ঢাকা, রবিবার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪

এসিসিএঃ শুভংকরের ফাঁকিতে স্বপ্নভঙ্গ

প্রকাশিত : ১৮:৫৭, ১১ জানুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ১৩:৫১, ১৩ জানুয়ারি ২০১৮

এসিসিএ’র স্বপ্ন যতটা রঙিন, এর বাস্তবতা আরও বেশি ধূসর। অধিকাংশই হতে পারেন না স্বপ্নের সার্টিফায়েড একাউন্টেন্ট। এসিসিএ‘র স্বপ্ন ও বাস্তবতার এসব নানান দিক নিয়ে ইটিভি অনলাইনের দুই পর্বের প্রতিবেদনের আজ শেষ পর্ব।

শুভংকরের ফাঁকি

অনেকের কাছে স্বপ্নের ক্যারিয়ার চার্টার্ড একাউন্টেন্ট। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক অথবা সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েই এসোসিয়েশন অব চার্টার্ড সার্টিফাইড একাউন্টেন্টস (এসিসিএ) নিয়ে পড়াশুনা শুরু করেন এক ঝাঁক তরুণ-তরুণী। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, এসিসিএ-তে ভর্তি হতে মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফলজনিত কোন বাধ্য বাধকতা নেই। এমন একটি বিষয়ে পড়তে যোগ্যতা নির্ণয়ের কোনো মাপকাঠি নেই বললেই চলে।

মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক অথবা সম পর্যায়ের পড়াশুনা শেষ করে যারা এসিসিএ শুরু করতে চান তাদেরকে ফাউন্ডেশন কোর্স করতে হয়। এসিসিএ’র বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ ফাউন্ডেশন অংশকে এসিসিএ’র আওতাধীন হিসেবে গণ্য না করলেও মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক অথবা সমমানের পরীক্ষা দিয়ে আসা শিক্ষার্থীদের জন্য এসিসিএ পড়াশুনা এখান থেকেই শুরু হয়।

এসিসিএ সংশ্লিষ্ট অনেকের দাবি, ছাত্র ভর্তি করাই এসিসিএ শিক্ষা দেয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল উদ্দেশ্য। তাই কারা এ ধরণের বিষয়ে পড়াশুনা করে শেষ পর্যন্ত সফল হবে তা নির্ণয়ে নেই নূন্যতম উদ্যোগ। ফলে অসংখ্য শিক্ষার্থী ভর্তি হয়, কিন্তু পাশ করতে পারে খুবই অল্প কয়েকজন। এভর্তির সুযোগে ব্যবসা করে নেয় প্রতিষ্ঠানগুলো।

আর কে পাস করল কে করল না; তা নিয়ে কোনই মাথাব্যথা থাকে না এসব প্রতিষ্ঠানের। তাই সবাই পৌঁছাতে পারেন না কাংখিত সে স্থানে।

কোথায় পড়বেন

শুভংকরের ফাঁকিটা মূলত এখানেই। বাংলাদেশে এসিসিএ বিষয়ে পড়াশুনা করার মানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানের অভাব। ঢাকাস্থ এসিসিএ গ্লোবাল ফাউন্ডেশনের নিজস্ব কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই। কিছু প্রতিষ্ঠান এসিসিএ’র সঙ্গে এফিলিয়েশনের মাধ্যমে এর বিষয়গুলো শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করে থাকেন।

ঢাকার এসিসিএ কার্যালয়ের বিজনেস রিলেশনশিপ ম্যানেজার রেহানা সুলতানা শাম্মি ইটিভি অনলাইনকে জানান, এসিসিএ পরীক্ষায় অংশ নিতে এসব প্রতিষ্ঠানে এ বিষয়গুলো পড়া বাধ্যতামূলক নয়। যদি কোন শিক্ষার্থী নিজে পড়াশুনা করে সরাসরি পরীক্ষা দিতে চায় তাহলে সে সুযোগও আছে।

তবে এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত পড়াশুনার পরেও যেখানে অনেকের এসিসিএ পাস করতে না পারাই যেখানে বাস্তবতা; সেখানে না পড়ে কতজন পাস করতে পারবে সেটা চিন্তার বিষয় বটে।

এ প্রতিষ্ঠানগুলো কোচিং সেন্টারের মত। ভাল ফলের আশায় শিক্ষার্থীরা যেমন কোচিং এ ভর্তি হয়। তেমনি এসিসিএ পাশের আশায় এসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয় শিক্ষার্থীরা।

