ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪

একুশের একুশে পা

আহমেদ মুশফিকা নাজনীন

প্রকাশিত : ২২:৪৩, ১৩ এপ্রিল ২০২০ | আপডেট: ০৯:৪২, ১৪ এপ্রিল ২০২০

সকাল থেকে সন্ধ্যা। ৯ তলা থেকে ৭ তলা। কয়েক মাস ধরে চলে দফায় দফায় মিটিং। সফল করতে হবে পহেলা বৈশাখ আর একুশের জন্মদিন। কত পরিকল্পনা, কত আবেগ। এর মাঝে চলছে সাদা শাড়ির খোঁজ। লাল টিপ বাসায় আছে তো। মনে পরছে না। সারাদেশে চিঠি আর কার্ড পাঠাতে হবে। ৭০ জেলা উপজেলা ব্যস্ত জন্মদিন নিয়ে। কিছু পরে পরে ফোন, আপা দাওয়াত দেয়া শেষ। সব রেডি, অতিথিরা সবাই আসবে। ব্যানার কেক সব হয়ে গেছে। 

অফিসে চলছে শেষ মুহূর্তের সাজ। দেয়ালে পরছে রং তুলির আঁচর। নানা রঙের বেলুন দিয়ে সাজানো হচ্ছে অফিস। ৭ তলা থেকে ১০ তলা সব জায়গায় ব্যস্ততা। সময় নেই কারো সময় নষ্ট করবার। সব কাজ চলছে হাসিমুখে। লাইট সাউন্ড বারবার চেক করছে সব ঠিক আছে তো? রাত ১২টা ১ মিনিটে কেক কাটা হবে। সব হতে হবে নিখুঁত। অনুষ্ঠান বিভাগের চাপটা যেন অনেক বেশি। বারবার চেক করছে তারা সবকিছু। এনসিএ অনলাইন বসেছে মিটিংয়ে, নিউজ কতটা প্রাণবন্ত করা যায়। গ্রাফিক্স বিভাগ কী সুন্দর সব ডিজাইন করেছে। মুগ্ধতা ছড়িয়ে পরে তা দেখে। সারাদিন রাত চলছে একটানা কাজ। ক্লান্ত শরীর তবে মন কিন্তু ক্লান্ত নয় কারো।  মার্কেটিং টিম জানায় আসছে মুড়ি মুড়কি নাড়ু, মোয়া। রঙিন ডালায় সব হাজির।

রাত পোহালেই যে পহেলা বৈশাখ। আর একুশের পাল তুলে...প্রিয় একুশের জন্মদিন। 


গত বছরে একুশের জন্মদিনে একুশে পরিবার

রাত ১২ টা ১ মিনিটে কেক কেটে গভীর রাতে বাসায় ফেরা। মনে তখন গুণগুণ করে বাজছে এসো হে বৈশাখ এসো এসো। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই ছুটে যাওয়া রমনায় ছায়ানটের অনুষ্ঠানে। লাল সাদা রঙে রমনার বটমুল তখন রঙিন। শিশুদের নরম গালে পহেলা বৈশাখ। কিশোরীর খোলা চুলে সাদা রঙের বেলী। তরুণ আর বৃদ্ধ পুরুষ সাদা পাঞ্জাবিতে বড়ই পবিত্র।

বাঁশির রাগের সুরে সূর্য উঠে। চোখ তখন ক্যামেরার দিকে। সুর আর সূর্য একসাথে পেয়েছি তো। ক্যামেরাম্যান আত্মবিশ্বাসের হাসি হাসেন। পেয়েছি। বিশ্ব তখন তার হাতের মুঠোয়। দেখা হয় কত কত প্রিয় মানুষের সাথে। ডলি আপা, জড়িয়ে ধরে জানান দেয়, আছি আমরা একসাথে। বাতাসে তখন ভেসে বেড়ায় ছায়ানটের শিল্পীদের গাওয়া অপার্থিব সব সুর। ভাসে সনজিদা আপার শুদ্ধ উচ্চারণে বৈশাখী কথন। 


গত বছরে একুশের জন্মদিনে

ওদিকে তখন বের হচ্ছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। যা কিছু অশুভ তা দূর করে মঙ্গল আসুক বাংলা ও বাঙালীর জীবনে। জনতার ঢলে তখন নানা রঙ-বেরঙের পেঁচা, হাতি বাঘ, ময়ুর মাথা উঁচিয়ে চলে। ছোট্ট শিশু বাবার কাঁধে চড়ে মুগ্ধ চোখে দেখে নাগরিক উৎসব। মার হাতে ঢোল। নানা রঙের শাড়ি আর পাঞ্জাবিতে রাস্তায় তখন বসন্ত। ফাঁকে ফাঁকে চলছে চড়া দামে পান্তা ইলিশ খাওয়া। কোথাও কোথাও আম ভর্তা, পাশে নাগরদোলার ক্যাচক্যাচ আওয়াজ। রোদ, গরম বাতাস, জ্যাম, রিক্সার শব্দ, গাড়ির হর্ণ, এর মাঝে  ভেসে আসে বাঁশির করুণ সুর! আনমনা মন ছুটে যায় দূরে থাকা বাবা মার কাছে। 

মন কেমন করা সময়ে অফিসে তখন চলছে কেক কাটা। অতিথিদের শুভেচ্ছায় সিক্ত একুশে পরিবার। মোহসিনা আপা, লিসা আপা, শতরুপা, শাম্মি, রাইসা, সবুজ, সিফাত, রাশেদ, আলামিনের সময় নেই কোনদিকে তাকাবার। ফুলে ফুলে ঢেকে গেছে সারা অফিস। ছোট বড় সবাই মিলেছে উৎসবের আমেজে। 

টুকরো টুকরো কথা, প্রাণখোলা হাসি, মুড়ি মোয়া, মিষ্টি কেক আইসক্রিমে জমে যায় একুশের জন্মদিন।


জন্মদিনে একুশে পরিবার

প্যাকেজ বানিয়ে ছুটি। এবার শুধুইই হৈ হৈ করে ছবি তোলা, হেসে ওঠা আর বৈশাখি স্রোতে ভেসে যাওয়া। ভিডিও এডিটররা কাজ করতে করতে ক্লান্ত। সময় পায় না তারা ছবি তুলবার। সমরদা, রত্না,  দুলি, নীলা, শ্রাবন্ত তখন ব্যস্ত সারাদেশ নিয়ে। তাদের পিসি ভরা বৈশাখি আর একুশের জন্মদিনের খবরে। সিরাজগঞ্জের স্বপন মির্জার জন্মদিন পালনের খবর সবার মুখে মুখে। সাভারের নাজমুল ভাই পাঠান হরেক রকম ফুল। ম্যাসেঞ্জারে তখন শুভেচ্ছা অফুরান। 

কাজের ফাঁকে ফাঁকে একা একা, কখনো দোকলা, কখনো শাকেরা, জসিম, প্রণব, তৌহিদ, শাওন, মফিউর, ইমন, সাবরিনা, স্মৃতির সাথে দলবেঁধে ছবি তোলা।  ছবি তুলে সাথে সাথেই আপলোড। প্রডাকশনের হাবিব, শুভ, শুভ্র, শায়ন্ত থাকে নিউজ নিয়ে ব্যস্ত। মেকআপ রুমে প্রচন্ড ভীড়। সাজছে সবাই মাধুরী মিশিয়ে। দুপুরে একসাথে বসে খাওয়া। কোক ফান্টার চাইতে মন খোঁজে ঠান্ডা লেবুর শরবত। মন পোড়ে ফালগুনী, পায়েল, এলভিস, তৃষা, রুবিনা, এ্যানির জন্য।

এরমাঝে বাসা থেকে ফোন, আসবে কখন? একটু অপরাধবোধ নিয়ে সন্ধ্যায় ফিরে আসা বাসায়। কোন বৈশাখেই সময় দেয়া হয় না তাদের। মেনে নিয়েছে তারা এমন ব্যস্ততা হাসিমুখেই। আত্মার আত্মীয়রা বুঝি এমনই হয়। কোন অভিযোগ নেই, শুধুই নিরবে পাশে থাকা।

২০২০ সাল। সব স্তব্ধ। নেই কোনো মিটিং। নেই ব্যস্ততা, নেই কোনো তাড়া। লাল সাদা শাড়ির খোঁজে একদিনও যাওয়া হয় না বেইলী রোডে। একবারও মনে হয়নি কী পরবো এই বৈশাখে, একুশের জন্মদিনে। লাল টিপের পাতা ড্রেসিং টেবিলের উপর ধূসর হয়। 

গত ১০ বছরে এই প্রথম বাসায় বৈশাখ আর একুশের জন্মদিন পালন। করোনার কারণে লকডাউনে। চারিদিকে শুনশান নিরবতা। মৃত্যুর নিঃশব্দ পদচারণা। কোথায় গিয়ে থামে সে কে জানে। ফেসবুক খুললেই মনখারাপ করা সব খবর। 

একুশের আজ একুশে পদার্পণ। কত স্বপ্ন নিয়ে পথচলা একুশের। একুশ মানে মাথা নত না করা। একুশ মানে অহংকার। পরিবর্তনে অঙ্গীকারাবদ্ধ স্লোগান নিয়ে যে একুশ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল। তার মাথা যেন সবসময় উঁচুই থাকে। এই যাত্রার শুভ নব চেতনায় একুশের পাল তুলে একুশ এগিয়ে যাক দৃপ্ত পায়ে সামনে আরও সামনে। দশ দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ুক একুশের চেতনা।

এমবি//


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি