একজন মানবিক চিকিৎসকের গল্প
প্রকাশিত : ১৮:০৩, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৩
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বাবা এবং ব্লাড ক্যান্সারে মৃত ছোট ভাইয়ের জন্য সাদকায় জারিয়ার অংশ হিসাবে মানুষের জন্য কিছু করার স্বপ্ন দেখেছিলেন চিকিৎসাবিদ্যায় স্বাধীনতা পুরস্কার প্রাপ্ত চিকিৎসক কামরুল ইসলাম। প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে সেই স্বপ্নকেই বাস্তবে রূপ দিয়েছেন তিনি। একে একে হতদরিদ্র ১৬শ মানুষের কিডনি তিনি প্রতিস্থাপন করেছেন বিনাপারিশ্রমিকে। চলুন জেনে আসি মহৎ এই চিকিৎসকের দীর্ঘ পথ চলা কেমন ছিলো।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশের পর ১৯৯৩ সালে বিসিএসের মাধ্যমে স্বাস্থ্য ক্যাডারে যোগ দেন কামরুল ইসলাম।
১৯৯৫ সালে এফসিপিএস এবং ২০০০ সালে বিএসএমএমইউ থেকে ইউরোলজিতে এমএস ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০৩ সালে ইংল্যান্ডের রয়েল কলেজ থেকে তিনি এফআরসিএস ডিগ্রি অর্জন করেন।
তিনি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক হিসাবেও কর্মরত ছিলেন। তবে নিজেই কখনো কিডনি প্রতিস্থাপন করবেন সেটা ভাবেননি কখনো, কারণ কাজটা ছিলো বেশ কঠিন।
ড. কামরুল বলেন, “কিডনি প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে দীর্ঘসময় ধরে অপারেশন করতে হয়, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই শেষ পর্যন্ত সফলতা আসেনা, তাই এতা রিস্কি জবে যাবো আমার ধারণা ছিলোনা। কিন্তু এই কাজটা ইউরোলজিস্টদের। তাই এ থেকে নিস্তার সম্ভব ছিলোনা। এই পরিস্থিতিতে ২০০১ সালে কিডনি প্রতিস্থাপন সার্জারিতেই আমার পোস্টিং হয়। আর ঘাড়ে যখন এই জোয়াল পড়ল যে এই কাজটা করতেই হবে তখন মাথায় চিন্তা ঢুকলো যে আমরা যদি না করি তাহলে কে করবে।”
এরপর আর পিছপা হননি বলে জানান এই চিকিৎসক। পুরো প্রক্রিয়াটাকে কয়েকটি ধাপে ভাগ করে নিয়েছিলেন ড. কামরুল। প্রথমত জ্ঞান অর্জন। অর্থাৎ যেই কাজটা তিনি করতে চলেছেন তার সম্পর্কে পড়াশোনা করে সব ধরণের জ্ঞান অর্জন।
তিনি বলেন, “ছোটবেলা থেকেই পড়ুয়া ছিলাম তাই, পড়াকে ভয় পেতাম না। প্রথমেই কিডনি প্রতিস্থাপন বিষয়ক বড় বড় দুটি বই নিলাম এবং সেগুলো পড়ে ফেললাম।”
এরপরের ধাপে ট্রেনিং করেন এই চিকিৎসক। প্রতিবেশি দেশ ভারত ও পাকিস্তানের বড় বড় যেসব হাসপাতালে কিডনি প্রতিস্থাপন হয় সেসব হাসপাতালে ট্রেনিং নেন তিনি। এবং এরপরেই কাজটা করতে পারবেন বলে আত্মবিশ্বাস জন্মায় তার।
এরপরের ধাপ হল কাজটা করা। জটিল এই কাজ করতে গিয়েও সেটিকে কয়েক ধাপে ভাগ করে নেন ড. কামরুল।
তিনি বলেন, ”কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রথম ধাপ হল কিডনি ডোনার থেকে কিডনি উঠানো, এরপর ফ্লুইড দিয়ে সেটি ওয়াশ করা, এরপর ভেইন এবং ইউরেটর লাগাতে হবে এরপর সেটি প্রতিস্থাপন করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতিটি ধাপ করার পর সেটি ঠিকঠাক কাজ করছে কিনা সেটি পরীক্ষা করতাম।”
এভাবে প্রতিটি ধাপ যখন সফলভাবে করা সম্ভব হয় তখন পুরো প্রক্রিয়াকে একসাথে করা শুরু করেন এই চিকিৎসক। আর এজন্য সিনিয়র চিকিৎসকদের সহায়তা নিয়ে পুরো কাজ করতেন তিনি।
২০০৭ সালে প্রথমবারের মতো সফলভাবে কিডনি প্রতিস্থাপন করেন এই চিকিৎসক। তবে এটি ব্যববহুল অপারেশন হওয়ায় হতদরিদ্রদের জন্য বিনাপয়সায় এই কাজ করার জন্য অনেক বাধাও পেরোতে হয় তাকে।
তিনি বলেন, “কিডনি প্রতিস্থাপনের সময় কিডনি প্রিজার্ভ করার জন্য একটি সলুশন প্রয়োজন , যেটি বিদেশ থেকে আনতে ২০ হাজার টাকা খরচ হয়। কিন্তু এতো টাকা কোথায়! তাই ওই সলুশনের কম্পোজিশন জেনে নিয়ে সেটি নিজেই বানিয়ে ফেললাম। এতে খরচ পড়ল পাঁচ থেকে ছয়শ টাকা। এভাবে সব খরচ কমিয়ে আনার চেষ্টা করেছি।”
ড. কামরুলের বানানো সেই সল্যুশন শেষ পর্যন্ত সফলভাবে কাজ করেছে এবং এখনও তিনি অপারেশনে সেটি ব্যবহার করেন।
তিনি বলেন, “প্রথম দিকে মাসে একটা করে অপারেশন করতাম, তবে যখন একে একে সফলতা আসতে লাগলো তখন থেকে বাড়তে শুরু করে অপারেশনের সংখ্যা। আর আমাদের দেশে বহু মানুষ টাকার অভাবে কিডনি প্রতিস্থাপন করতে পারেন না, ডায়ালায়সিস করতে করতেই তারা মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যান।”
এই পরিস্থিতিতে বিনাপয়সার কিডনি প্রতিস্থাপন শুরু করেন তিনি, এবং এখন পর্যন্ত ১৬শ মানুষের কিডনি প্রতিস্থাপন বিনাপয়সায় করেছেন তিনি।
২০০৭ সাথে প্রথম সফল প্রতিস্থাপনের পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি ড. কামরুলকে।
জাতীয় কিডনি ইন্সটিটিউটে সহকারী অধ্যাপক থাকাকালে ২০১১ সালে সরকারি চাকরি ছেড়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন সিকেডি হাসপাতাল। ২০১৪ সালে শ্যামলীতে প্রতিষ্ঠা করেন সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি।
চিকিৎসা বিদ্যায় অবদান রাখার জন্য ২০২২ সালে তিনি স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন।
কামরুল ইসলামের পিতা আমিনুল ইসলাম ছিলেন পাবনার ইক্ষু গবেষণা কেন্দ্রের রনোমিস্ট। আর মা রহিমা খাতুন ছিলেন অধ্যাপক। চার ভাই-বোনের মধ্যে কামরুল ছিলেন দ্বিতীয়।
১৯৮০ সালে তিনি পাবনার চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন এবং মেধা তালিকায় রাজশাহী বিভাগে ১৫তম স্থান অর্জন করেন। এরপর তিনি ঢাকা কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ১৯৮২ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ১০ম স্থান অর্জন করেন।
কামরুল ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের কে ৪০তম ব্যাচের শিক্ষার্থী, ১৯৯০ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে ৮টি মেডিকেল কলেজের সম্মিলিত ভর্তি পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান অর্জন করে স্বর্ণপদকসহ এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করেন।ে
এসবি/