ঢাকা, সোমবার   ০৭ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

একাত্তরের সমমর্মিতা ফিরিয়ে আনতে হবে

নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু

প্রকাশিত : ১১:৪২, ২৮ মার্চ ২০২১

Ekushey Television Ltd.

২৮ মার্চ ১৯৭১। আমরা কেরানীগঞ্জে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করি। ২ এপ্রিল ভোরে ঘুম ভাঙল গুলির আওয়াজে। হানাদার বাহিনী আমাদের ক্যাম্পটির কথা জেনে গেছে। মাদ্রাসার মাঠে পজিশন নিয়েছে ওরা। খালের ওপারে শালবনের ফাঁক দিয়ে দেখলাম চারদিক থেকে গুলি করছে ওরা। মানুষ প্রাণভয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছে। এলএমজি ফায়ার করার সাথে সাথে হাজার হাজার মানুষ লুটিয়ে পড়ল। যারা তখনো মারা যায়নি, তাদের গায়ে পাকিস্তানিরা আগুন লাগিয়ে দিল। সেদিন এমনও দেখেছি, একজন মানুষ দৌড়াচ্ছে, তার কানে গুলি লেগে মাথাটা ছুটে গেল। লোকটা দু-তিন পা এগিয়ে ঢলে পড়ল। এমনই ছিল একাত্তরের গণহত্যা।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিশ্ব ইতিহাসে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাঙালি রাজনৈতিকভাবে প্রথম সচেতন হয়েছে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময়। ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিটি এসেছিল স্বদেশি আন্দোলনকে কেন্দ্র করে, ১৯০৬ সালে। তারপরের ইতিহাস করুণ, রক্তাক্ত ও বিশ্বাসঘাতকতায় পূর্ণ। 

স্বাধীনতার নামে ভারতবর্ষকে ভাগ করা হলো। বিশ্ব-ইতিহাসে এরকম ট্র্যাজিক ঘটনা দ্বিতীয়টি নেই। রাতের অন্ধকারে বসে বাঙালি জাতিকে ভাগ করা হলো ধর্মের ভিত্তিতে। ১৯৭১ সালে আগরতলা যাওয়ার সময় দেখেছি, একই বাড়ির শোয়ার ঘর পড়েছে পূর্ব পাকিস্তানে আর রান্নাঘরটা ভারতে। মায়ের ঘর পূর্ব বাংলায়, ছেলের ঘর ত্রিপুরায়। এর চেয়েও বড় ট্র্যাজেডি হলো দাঙ্গায় লক্ষ লক্ষ লোকের মৃত্যু। 

পাকিস্তানের শাসকশ্রেণির ভাষা ছিল উর্দু। ১৯৪৭-এর আগে শাসকদের ভাষা ছিল ইংরেজি। তারও আগে ফারসি। সংগত কারণেই ১১ মার্চ ১৯৪৮ জিন্নাহ ঢাকায় এসে বললেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। বাঙালি বলল, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদের জন্ম হলো, যা বাঙালি জীবনে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। আমি মনে করি, মুক্তিযুদ্ধের চেয়েও বড়। কারণ ভাষাটা যদি সেদিন না বাঁচত, আজকের বাংলাদেশ হতো না।

বাংলা ভাষার প্রতি সেদিনের যে আগ্রাসন, তার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা তীব্র সাংস্কৃতিক আন্দোলন প্রমাণ করল বাঙালি স্বতন্ত্র জাতি। তার ইতিহাস হাজার বছরের। এই ভূখণ্ড আমাদের। আমরা নিজস্ব রাষ্ট্র চাই। অর্থাৎ সাংস্কৃতিক আন্দোলন ক্রমশ রূপ নিল জাতীয় রাজনৈতিক আন্দোলনে। সত্তরের নির্বাচনের পর ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিটি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু বাঙালির হাতে ক্ষমতা দেয়া হলো না। ঘনিয়ে এলো ২৫শে মার্চ।

সে-রাতে ঢাকার শান্তিনগরের একটি বাড়ির ছাদ থেকে দেখলাম পাক আর্মির তাণ্ডব। মনে হচ্ছিল পুরো ঢাকা শহর যেন জ্বলছে। গান পাউডার ও কামানের গোলায় চলল ব্যাপক ধ্বংসলীলা। আসলে ২৫ মার্চের আগে আমরা ভেবেছিলাম স্লোগান দিয়ে মিছিল করে কিছু একটা করে ফেলব। কিন্তু পাকিস্তানের মতো নিপীড়ক রাষ্ট্রের হিংস্র সেনাবাহিনীর কাছে দয়া-মায়া প্রত্যাশা করা ভুল।

২৬ মার্চ ভোরে দেখেছি, লাশ টেনে টেনে ট্রাকে তোলা হচ্ছে। রাজারবাগে কাঁটাতারের ওপর নিহত পুলিশ ভাইদের লাশ ঝুলছিল। শরীর থেকে হাত-পা আলাদা। আগের রাতে অবশ্য কিছু পুলিশ পালিয়ে আমাদের এলাকায় আসতে পেরেছিল। তাদের কাছ থেকে পেয়েছিলাম সাতটা রাইফেল ও গুলি। শহরে তখন কারফিউ। বিদ্যুৎ-পানি নেই, টেলিফোনের লাইন বিচ্ছিন্ন। 

২৭ মার্চ চার ঘণ্টার জন্যে কারফিউ তুলে দিলে বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম। গিয়ে মাথা খারাপ হয়ে গেল। জগন্নাথ হল থেকে নীলক্ষেত— পুরো এলাকায় লাশ আর লাশ! দ্রুত ফিরে এসে অস্ত্রগুলো বের করে সোজা সদরঘাট। কোথায় যাচ্ছি জানি না। জিঞ্জিরায় পৌঁছে দেখি, লক্ষ লক্ষ মানুষ ওখানে আশ্রয় নিয়েছে।

তখন মানুষ নিজে না খেয়ে অচেনা অসহায় মানুষকে খাইয়েছে। শহর, গ্রাম কোথাও খাবার পেতে মুক্তিযোদ্ধাদের অসুবিধা হয়নি। সাভার, ধামরাই, কেরানীগঞ্জের দিকে দেখেছি— মাঝিরা মাছ ধরে ফেরার সময় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে কিছুটা রেখে যেত। গ্রামের কৃষক সবজি দিয়ে যেত। সেদিন সবাই একে অন্যের দিকে মমতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। 

একটা ঘটনা বলি। কেরানীগঞ্জে এক কৃষকের বেড়ার ঘরে আমরা অস্ত্র রাখতাম। একদিন ওখানে গিয়েছি গ্রেনেড নিতে। আমি গ্রেনেডের পিন খুলে বাড়ির ছোট্ট ছেলেটিকে দিচ্ছি, সে শুকাতে দিচ্ছে। ওর সাথে কথা বলতে বলতে বেখেয়ালে হঠাৎ পিন খুলে লিভারটা ছেড়ে দিয়েছি। ভুল টের পেতেই গ্রেনেডটা দু-হাতের তালু দিয়ে চেপে ধরলাম। ছেলেটা লাফিয়ে বাইরে চলে গেল। আমি মৃত্যুর অপেক্ষায় বসে ঘামছি। 

কিন্তু ফাটল না! গ্রেনেড খুলে দেখি, ভেতরে একটা পানির বিন্দু থাকায় প্রাণে বেঁচে গেছি। দুপুরবেলা খেতে বসে দেখি, মাটির থালায় দুধ-ভাত। আমি তো অবাক। 

কৃষকের স্ত্রী বললেন, আপনি বেঁচে গেছেন বলে মসজিদে শিন্নি দিয়েছি! অথচ আমি তাদের কেউ না। ৪৫ বছরে একবার দেখা হয়েছে। আর হয়তো হবেও না। একাত্তরের সম্পর্কটা এমনই। যা কোনোকিছু দিয়েই পরিমাপ করা যাবে না। 

তাই সেদিন যে আদর্শ, চেতনা ও মানুষে মানুষে মমতা-ভালবাসা ছিল তা হৃদয়ে অনুভব করতে হবে। কারণ বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি পৃথিবীতে এসেছে অস্ত্র ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে। একাত্তরের আদর্শ ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগালে ধর্মবর্ণনির্বিশেষে সবার জন্যে সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।

নতুন প্রজন্মকে নিয়ে আমি তাই আশাবাদী। থিয়েটারের কাজে কিছুদিন আগে গিয়েছিলাম যমুনার চরে। পুরোটা পথ হেঁটে যেতে হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধা এসেছে শুনে সেখানকার শিশুরা পতাকা হাতে হাজির। তারা মুক্তিযুদ্ধের কতটুকুই-বা বোঝে! কিন্তু এই সরলতা ও মমতা এখনো আছে বলেই বাঙালি আবার ঘুরে দাঁড়াবে। তরুণ প্রজন্ম সেই কাজটি পারবে বলে আমার বিশ্বাস।

সূত্র: মুক্ত আলোচনা, ০১ ডিসেম্বর ২০১৬

এএইচ/


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি