একাত্ববাদ প্রতিষ্ঠায় অটল ছিলেন ইব্রাহীম (আ.)
প্রকাশিত : ১৬:২১, ২৭ নভেম্বর ২০১৯ | আপডেট: ১৬:২২, ২৭ নভেম্বর ২০১৯
হযরত ইব্রাহীম (আ:) আল্লাহ প্রদত্ত বিভিন্ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। আল্লাহর এক দুশমন নমরুদের শাসনকালে ইব্রাহীম (আ:) এক আজর পরিবারে জন্ম গ্রহণ করে একের পর এক পরীক্ষার সম্মুখীন হতে থাকেন। সব পরীক্ষায় সফলকাম হয়ে আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করতে থাকলেন। আর আল্লাহপাক তাকে বেছে নিলেন নবী হিসেবে।
ইব্রাহীম (আ.) যখন শিশু তখন তাঁর পিতামাতাকে দেখতেন অন্যদের মতো মূর্তি পূজা করতে। এ ব্যাপারে তাঁর অনেক প্রশ্ন ছিল, ছিল অশেষ আপত্তিও। ইব্রাহীম (আ.) বলতে থাকেন- বিশ্বজাহানের স্রষ্টা একমাত্র আল্লাহপাক, তিনিই সব মানুষের রব এবং তিনিই সব ক্ষমতার মালিক। তাই মানুষ কেন মাটির গড়া মূর্তির দাসত্ব করবে? একমাত্র আল্লাহরই দাসত্ব করতে হবে, তাঁর সামনেই মাথানত করতে হবে।
ইব্রাহীম (আ.) এর এই বিপ্লবী চেতনা নমরুদের রাজত্বে কাঁপুনী সৃষ্টি করে। নমরুদের দরবারে ইব্রাহীম (আ.) নিয়ে আলোচনা হতে থাকে। এরই মধ্যে ইব্রাহীম নমরুদের পূজাখানার মূর্তিগুলো ভেঙ্গে কুড়ালটি বড়মূর্তি কাঁদে ঝুলিয়ে রাখে। এই ব্যাপারটি সবার কানে পৌঁছে যায় মুহূর্তেই। বাদশাহ নমরুদ শুনে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে। ইব্রাহীম (আ.)কে রাজ দরবারে ধরে নিয়ে আসা হয়। নমরুদ তাঁর কাছে জানতে চান, কেন সে মূর্তিগুলো ভেঙ্গেছে?
ইব্রাহীম (আ.) উল্টা প্রশ্ন করেন নমরুদকে। যে মূর্তিটার কাঁদে কুড়াল ঝুলানো আছে তার কাছে জিজ্ঞেস করো, কে মূর্তিগুলোকে ভেঙ্গেছে? নমরুদ রাগত স্বরে বললো মূর্তি কি কথা বলতে পারে? ইব্রাহিম (আ.) তখন বললেন, যে দেবতা কথা বলতে পারে না, সে তোমাদের প্রভু হয় কিভাবে? তাঁর এ উক্তি নমরুদের কলিজায় চরম আঘাত হানে। সে ভাবতে থাকে যে করেই হোক ইব্রাহীমকে শেষ করতে হবে। নমরুদ ঠিক করল ইব্রাহীম (আ.) আগুনে পুড়িয়ে মারার।
নমরুদ ঘোষণা দিল, আগুনের বিরাট কুণ্ডলী পাকিয়ে সেখানে ইব্রাহীমকে ফেলে দিয়ে ছাই করে দেওয়া হোক। তখন তার সৈন্যসামন্ত দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বিপুল পরিমাণে জ্বালানী সংগ্রহ করে আগুন জ্বালানো শুরু করল। দীর্ঘ ৪০ দিন ধরে আগুন জ্বালিয়ে শিখার প্রজ্জ্বলন করল। পরের দিন মহা ধুমধাম করে ইব্রাহীম (আ.)কে সেই প্রজ্জ্বলিত উত্তপ্ত আগুনে নিক্ষেপ করার ঘোষণা দিল নমরুদ।
সারাদেশের উৎসুক জনতা পরদিন এসে অগ্নিকুণ্ডের চারিদিকে জড় হলো। একদিকে আনন্দ আর অন্যদিকে সবাই যেন বিশেষ এক আতঙ্কে ভুগছে। কিন্তু ইব্রাহীম (আ.) মোটেই ভীত হলেন না। নির্বিঘ্নে সে আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে আল্লাহর গুণগানে লিপ্ত। এ সময়ে জিব্রাইল ফিরিস্তা এসে ইব্রাহীম (আ.)কে বলতে লাগলো- আগুন থেকে আপনাকে বাঁচাতে আমি সাহায্য করতে এসেছি। ইব্রাহীম (আ.) তার জবাবে পরিষ্কার ভাষায় বলে দিলেন ‘আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। যে আল্লাহর একত্ববাদের তালাশের জন্য আজ আমাকে আগুনে ফেলা হচ্ছে সেই আল্লাহই সবকিছু দেখছেন। আল্লাহ চাইলে তিনিই আমাকে রক্ষা করতে পারেন। আমাকে আগুনে জ্বালিয়ে মেরে ফেললে আল্লাহ যদি রাজি থাকেন তাতেই আমি রাজি।’
ইব্রাহীম (আ.) এর এই যুক্তির কাছে জিব্রাইল ফিরিস্তা হেরে গেলেন। যথাসময়ে ইব্রাহীমকে আগুনে ফেলার সমস্ত প্রস্তুতি শেষ হলো। আগুনের কুণ্ডলীর চারিদিকে সারা দেশের শিশুকিশোর যুবক বৃদ্ধ নারী পুরুষ সবাই এসে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কখন কিভাবে ইব্রাহীম (আ.)কে পোড়ানো হবে তা দেখতে। নমরুদের মন্ত্রী পরিষদ, সেনা-সৈন্য সবাই অপূর্ব আনন্দ উল্লাসে শোরগোল করে চলেছে। এক সময় ইব্রাহীম (আ.)কে আগুনের মাঝখানে ফেলে দিল। একই সঙ্গে সব মূর্র্তিপূজারীরা মহা চিৎকার দিয়ে চরম আনন্দ প্রকাশ করল।
সবাই তাকিয়ে দেখছে ইব্রাহীম (আ.) তো পুড়ছে না! যে আগুন সবকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছার খার করে দেয়, সে আগুন ইব্রাহীম (আ.) এর জন্য শান্তির বাগান হয়ে গেল। তিনি লেলিহান শিখার ভেতর দিয়ে আনন্দের হাসি হেসে হেঁটে চলছেন। এটাই আল্লাহর সার্বভৌমত্ব। ইব্রাহীম (আ.)’র এই পরীক্ষার বিজয় দিয়ে আল্লাহ মহাশক্তি দেখালেন।
পবিত্র কুরআনে এই প্রসঙ্গে আল্লাহর ঘোষণা হলো- ‘হে আগুন। তুমি ইব্রাহীমের জন্য শীতল ও শান্তিময় হয়ে যাও’। (সুরা আম্বিয়া, ৬৯)। নমরুদ সহ অগণিত মানুষ দেখলো, ইব্রাহীম (আ.) কিভাবে আগুনের শিখার উপর দাঁড়িয়া আছেন। সেদিন ইব্রাহীম (আ.)’র একত্ববাদের মহাবিজয় হল। আর নমরূদের শিরকবাদীর দম্ভ ও অহঙ্কার ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।
আল্লাহ আরেকবার পরীক্ষা নিয়েছিলেন ইব্রাহীম (আ:) এর। একমাত্র সন্তান ইসমাঈল (আ:)কে কুরবানীর আদেশ দিয়ে। সে পরীক্ষায় তিনি সফলকাম হয়েছিলেন। আল্লাহর কথামত বিবি হাজেরা ও শিশু ইসমাঈল (আ:)কে মরুভূমিতে রেখে আসার পরীক্ষাতেও আল্লাহর প্রেমের প্রমাণ দেন ইব্রাহীম (আ:)। আল্লাহর পক্ষ থেকে নেয়া এসব পরীক্ষায় ইব্রাহীম (আ:) উত্তীর্ণ হয়ে উঠেন বলেই ইব্রাহীম (আ:)কে মুসলিম জাতির পিতার সনদ দেওয়া হয়েছে।
নানা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ইব্রাহীম (আ:) প্রমাণ দিলেন যে, বিশ্বজাহানের একক প্রভু একমাত্র আল্লাহ। আল্লাহই সব মানুষের মালিক, তিনিই সব ক্ষমতার অধিকারী। একমাত্র তাঁরই দাসত্ব আর আনুগত্য করতে হবে।
এএইচ/