এবং জোঁক ও সাপ
প্রকাশিত : ১৩:৪৮, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২০ | আপডেট: ১৪:৫২, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২০
জোঁক ও সাপ পার্বত্য চট্রগ্রামে শান্তি বাহিনী এবং ম্যালেরিয়ার মতো অতটা প্রাণঘাতী না হলেও ওদের উপস্থিতি জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। ধরুণ এই জোঁককে যদি পাহাড়ে আমাদের অন্যতম শত্রু বলি যিনি পাহাড় দেখেননি তিনি কেমন করে বুঝবেন।
‘পাহাড় দেখিনি?’ আরে মশাই কি সব বলেন! নীলগিরি, সাজেক, সুভলং, রাঙামাটি ঝুলন্ত ব্রীজ আমি এত এতবার দেখেছি! এ রকম বাক্যবাণ আপনার বন্ধু পরিচিতি জনের অনেকের কাছ থেকে শুনে থাকবেন। কিন্ত ক্যামেরার লেন্সে পাহাড় দেখা, রাজকর্মচারীদের হাতির পিঠে পাহাড় দেখা আর সৈনিকের পাহাড়ের জীবন এক বিষয় নয়।
যেমন ধরুন জোকের বিষয়টি। ইন্চি খানেক লম্বা এই পিচ্ছল জীবটি আপনার উপস্থিতি টের পেয়ে যেভাবে ভেজা পাতার নীচ থেকে তার আমূল শরীরটাকে দোলাবে তা কিন্তু অশ্লীল মনে হবে। প্রথম প্রেমের উন্মাদনায় যৌনকাতর পুরুষ যেমন প্রেমিকার শারীরিক উপস্থিতি টের পেয়ে কাছে আসতে চায় এই পিচ্ছল ঔ জীবটিও তাই। বাতাসে ভেসে আসা নারীর গায়ের ঘ্রাণ আর চুলের সুবাস নিয়ে কত সব কবি গায়েনরা কাব্য করেছেন, এই আপাত কুৎসিত জীবটিও ঘর্মাক্ত সৈনিকের লোনাজলের গন্ধে একেবার হয়ে যায় বেসামাল।
নারীর হরমোন নিশ্রিত ঘামের সাথে পুরুষের নাসারন্ধ্রের যে কামাশ্রিত মেলবন্ধন। মানুষের সাথে জোঁকেরও তাই। পাশ দিয়ে যাওয়া নারীর গন্ধ যেমন পুরুষকে সচকিত করে তুলে এই জীবটিও টহল দলের প্রথম সৈনিকের পথ চলতে বাতাসে রেখে য়াওয়া ঘ্রাণ বা লতা পাতার সাথে শরীরের ঘর্ষণে সৃষ্ট আন্দোলনে বেশরম হয়ে উঠে। প্রথম সুযোগেই শারীরিক সমপর্ক করতে চায়। প্রথম সুযোগেই সে আপনাকে চুম্বন করবে নরম উষ্ণ কোন জায়গায়।
শালীনতার জন্য নারীর নরম উষ্ণ জায়গাগুলির বিশদ বর্ণনা করা যাচ্ছে না। তবে এই বেশরম জীবটির জন্য পছন্দ সৈনিকের গলা, বুকের মাংসল অংশ, রক্তবাহী ধমনী, পিঠ, পেট, কোমরবন্ধনীর নীচের অংশ, নাভিমূল,,,, নাহ আর নীচে যাওয়া যায় না।
তবে বেটা যদি নাভিমূল ক্রশ করে আরও গভীরে যায় তবে ‘তার’ ক্ষয় ক্ষতি দেখে আপনার অক্কা যাওয়ার মতে অবস্থা হবে।
পুরুষের সকল শৌর্যের সম্মানের ‘প্রতীক’কে অধিকতর রক্তক্ষরণ থেকে বাচাঁতে তাৎক্ষণিক দিগম্বর হয়ে সিগারেটের ছ্যাঁকা বা ম্যাচের কাঠির অগ্নিদহন সহ্য করতেও দ্বিধা করবে না। ধর্ষিত নারী যেমন প্রকাশ্যে তার ধর্ষণের কথা স্বীকার করে না জোঁকের দ্বারা পৌরুষত্বে আঘাত পাওয়ার কথাও কোন সৈনিক প্রকাশ করেন না।
দেখলেন তো পুরুষের নষ্ট চরিত্র আর জোঁকের মধ্যে কত মিল। ‘জোঁকের মত প্রেম’ এই প্রবাদ তো আর এমনি এমনি তৈরি হয়নি। প্রথম চুম্বনে এই প্রাণীটি ব্যবহার করে মুখনিঃসৃত লালা যা একটা লোকাল এনেস্থিসিয়া হিসাবে কাজ করে। দক্ষ নার্সের মতো ঠিকই খুঁজে পায় সৈনিকের রক্তবাহী শিরার অবস্থান। তার নিঃশব্দ চুম্বনের সময় দন্তের আঘাত ব্যথাহীন। শিরার উপর ফানেলের মত বসে যায় তার মুখ। তারপর ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের মতো চুষতে থাকে আপনার রক্ত। এই চোষণের জন্য তাকে কোন শক্তি ব্যয় করতে হয় না। হৃদ স্পন্দনের সাথে সাথে রক্তের যে চাপ হয় সে চাপেই ভরতে থাকে ওর উদর।
শত্রুজনিত নানা উৎকন্ঠা, পথের নানা বিপওি, রাতের আঁধার ইত্যাদি নানা কারণে সৈনিক থাকে বিমগ্ন। তাই অধিকাংশ সময়ে সৈনিকরা টেরই পায় না কখন কোথায় এই পিচ্ছিল জীবটি তার শরীরের সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে। আর ওটা না দেখাই ভালো। চিকন তারের মতো বস্তটি যখন ক্রমাগত রক্ত চুষে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আবজাল-মিঠুদের মত মোটা হয়ে ঝরে পরে তখনই কেবল বোঝা যায় ও কতটুকু রক্ত পান করেছে। এরা নিজ থেকে রক্ত পানে বিরত না হলে এদের রক্ত চোষণ থেকে রক্ষা নেই।
কর্মস্থলে সাপ হাতে লেখক
দুদকের মতো হাত দিয়ে যতই টানাটানি করেন না কেন ওর পিচ্ছল দেহকে রক্তের নেশা থেকে বিরত করা যায় না। জোকের ঔষধ- দেশলাই, জ্বলন্ত সিগারেট, লবন। টহলের প্রথম বা দ্বিতীয় ব্যাক্তি খুব কমই জোকের স্পর্শ পায়। এর কারণ প্রথম বা দ্বিতীয় ব্যাক্তির চলাচলে বাতাসে যে ভাইব্রেশন হয় তা পাতার নীচে কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে থাকা জোকের ঘানান্দ্রয়ে পৌঁছে ওকে জাগিয়ে তুলে সঠিক অস্থানে যেতে কিছু সময় পার হয়ে যায়। আর তাতেই প্রথম বা দ্বিতীয় ব্যাক্তি অনেক সময় রেহাই পেয়ে যায়।
আজ (গতকাল রোববার) ২০ সেপ্টেম্বর সারাদেশে পালিত হচ্ছে ‘সর্প দংশন নিরোধ দিবস। ভাবছি আজ যদি আদ্রকছড়া (দীঘিনালা-লংগদু সড়কের উপর) ক্যাম্পে বসে দিনটাকে পালন করতাম তবে কি কি করতাম? এতো সাপের উপদ্রব আমি আর কোন ক্যাম্পে দেখিনি। রাতে ঘুমানোর সময় মশারীর ভিতরে পোষা বিড়াল ‘সুন্দরী’ আর মাথার পাশে লাঠি থাকতো। হেরিকেনটা থাকতো মেঝেতে। যেন মেঝেটা আলোকিত থাকে পরিষ্কার দেখা যায়। মশারীর ভিতর থেকে মেঝেতে পা ফেলার আগে টর্চের আলো ফেলে দেখে নিতে হতো কোন কাল নাগিনীর পিঠের উপর পা রাখছি কিনা। লাঠি হাতে অন্ধ যেমন চলে রাতে ঘরের মধ্যেও সেভাবে টয়লেটে যেতে আসতে ঠুকঠুক শব্দের সাইরেন বাজিয়ে চলতে হয়। সব সময় একটা Snake Consciousness' (সাপ - সাপ ভাব) নিয়ে চলতে হতো। না হলে তো সেই এক সকালেই সর্পদংশনে মরতে হতো।
১৯৯২ সালের মার্চ-এপ্রিলের ঘটনা, খুব ভোরে কিছু একটা শব্দে ঘুম ছুটে গেলেও আধা জাগা আধা ঘুম ভাব। আমার ‘সুন্দরী’ (পোষা বিড়াল ) মাথার কাছে, মশারীতে থাবা দিচ্ছে আর মুখ দিয়ে শব্দ করছে। একটা একটা ফোঁস ফোঁস আওয়াজ পাচ্ছিলাম। প্রথমে গুরুত্ব না দিলেও পরক্ষণে ভাবনা- গরু ঘাস খেতে খেতে এ রকম শব্দ করে। ‘আরে ক্যাম্পে গরু কিভাবে আসবে?’ মাথার মধ্যে বিদ্যুৎ চমক। টর্চ হাতে নিয়ে মাথা ঘুরিয়ে শব্দের দিক বরাবর আলো ফেলতেই আমার হৃদ-স্পন্দন বন্ধ হয়ে গেল। আমার চৌকি থেকে মাএ দেড় হাত দুরে মাটির দেওয়ালের উপর কালো এক গোখরা, ফনায় তার ট্রেড মার্ক চশমার উল্কি।
‘সা- আ- প, সা-আ-প’ আমার অনিয়ন্ত্রিত আর্তনাদে পাশের ডিউটি পোস্টে থাকা সেন্ট্রি ছুটে এলো ঘরে। আমি মশারী থেকে বের হয়ে হিষ্ট্রি আক্রান্ত রোগীর মতো হাতের লাঠি দিয়ে নাগরাণীকে আঘাত করছি আর চিৎকার করছি ‘সা-আ-প, সা- আ-প’ জীবনে এতটা ভয় বোধ হয় আর কোন কিছুতেই পাইনি।
দোষটাতো আমাদেরই। পার্বত্য চট্রগ্রামে আমাদের থাকার ঘরগুলি নিরাপওা জনিত কারণে আড়াই থেকে তিন ফুট গভীরে খোদাই করে তৈরী করা হয়। তারপর পুরো ঘরটাকে আরামদায়ক করার জন্য মেঝে সহ দেওয়ালে বাশেঁর চাটাই দিয়ে আবৃত করা হয়। আর সেনাবাহিনীর ক্যাম্পগুলো ইদূরের খাদ্য সংগ্রহের এক সুনিশ্চিত উৎস। তাই ওরাও ক্যাম্প তৈরী করেছিলো আমার ঘরের চাটাই এর নীচে। নাগরাণী তার ফুড চেইনের অংশ হিসাবে ইদূরকে ধাওয়া করতে যেয়ে প্রবেশ করে আমার ঘরে। চাটাই এর নীচে ইদূরের অবস্থান টের পেয়ে ফোঁস ফোঁস শব্দ করছিলো। কিন্তু ঐ ফোঁস ফোঁস শব্দ আমার পাশে নিদ্রারত ‘সুন্দরীর’ ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেয়। মুলত ওর অস্থির আচরণের কারণেই আমার ঘুম ভাঙ্গে।
আদ্রকছড়া ক্যাম্পের নানা জায়গায় আমরা সাপের উপদ্রব বা ‘কামড় খেতে খেতে বেচেঁ যাওয়া’ র মতো অবস্থা থেকে অনেকেই বেচেঁ গেছি। সারাবিশ্বে প্রতিবছর ছয় লক্ষ মানুষ সাপের কামড়ে মারা যায়। আমরা পার্বত্য চট্রগ্রামে অনেকেই সে রকম একটি ‘সংখ্যায়’ পরিণত হওয়ার হাত থেকে বেচেঁ ফিরেছি মহান সৃষ্টিকর্তার কৃপায় কারণ তিনি আমার ক্ষেত্রে আমার পাশে ‘সুন্দরী’ কে রেখেছিলেন।
লেখক: সাবেক সেনা কর্মকর্তা
এমএস/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।