ঢাকায় এসিসিএ এর কার্যালয় থেকে জানানো হয় যে, এসিসিএ বিষয়ে পড়াশুনা করতে তিন থেকে চারটি এফিলিয়েটেড প্রতিষ্ঠান আছে। চার্টার্ড ইউনিভার্সিটির কলেজ, এলসিবিএস, ইন্সটিটিউট অব চার্টার্ড প্রফেশনাল একাডেমী। তবে সরেজমিনে আরও বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের তথ্য পাওয়া যায় যারা নিজেদেরকে এসিসিএ অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান দাবি করে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করিয়ে থাকে।

বাস্তব চিত্র

শামীমা জানান, ২০০৮ সাল থেকে বাংলাদেশে যাত্রা শুরুর পর এখন পর্যন্ত মাত্র পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী এফিলিয়েটেড চার্টার্ড একাউন্টেন্ট হতে পেরেছেন। অন্যদিকে এসিসিএ গ্লোবাল সেক্টরে বাংলাদেশ থেকে সদস্য আছেন দুইশ’র সামান্য কিছু বেশি।

একটি সমীক্ষা বলছে, প্রতি বছর যত শিক্ষার্থী এসিসিএ এর জন্য নিবন্ধন করেন তাদের মাত্র সাত থেকে আট শতাংশ শিক্ষার্থী শেষ পর্যন্ত এসিসিএ পাশ করতে পারেন।

চাকরি দেয়ার ব্যাপারেও উদাসীনতা

অন্যদিকে এসিসিএ কার্যক্রমে ভর্তির সময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে যে চকচকে উজ্জ্বল ভবিষ্যত ক্যারিয়ারের কথা বলা হয় বাস্তবতা এর থেকে অনেক ভিন্ন। এসিসিএ’র দুইটি ধাপ সম্পন্ন করা ফারুকী আজম নামের এক শিক্ষার্থী ইটিভি অনলাইনকে বলেন, “ভর্তির সময় আমাদেরকে বলা হয়েছিল যে, একটি পার্ট সম্পন্ন করলেই চাকরি পাওয়া যাবে। আর তার বেতনও হবে বেশ ভাল। কিন্তু দুইটি পার্ট সম্পন্ন করেও দেখলাম বাস্তব চিত্র ভিন্ন। আর বিশেষ করে বাংলাদেশের এসিসিএ কর্তৃপক্ষ অথবা যেসব প্রতিষ্ঠানে আমরা পড়াশুনা করি তারা আমাদের চাকরির ব্যাপারে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেয় না। আমরা শুধু টাকা দিয়ে পরেই যাই। তারা বছরে কয়েকটি ফেয়ার করেই শেষ। আমরা যেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি পাই বা ক্যারিয়ার গড়তে পারি সে ধরনের কোন লিয়াজোই তারা করেন না।’

ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকের অভাব

এমন সম্ভাবনাময়ী একটি বিষয়ে পড়াশুনা করেও স্বপ্নভঙ্গ হয় অনেক শিক্ষার্থীর। ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং যোগ্য শিক্ষকের অভাবেই এমনটি হচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশে যেসব প্রতিষ্ঠান এসিসিএ’র বিষয়গুলো পাঠদান করে, সেগুলোর বেশিরভাগই দক্ষতার সঙ্গে পরিচালিত হয় না। দুই একটি প্রতিষ্ঠান নিজেদেরকে এসিসিএ অনুমোদিত হিসেবে দাবি করলেও তাদের শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে আছে নানান প্রশ্ন।

এসিসিএ পাশ করা রায়হান কবীর (ছদ্মনাম) ইটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘এসিসিএ পাস করা আসলেই অনেক কঠিন। ভর্তির সময় যত সহজ করে বুঝায় তত সহজ না। আর যারা এ বিষয়ে পড়ায় তাদের বেশিরভাগই যোগ্য না। আর এ বিষয়টি একা একা পড়ে পাস করার মতো না। তাই শিক্ষাদানে যারা আছেন তাদেরকে যোগ্য এবং দক্ষ হতে হয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ চিত্র ভিন্ন। আর একটি ধাপ সম্পন্ন করেই মোটা বেতনের চাকরি পাওয়ার বিষয়টি আরেকটি ফাঁকি। এসিসিএ এর থেকে সিএ পড়ে যারা বের হচ্ছেন তাদের শুরুতে বেতন আমাদের থেকে অনেক বেশি। মোটা বেতন বলতে যা বোঝায় তেমন বেতন পেতে চাকরির অভিজ্ঞতা পাঁচ থেকে দশ বছর হয়ে যায়।’

ক্লাস নেন শিক্ষার্থীরাই

ধানমন্ডিতে একটি প্রতিষ্ঠানে সরেজমিনে দেখা যায়, এসিসিএ পড়ানোর যোগ্যতা নেই কিন্তু তিনি ক্রাস নিচ্ছেন। মজার বিষয় হচ্ছে, কারা এসিসিএ এর বিষয়গুলো শিক্ষাদান করতে পারবে এ ধরনের সুনির্দিষ্ট কোন নিয়মই নেই। তবুও তাদের দিয়ে ক্লাস নেয়া হয়।

বিভিন্ন সময়ে এসিসিএ’র কোন এক বা একাধিক ধাপ উত্তীর্ণ করা শিক্ষার্থীদের দিয়েই ক্লাস পরিচালনা করে থাকে কিছু প্রতিষ্ঠান। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যারা ক্লাস নেন তারা নিজেরাই এফিলিয়েটেড একাউন্টেন্ট নন। অন্যদিকে একজন শিক্ষকের শিক্ষাদানের বাস্তবিক যোগ্যতা নিয়েও অনেকটাই উদাসীন থাকে এসব প্রতিষ্ঠান।

নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার বক্তব্য

এসিসিএ বাংলাদেশের বিজনেস রিলেশনশিপ ম্যানেজার রেহানা সুলতানা শাম্মী এ বিষয়ে ইটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ব্র্যান্ডিং, শিক্ষার্থী বান্ধব, শিক্ষাদানের মান, পাশের হার, পরিবেশন এমন ৩৬টি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে আমরা কোন প্রতিষ্ঠানকে এসিসিএ এর বিষয়গুলোর পড়ানোর জন্য এফিলিয়েশন দিয়ে থাকি। শুধু তাই না, এফিলিয়েশন পাবার পর এসব প্রতিষ্ঠান সেসব শর্ত পালন করছে কী না সেগুলোও তদারকি করি আমরা। যেসব প্রতিষ্ঠান পরবর্তীতে এসব শর্ত পালনে ব্যর্থ হয় তাদের এফিলিয়েশন আমরা আগেও বাতিল করেছি। অন্যদিকে এফিলিয়েশন পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো যেন নিজেরা উন্নতি করতে পারে এবং শিক্ষার্থীদের উন্নত শিক্ষা দিতে পারে সে বিষয়টিও আমরা খেয়াল রাখি। ‘ট্রেইন দ্য ট্রেইনার’ নামক এক কার্যক্রমের আওতায় এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছি আমরা।’

তিনি আরও জানান, ‘এ বছরের জুন মাস নাগাদ এসব প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটারভিত্তিক পড়াশুনা বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বাইরে যারা আমাদের এফিলিয়েশন না নিয়েই এসিসিএ এর কোর্সগুলো পড়াচ্ছেন তাদের ব্যাপারে আমরা কোন দায়িত্ব নিতে পারি না।’

অবশেষে ভেঙে যায় স্বপ্নগুলো 

দায়ভার কেউ নিক বা না নিক, প্রকৃতপক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এসব শিক্ষার্থীরা। চার থেকে পাঁচ বছর শিক্ষা জীবন অতিক্রম করার পর এসিসিএ পাস করতে ব্যর্থ হওয়া এসব শিক্ষার্থীরা না পান ডিগ্রী; না পারেন অন্য কোন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ।

অনেকেই হতাশ হয়ে পড়াশুনার পাঠ চুকিয়ে ফেলেন। কেউ কেউ ভর্তি হন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এসিসিএ পড়ায় ব্যয় হওয়া অর্থ আর সময়ের সমপরিমাণ খরচ হয় এখানেও।

প্রায় পাঁচ বছর আগে এসিসিএ-তে নিবন্ধন করা ছাত্র রনি জানান, “অনেক স্বপ্ন নিয়ে ইন্টারের পর এসিসিএ-তে ভর্তি হয়েছিলাম। আমার সঙ্গের বন্ধুরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে এখন চাকরি করছে। আমি এখনও পাশ করতে পারিনি। সিএ ফার্মের ক্লাসগুলো নিয়মিত হয় না। তাই টাকা দিয়ে ভর্তি হয়েও নিজে নিজেই পড়ি। তবুও মাত্র ৫০নম্বর কেন পাচ্ছি না তাই বুঝতেছি না।’

এক সময় এসিসিএ-তে নিবন্ধন করা বর্তমানে তেজগাঁও কলেজের এক ছাত্রী পরিচয় গোপন রেখে বলেন, ‘এসিসিএ-তে ভর্তি হয়ে দুই বছর নিয়মিত পড়াশুনা করি। কিন্তু কোনভাবেই একটি ধাপও পাস করতে পারিনি। এদিকে বাবা-মা’র প্রচুর টাকাও খরচ হয়। পরবর্তীতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন এ কলেজে ভর্তি হই।’

বর্তমান অবস্থা যাই হোক, এসিসিএ এর নীতিনির্ধারকরা এ পেশার উন্নয়নে আরও সহায়ক ভূমিকা রাখবেন বলেই আশা এসিসিএ অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের।

এসিসিএ নিয়ে প্রথম পর্ব: এসিসিএ: স্বপ্নের পেছনে ছুটে চলা


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি