীরে পর্যাপ্ত শক্তি না থাকায় কাঁচামাল সরবরাহের কাজ না করে মিরপুর মাজার রোডের ঈসমাইলের রিক্সার গ্যারেজ থেকে ভাড়ায় রিকশা নিয়ে চালান তিনি। ঘরে বসে নেই রেবেকা চাচিও। সংসারে অতিরিক্ত অর্থের যোগান দিতে রাজধানীর কারওয়ান বাজার থেকে স্বল্প পরিমানে কাঁচামাল কিনে মিরপুর মাজার রোডের এলাকায় নিয়ে রাস্তার পাশে ফুটপাতে বসে বিক্রি করেন।

মতিন চাচার বাবা-মা সর্ম্পকে জানতে চাইলে জানান, বছর পাঁচেক আগে আমরা দুজনে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম। বাবা-মা নাকি অনেক আগেই মারা গেছেন। বড় ভাইও নাকি আট বছর আগে মারা গিয়েছে। বাড়িতে আছে ভাইয়ের স্ত্রী, ছেলে ও মেয়ে। আমাকে প্রথমে কেউ চিনতে পারছিল না। পরে স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিরা পরিচয় দেওয়ার পর চিনতে পেরেছিল। আর রেবেকার বাবা-মাও জীবিত নেই। তাদের বাড়িতে আছে দুই ভাই। তারা এখন তাদের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। রেবেকাকে দেখে চিনতে কষ্ট হয়নি তাদের। অতীতকে ভুলে তার ভাইরা আবার তাকে আপন করে নিয়েছে। তাদের সঙ্গে আমাদের এখন প্রায়ই যোগাযোগ হয়।

তিনি আরও জানান, বাবা-মা যদি তখন আমাদের মেনে নিত তাহলে হয়তো বাবা-মায়ের বিদায় লগ্নে তাদের দেখতে পেতাম। তাদের সেবা যত্ন করার সুযোগ পেতাম। আমার আজ রিকশা চালক হতে হতো না। তাহলে হয়ত আজ আমার সন্তানও মারা নাও যেতে পারতো। সাজানো সংসার থাকতো আমার। এখনো যে কম সুখে রয়েছেন তিনি সেটা তিনি কখনোই বলেলনি। ভালোবাসার মানুষকে কাছে পেয়ে এখনো তিনি বেশ সুখেই রয়েছেন বলে জানালেও ভালোবাসাকে জয় করতে গিয়ে তিনি তার জীবন থেকে অনেক মূল্যবান কিছুই হারিয়ে ফেলেছেন বলেও জানান তিনি।

ভালোবাসা দিবস সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, গত দুই বছর ধরে রিক্সা চালাই কত কিছুই যে দেখি। আসলে ভালোবাসা বর্তমানে মানুষের কাছে পুতুলে মতো হয়ে গেছে। যখন ইচ্ছা ধুয়ে মুছে খেলতে লাগলো আবার যখন ইচ্ছা উঠিয়ে রাখলো। বছরে একটা দিন পালন করলেই বুঝি ভালোবাসা পূর্ণতা পায়। আসলে ভালোবাসা কখনোই ফুরাবার নয়। ভালোবাসা কখনোই যে কোন দিবসকে ঘিরে হয় না-এই বিষয়টা বর্তমানে কেউ মানতেই চায় না।

প্রিয় মানুষের হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেওয়ার নামই ভালোবাসা। ‘ভালোবাসা বিশেষ দিনের জন্য না অনন্তকালের ’।

 টিকে/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি