ঐতিহাসিক ১০ সপ্ন
প্রকাশিত : ১৬:০৫, ৩০ জানুয়ারি ২০১৯

আমরা সবাই কমবেশি স্বপ্ন দেখি। আমাদের সব স্বপ্নই মধুর হয়না, কখনো কখনো হয় ভয়ংকর। আমরা দুঃস্বপ্ন দেখলে ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসি। নিজেই নিজেকে প্রবোধ দেই, ঘাবড়াবার কিছু নেই , ওটা শুধুই স্বপ্ন- । পণ্ডিতদের মধ্যে স্বপ্নের কারণ নিয়ে বিতর্কের অন্ত নেই। অনেকে বলতে চেয়েছেন স্বপ্ন নেহাত স্বপ্নই । স্বপ্ন শুধু স্বপ্ন নয় এটা কিন্তু ইতিহাস থেকে আমরা দেখতে পাই।
এক
স্বপ্নে আমরা নিজেকে মৃত দেখি ঘটনা বিরল কিছু নয়। আমেরিকার মহান প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার কয়েকদিন পূর্বে এমন একটি স্বপ্ন দেখেছিলেন । প্রেসিডেন্ট তার স্ত্রী এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু ওয়ার্ড লেমনের নিকট তার স্বপ্নের ঘটনা বর্ণনা করেন। লিঙ্কন বলেন, ‘আমি স্বপ্ন দেখলাম, আমি হোয়াইট হাউসের বিভিন্ন কক্ষে ঘুরছি, কিন্তু কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। প্রতিটি কক্ষ থেকে ভেসে আসা কান্নার শব্দ শুনছি ।হোয়াইট হাউসের পূর্বদিকের কক্ষে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় রক্ষিত একটি কফিন দেখতে পেলাম । শোকাচ্ছন্ন নারী-নররা প্রহরী সৈনিকদের চারদিক ঘিরে রয়েছে ।’ আমি তাদের জিজ্ঞেস করলাম, হোয়াইট হাউসে কে মারা গেছেন?এটি কার লাশ?
তারা আমাকে জবাব দিল,এটা প্রেসিডেন্টের লাশ । আততায়ীর হাতে তিনি নিহত হয়েছেন। ’ প্রেসিডেন্ট লিঙ্কন স্বীকার করেন যে, ‘এটি যদিও একটি স্বপ্ন ছিল, তবুও তা আমার মনের ওপর গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। সারারাত আমার আর ঘুম এল না। শুধু মনে হলো, আমি সবকিছুর পরিসমাপ্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। মনটা বেদনায় লীন হয়ে গেল। অনেক চেষ্টা করেও আমি এই বেদনাদায়ক অনুভূতিকে দূরে ঠেলে দিতে পারছিলাম না।’
লিঙ্কন যেদিন আততায়ীর হাতে নিহত হন, সেদিন বিকেলে মন্ত্রীসভার বৈঠক ডাকেন। নির্ধারিত কক্ষে ঢুকে মন্ত্রীরা দেখেন , প্রেসিডেন্ট আগেই এসে আসন গ্রহণ করেছেন। কিন্তু প্রেসিডেন্টের মাথা টেবিলের ওপর নোয়ানো। দু’হাতের মাঝে তার মাথা এমনভাবে ডুবে আছে যে, তার মুখাবয়ব দেখার উপায় নেই। মন্ত্রীদের পদশব্দে প্রেসিডেন্ট মাথা তুলে ঠিক হয়ে বসলেন। ’ সম্বোধনের জবাব দিয়ে প্রেসিডেন্ট তাদের বললেন, ‘ভদ্রমহোদয়গণ, আপনারা শিগগিরই কোনো গুরুত্বপূর্ণ খবর শুনতে পাবেন। একজন মন্ত্রী জানতে চাইলেন।মহামান্য প্রেসিডেন্ট, আমাদের জন্যে কি কোনো অশুভ সংবাদ রয়েছে? লিঙ্কন জবাবে বললেন, আমার কাছে কোনো খবরও নেই, ‘আমি কিছু শুনি নি। কিন্তু গতরাতে একটি স্বপ্ন দেখেছি। আমি স্বপ্নে দেখলাম, একটি নৌকায় আমি একা। নৌকায় কোনো দাঁড় নেই, হাল নেই। অথৈ সাগরে নিঃসহায়ের মত একা ভেসে চলেছি।কক্ষের মাঝে নেমে এল নিঃসীম-নিস্তব্ধতা । , কেউই তা জানেন না এখন কি বলতে হবে । প্রেসিডেন্ট বলে চললেন : গৃহযুদ্ধকালে কয়েকবার আমি এ স্বপ্ন দেখেছি। প্রতিবারই একদিন বা দু’দিনের মধ্যে মারাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়েছে। হ্যাঁ, ভদ্রমোহদয়গণ। আমার মনে হচ্ছে, সম্ভবত আগামীকাল- সম্ভবত কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আপনারা কোনো গুরুত্বপূর্ণ খবর পাবেন। এর পাঁচ ঘণ্টা পরই আততায়ীর হাতে মহান লিঙ্কন নিহত হন।
দুই
ইউরোপের ইতিহাসকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল একটি মাত্র স্বপ্ন । তখনও রোম সম্রাট জুলিয়াস সিজার জীবিত। এক রাতে তার একজন প্রভাবশালী সভাসদ সিসিরো স্বপ্ন দেখেন যে, সিজারের যোগ্য উত্তরাধিকারী মনোনয়নের জন্যে দেবতা জুপিটার সিনেটের তনয়দের প্যারেড পরিদর্শন করছেন। কিন্তু কাউকেই দেবতার মনঃপুত হলো না। এমন সময় প্যারেডের মাঠে অদ্ভুত এক তরুণকে দেখা গেল । দেবতা জুপিটার তাকেই সিজারের উত্তরাধিকারী মনোনীত করলেন । ঘুম ভাঙার পরও স্বপ্নে দেখা তরুণের মুখচ্ছবি সিসিরোর মনে ভাসতে লাগল। পরদিন সিসিরো দরবারে যাওয়ার পথে, শরীরচর্চা শেষে ফিরছিল এমন একদল তরুণের সাক্ষাৎ পেলেন। স্বপ্নে দেখা তরুণকে তাদের মধ্যেই তিনি দেখতে পেলেন । সে তরুণকে সিসিরো এর পূর্বে কখনো দেখেননি। তরুণের নাম অক্টাভিয়াস, খোঁজ নিয়ে তিনি জানতে পারলেন । তেমন কোনো পরিচিতি রাজধানীতে তার বাবা-মার নেই। কয়েক বছর পরের কথা। বিরোধ সৃষ্টি হলো সিজারের উত্তরাধিকারী মনোনয়ন নিয়ে । সিসিরো তার স্বপ্নের বলে বলিয়ান হয়ে সর্বশক্তিতে অক্টাভিয়াসের পক্ষ সমর্থন করলেন। অক্টাভিয়াস রোমের সিংহাসনে আরোহণ করলেন । পরে সর্বশ্রেষ্ঠ রোম সম্রাট হিসেবে অগাস্টাস নামে ইতিহাসখ্যাত হন অক্টাভিয়াসই ।
তিন
সারা ভারতে ১৯০৯ সালে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের জোয়ার বইছে। তার ঢেউ লেগেছে লণ্ডনে । তখন লণ্ডনের সবার মনে আশঙ্কা, সন্ত্রাসবাদীরা ভারতের সাথে সংশ্লিষ্ট বৃটিশ অফিসারদের হত্যা করতে পারে । ভারতীয় সন্ত্রাসবাদীদের ওপর নজর রাখার দায়িত্ব অর্পণ করেন স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ড বিশেষ গোয়েন্দা ইন্সপেক্টর ম্যাক লাফলেনের ওপর ।
ইন্সপেক্টর ম্যাক লাফলেন এক রাতে স্বপ্ন দেখেন একটি বিরাট ভবনের বাইরে রিভলবার হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে লালধিংরা নামে এক ভারতীয় ছাত্র । লালধিংরার ওপর এরপর থেকে তিনি সতর্ক নজর রাখতে লাগলেন। স্বপ্ন দেখার পর ইন্সপেক্টর ভবনটি সনাক্ত করতে চেষ্টা করেন। কিন্তু লণ্ডনের বহু রাজপথ পরিক্রমণ করেন কিন্তু তিনি সেই ভবনটি সনাক্ত করতে ব্যর্থ হন। ১৯০৯ সালে পহেলা জুলাই দক্ষিণ কেনিংস্টনের ইম্পেরিয়াল ইন্সটিটিউটে ভারতের সাথে সংশ্লিষ্ট বৃটিশ অফিসারদের সম্মানে এক সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হন ভারত বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী স্যার কার্জন উইলি এবং তার বিশিষ্ট বন্ধু পার্সি চিকিৎসক ডাক্তার কাউস লাল কাকাও এ । নির্ধারিত সময়ের পরেও চলতে থাকে জমজমাট এ সংবর্ধনা অনুষ্ঠান । রাত নয়টায় অতিথি বাড়ি ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন স্যার কার্জন ও আরো কয়েকজন । ভবনের প্রধান সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসেন স্যার কার্জন । কিন্তু তিনি নিচে নেমে আসতে না আসতেই বিদ্যুৎগতিতে তার সামনে এসে দাঁড়ায় একটি স্তম্ভের আড়ালে আত্মগোপনকারী লালধিংরা । পরপর পাঁচটি গুলি করে তাকে মাত্র দু’হাতের ব্যবধানে থেকে লালধিংরা । কার্জনের পেছনে আসছিলেনডাক্তার লালকাকা । তিনি চেষ্টা করেন দ্রুত এগিয়ে এসে বাধা দিতে । কিন্তু লালধিংরার রিভলভারের শেষ গুলিটি আঘাত করে। ঘটনাস্থলেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পরদিন দিবালোকে ইন্সপেক্টর লাফলেন ভবনটির সামনে এসে দাঁড়ান। ভবনটিকে এবার সনাক্ত করতে পারেন । তিনি স্বপ্নে দেখেছিলেন এ ভবনটিই । লণ্ডনের বহু রাজপথের দু’ধারে তিনি স্বপ্ন দেখার এ ভবনটির খোঁজ করেছিলেন। কিন্তু কেনিংস্টনের এক্সিবিশন রোড ও তার আশেপাশের কয়েকটি রাস্তায় তিনি আসেন নি।
চার
ঘটনাটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন । মিত্রপক্ষের সামরিক গোপনীয়তা রক্ষায় যথেষ্ট সহায়ক হয়েছিল এ সময় একটি স্বপ্ন । মি. রোনাল্ড হল ছিলেন তখন চীনা বন্দর সোধাতোর বৃটিশ কন্সাল । তার স্মৃতিকথায় তিনি লিখেছেন : এক রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমি স্বপ্নে দেখি, গুরুত্বপূর্ণ কোনো ঘটনা ঘটায় আমি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। আমি তখন আর মুক্ত নই। বৃটিশ কন্সাল হিসেবেও আমি কর্মরত নই। এই স্বপ্ন আমাকে বেশ প্রভাবিত করে। আমি গভীর রাতে ঘুমুতে গেলেও উঠে পড়ি খুব ভোরে । অস্বস্তি দূর করার জন্যে ম্যানিলা বেতারের ভোরের খবর শোনার জন্যে নিচের তলায় নেমে যাই । ম্যানিলা বেতার ধরার সাথে সাথেই শুনলাম, আজ সকালে বোমাবর্ষণ করা হয়েছে ম্যানিলায় । আমি কালবিলম্ব না করে আমার দফতরের পথে রওয়ানা হই। দফতরে পৌঁছেই ভস্মীভূত করতে শুরু করি সকল গুরুত্বপূর্ণ দলীল-দস্তাবেজ । দলীল-দস্তাবেজ ভস্মীভূত করে নিশ্চিহ্ন করতে না করতেই জাপানীরা আমাকে বন্দী করে। এতটা ভাগ্যবান ছিলেন না আমার আমেরিকান সহকর্মী । তাকে বিছানা থেকেই গ্রেফতার করে জাপানীরা । ফলে তিনি কোনো কিছু ভস্মীভূত করতে সক্ষম হন নি। স্বপ্ন দেখার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই আমি জাপানী জেনারেলের কাছ থেকে একটা চিঠি পাই। তাতে লেখা ছিল, যেহেতু অক্ষশক্তি ও মিত্রশক্তির মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে তাই বৃটিশ কন্সাল হিসেবে আমার আর কোনো মর্যাদা নেই।
পাঁচ
অতিমাত্রায় অনুভূতিপ্রবণ ছিলেন প্রখ্যাত মার্কিন কথাশিল্পী মার্ক টোয়েন । পেনসিলভানিয়া স্টিমারে খালাসীর কাজ করার সময় একদিন তিনি তার বোনের বাসায় বেড়াতে গিয়ে সেখানে রাতও কাটান ।
তিনি রাতে এক অভাবিত স্বপ্ন দেখেন । তিনি একটি হল ঘর দেখেন, তার ছোট হেনরীর লাশ রয়েছে অনেক লাশের মধ্যে । হেনরীর লাশ রয়েছে ধাতব কফিনেঅন্যান্য লাশ কাঠের কফিনে । হেনরীর বুকের ওপরে রয়েছে শ্বেত পুষ্পস্তবক । আর একটি লাল গোলাপ তার মাঝখানে শোভা পাচ্ছে । এ স্বপ্ন তাকে এত আচ্ছন্ন করে ফেলে যে তিনি বিছানা থেকে উঠে পোশাক পরে বেরিয়ে পড়েন। সে গভীর রাতে রাস্তায় কোনো গাড়ি না পেয়ে হেঁটেই রওয়ানা হন ভাইয়ের লাশ দেখার উদ্দেশ্যে।
এর সাথে বাস্তবের কোনো যোগাযোগ নেই, আধা মাইল হাঁটার পর তিনি উপলব্ধি করতে সক্ষম হন , তিনি শুধুমাত্র স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাই আবার বাসায় ফিরে আসেন। সকালে নাস্তার টেবিলে তার বোনের কাছে। তিনি স্বপ্নের কথা বলেন এর কয়েকদিন পর স্টীমারে করে নিউ ওরলিন্সে যান তিনি ও হেনরী পেনসিলভানিয়া । সেখান থেকে টিএ লেকী স্টীমারে তাকে বদলী করা হয় । পেনসিলভানিয়া দু’দিন আগেই নিউওরলিন্স থেকে যাত্রা শুরু করে। কয়েকদিন পরে পেনসিলভানিয়ায় বিস্ফোরণ ঘটে হেনরী মারাত্মকভাবে আহত হন। হেনরী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে, দুর্ঘটনার পর ছয় দিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে ।
মার্ক টোয়েনকে তার ভাইয়ের লাশ দেখানোর জন্যে নিয়ে যাওয়া হয়। হেনরীর লাশ দুর্ঘটনায় নিহত অন্যান্যের লাশের সাথে একটি হল কক্ষে রাখা হয়েছিল।
হল কক্ষে হেনরীর লাশ ছাড়া অন্যান্যের লাশ ছিল কাঠের কফিনে। হেনরীর লাশই শুধু ছিল ধাতব কফিনে। তার তারুণ্য ও আকর্ষণীয় চেহারা মেমফিসের মহিলাদের বেশ প্রভাবিত করেছিল। তারা চাঁদা করে হেনরীর জন্যে একটা ধাতব কফিন কেনে। তার জন্যে বিশেষভাবে তৈরি করে শ্বেত পুষ্পের একটা তোড়া। তারা তোড়াটি রাখে হেনরীর ঠিক বুকের ওপর।হল ঘরের দরজায় এসেই থমকে দাঁড়ান মার্ক টোয়েন, বাস্তবতাকেই স্বপ্ন বলে ভ্রম হয় তাঁর। বাস্তবতা আর স্বপ্নে দেখা ঘটনায় অমিল নেই কোনো—শুধু লাল গোলাপটি ছাড়া। তিনি দরজায় দাঁড়িয়ে যখন এ কথা ভাবছেন, তখন আর এক মহিলা একটি লাল গোলাপ হাতে নিয়ে তার গা ঘেঁষে কক্ষে প্রবেশ করে। মহিলা সরাসরি হেনরীর কফিনের নিকট যায়। লাল গোলাপটি রাখে শ্বেত পুষ্পস্তবকের ওপর আলতোভাবে ।
ছয়
প্রখ্যাত বৃটিশ সেনাপতি জেনারেল গর্ডন ভারতে থাকাকালিন এক রাতে স্বপ্ন দেখেন যে, তিনি একটি খরস্রোতা নদী পার হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। নদী পার হওয়ার জন্যে একটি ধূসর রঙের নৌকায় কয়েকজন সৈন্যসহ উঠছেন। মাঝপথে যাওয়ার পর তাদের নৌকা ডুবতে শুরু করে। এ সময় তিনি তার পাশে যে সৈনিককে দাঁড়ানো দেখতে পান তাকে তিনি ইতিপূর্বে অবাধ্যতার জন্যে শাস্তি দিয়েছিলেন। তিনি এ স্বপ্ন দেখেন পর পর কয়েক রাত । প্রতিবারেই নৌকা নিমজ্জিত হতে শুরু করার সময় তার পাশে সেই সৈনিককে দাঁড়ানো দেখতেন।এর অল্প কিছুদিন পর জেনারেল গর্ডনকে একটি খরস্রোতা নদী অতিক্রম করতে হয়। তিনি নৌকায় উঠতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু হঠাৎ লক্ষ করলেন যে, নৌকাটি স্বপ্নে দেখা নৌকার ন্যায় এবং এর রংও ধূসর। আরো ভালো করে লক্ষ্য রতেই তিনি দেখতে পেলেন যে, তার সঙ্গী সৈনিকদের মধ্যে এমন একজন রয়েছে, যাকে তিনি ইতিপূর্বে অবাধ্যতার জন্যে শাস্তি দিয়েছেন। একজন জেনারেলের পক্ষে স্বপ্নের ওপর গুরুত্ব দান কিছুটা অস্বাভাবিক। কেউ কেউ একে বোকামিও মনে করতে পারেন। কিন্তু নৌকায় উঠলেন না জেনারেল গর্ডন । বরং নির্দেশ দেন সৈনিকদের নৌকা টেনে ডাঙ্গায় তোলার । নৌকা ডাঙ্গায় ওঠানোর পর তা ওল্টাতে বলেন। দেখা যায় নৌকার তলায় অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্র। নৌকার পাটাতনের জন্যে তা দেখা যাচ্ছিল না। নৌকা ওপরে তোলার এই অভাবিত ঘটনা দেখে সৈনিকটি লুটিয়ে পড়ে জেনারেল গর্ডনের পায়ে । সে সকল অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করে । জেনারেল গর্ডন লিখেছেন, ‘যদি আমি আমার স্বপ্নের সতর্কবাণীতে কান না দিতাম, যদি সতর্ক না হতাম, তবে আমার সাথে সবাইকে নদীতে নিমজ্জিত হতে হতো। কারণ অত্যন্ত বিপজ্জনক ছিল নদীর স্রোত ।
সাত
এড্রিন ক্রিশ্চিয়ান ম্যান দ্বীপে বসবাসরত বালক স্বপ্ন দেখে জাহাজে ক্যাপ্টেনের দায়িত্বলাভ করেছে। পরিবার রয়েছে অন্য জাহাজে। হঠাৎ জাহাজটি বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং সে তার জাহাজ নিয়ে তাদের উদ্ধার করে। পরদিন সকালে সে তার ভাই টমাসকে স্বপ্নের কথা বলে। সত্যি সত্যি বালক এড্রিন একদিন জাহাজের ক্যাপ্টেনে পরিণত হয়। ১৮৮০ সালে ‘বৃটিশ ইণ্ডিয়া’ জাহাজ অস্ট্রেলিয়ার লণ্ডনী থেকে রেঙ্গুনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। ক্যাপ্টেন এড্রিন ক্রিশ্চিয়ানের ওপর ছিল এ জাহাজ পরিচালনার ভার । রেঙ্গুন অভিমুখে যাত্রার কয়েকদিন পর পর স্বপ্ন দেখেন যে, বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়েছে একটি জাহাজ । স্বপ্নের শেষে ‘ফ্যামিলি’ শব্দটি অত্যন্ত জ্বলজ্বলভাবে তার চোখের সামনে ভাসতে থাকে। তারমনে পড়ে যায় ছোট বেলার স্বপ্নের কথা । পরদিন তিনি তার সন্ধান তৎপরতা দ্বিগুণ বৃদ্ধি করলেন। একই স্বপ্নের পুনরাবৃত্তি ঘটে পরবর্তী রাতে । তার মধ্যে এ অনুভূতির সঞ্চার হয় যে, নিজের জাহাজের উত্তরে রয়েছে বিপদগ্রস্ত জাহাজটি । অধীনস্থ অফিসারদের প্রতিবাদ সত্ত্বেও তিনি তার জাহাজের গতি উত্তরে পরিবর্তিত করেন। দু’দিন ক্রমাগত চলার পর তিনি দূর-দিগন্তে একটি নিমজ্জমান জাহাজের মাস্তুল দেখতে পান। বিপন্ন জাহাজের কাছে সময়মত পৌঁছতে পারায় ২৬৯টি প্রাণ রক্ষা পায়। তার ভাই টমাসও ছিলেন এদের মধ্যে । নিমজ্জিত জাহাজটির নাম ছিল ফ্যামিলি।
আট
সম্ভব স্বপ্নের বিরাট যোগযোগ রয়েছে অসুস্থতার সাথেও । এমনি এক অভিজ্ঞতা রয়েছে মনস্তত্ববিদ অধ্যাপক ট্রন ব্রস-এর জীবনে । তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন : এক রাতে আমি স্বপ্নে দেখি যে, একটি বিড়াল আমার গলায় আঁচড় কাটার জন্যে তেড়ে আসছে। এত বাস্তব মনে হচ্ছিল যে, আমার ঘুম ভেঙে গেল। ছয় মাসে কমপক্ষে বিশ বার আমি এ স্বপ্ন দেখি! প্রতিবারই আমার ঘুম ভেঙে যায় আচঁড় কাটার পূর্ব মুহূর্তে । এর পর মাস পেরুতে না পেরুতেই মারাত্মকভাবে ঠাণ্ডায় আক্রান্ত হন অধ্যাপক ব্রস । অবস্থা জটিলাকার ধারণ করলে শরণাপণ্ন হন একজ বিশেষজ্ঞের। পরীক্ষার পর বিশেষজ্ঞ দেখতে পান যে, গলার মধ্যে একটা মাংসপেশী বিপজ্জনকভাবে বেড়ে উঠেছে। তিনি অবিলম্বে গলায় অস্ত্রোপচারের পরামর্শ দেন। অস্ত্রোপচার করে বাড়তি মাংসপেশীটি অপসারণ করা হয়। এরপর অধ্যাপক ব্রসকে আর কোনো বিড়াল আঁচড় কাটতে তেড়ে আসে নি। গলার ভিতর কিছু একটা গণ্ডগোল হচ্ছে–এ স্বপ্নটি নিশ্চয় সে সম্পর্কে সতর্ক করে দিচ্ছিল। কিন্তু স্বপ্নের সতর্কবাণীর ওপর গুরুত্বারোপ করেন ক’জন?
নয়
তখন ১৮১২ সাল। তখন ইংল্যাণ্ডের প্রধানমন্ত্রী স্পেন্সার পার্সভেল ।তিনি লর্ড হ্যারোবির আতিথ্য গ্রহণ করেন ১০ মে । তিনি যথারীতি ঘুমুতে যান রাতের খাওয়া-দাওয়ার পর । ক্লান্ত প্রধানমন্ত্রীর দু`চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসে নরম বিছানার পেলব স্পর্শে । একটি বিশ্রি স্বপ্ন তার চোখের ঘুম কেড়ে নেয় কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যেই । তিনি আর সারারাত ঘুমুতে পারেন নি। তিনি লর্ড হ্যারোবির নিকট রাতের স্বপ্নের কথা বর্ণনা করলেন পর দিন সকালে নাস্তার টেবিলে । তিনি বলেন, ‘আমি স্বপ্ন দেখলাম বালিশে মাথা লাগাতে না লাগাতেই, দিয়ে আমি হেঁটে যাচ্ছি হাউজ অব কমন্সের লবির মধ্যে । এমন সময় হঠাৎ এক ব্যক্তি আমার পথরোধ করে দাঁড়াল। তার কোটের বোতামগুলো ছিল পিতলের। সে আমাকে গুলি করল কালবিলম্ব না করে । মুহূর্ত মাত্র। তারপর মাটিতে লুটিয়ে পড়ল আমার প্রাণহীন দেহ । পার্লামেন্টের অধিবেশন শুরু করার কথা ১১ মে বিকেলে । লর্ড হ্যারোবি তার বন্ধুকে পার্লামেন্টের অধিবেশনে যোগদান থেকে বিরত রাখার জন্যে চেষ্টা করলেন। কিন্তু স্পেন্সার পার্সভেল শুধুমাত্র একটি স্বপ্ন দ্বারা বিচলিত হতে অস্বীকৃতি জানালেন। লর্ড হ্যারোবির প্রচেষ্টা তাই ফলপ্রসূ হলো না। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, স্বপ্ন তিনি যেভাবে তার মৃত্যু দেখেছিলেন, একইভাবে তিনি নিহত হন। প্রধানমন্ত্রীর হত্যাকারী বেলিংহামের পরনেও ছিল সবুজ জ্যাকেট আর তার বোতামগুলোও ছিল পিতলের।
দশ
ভারতের সাবেক গভর্নর জেনারেল লর্ড ডাফরিন আয়ারল্যাণ্ডে বেড়াতে গিয়েছিলেন, ফ্রান্সে ইংল্যাণ্ডের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হওয়ার আগে । তার বন্ধু স্যার হেনরীর বাগানবাড়িতে তিনি সেখানে অবস্থান করছিলেন । কিছুতেই ঘুম আসছিল না এক রাতে । তিনি এপাশ-ওপাশ করছিলেন বিছানায় শুয়ে । রাত গভীর হয়ে এলে তিনি আস্তে আস্তে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। দেখেন অদ্ভুদ এক স্বপ্ন।
তার ঘুম ভেঙে গেছে কোনো কারণ ছাড়াই । কেমন যেন ভারী ভারী মনে হচ্ছে ঘরের পরিবেশটা । তিনি একটা অশুভ ইঙ্গিত পাচ্ছেন । হঠাৎ মৃদু পদশব্দ শুনতে পেলেন বাইরে । বাইরে এলেন তিনি । পূর্ণ চন্দ্রালোকে দেখতে পেলেন এক ব্যক্তি কাঁধে একটা বিপুলাকার কালো কফিন নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। কফিনবাহী কফিনের ভারে একেবারে কুঁজো হয়ে গেছে। লর্ড ডাফরিন দ্রুত গিয়ে লোকটির পথরোধ করে দাঁড়ালেন। তার পরিচয় জানতে চাইলেন । সে কি বহন করছে জানতে চাইলেন ।
লোকটি লর্ড ডাফরিনের কথা শুনে একটু সোজা হয়ে দাঁড়াতে চাইল। লোকটির বিশ্রি কদাকার চেহারা আলোয় তিনি দেখলেন । কোনো শব্দ নেই লোকটির মুখে । ঘৃণা ঝরে পড়ছে দু`চোখ দিয়ে । তাতে কদাকার আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে মুখচ্ছবি । সাহস সঞ্চার করে লোকটির কাছে এগিয়ে গেলেনঅতি সাহসী ডাফরিন ।মুহূর্তের মধ্যে লোকটি কফিনসহ অদৃশ্য হয়ে গেল । ভেজা ঘাসের মধ্যে লোকটার পদচিহ্নও খুঁজে পেলেন না তিনি। এরপর ঘুম ভেঙে যায় লর্ড ডাফরিনের । সহজেই বোধগম্যতার তখনকার মনের অবস্থা ।
তিনি রাতের ঐ প্রহরে কারো ঘুম আর ভাঙতে চাইলেন না । সকালে নাস্তার টেবিলে স্বপ্নের আগাগোড়া কাহিনী শোনালেন তার বন্ধুকে। ডাফরিনের অনুরোধে হেনরী সারা গ্রামে খোঁজ নিলেন। গ্রামে কেউ মারা যায় নি সে রাতে । গ্রামে ঘুরলেন লর্ড ডাফরিনও । স্বপ্নের দেখা কদাকার লোকটির সাথে চেহারার সাযুজ্য রয়েছে এমন কাউকে দেখতে পেলেন না!
কয়েক বছর পরে! লর্ড ডাফরিন তখন ফ্রান্সে ইংল্যাণ্ডের রাষ্ট্রদূত। এক সন্ধ্যায় কূটনৈতিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্যে প্যারিসের গ্রাণ্ড হোটেলে যান। লিফটে ওঠার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন তিনি ও আরো কয়েকজন কূটনীতিক! লিফটের দরজা খোলা হলে ডাফরিন তাতে প্রায় ঢুকে পড়েছিলেন। হঠাৎ লিফট চালকের মুখের দিকে দৃষ্টি পড়তেই চমকে উঠলেন। স্থাণুর মত কয়েক সেকেণ্ড দাঁড়িয়ে রইলেন ।কয়েক বছর আগে আয়ারল্যাণ্ডে দেখা স্বপ্নের কথা বিস্মিত আতঙ্কিত ডাফরিনের মনে পড়ে গেল । লিফট চালকের মুখাবয়ব তো অবিকল সেই কফিন বাহকের মত। পিছিয়ে এলেন লর্ড ডাফরিন । সৌজন্যমূলক ক্ষমা চেয়ে লিফটে ঢোকার থেকে বিরত থাকলেন । লিফট ভর্তি হয়ে উঠতে লাগল ওপরের দিকে।
লর্ড ডাফরিন ডান পাশের কক্ষে গিয়ে ম্যানেজারের কাছে লিফট চালকের পরিচয় জানতে চাইলেন । কিন্তু ম্যানেজার কোন কথা বলার আগেই হোটেল ভবন প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে উঠল । লিফট নিচে পড়ে যায় কেবল ছিঁড়ে । সম্পূর্ণরূপে লিফটি বিধ্বস্ত হয় । লিফটের ভেতরের সবাই যান । সম্পূর্ণ ঘটনা পরের দিনের সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। অনেকে মত ব্যক্ত করেন, দুর্ঘটনাটি ছিল একটি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র।এর উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রদূতকে হত্যা করা । কিন্তু লিফট চালকের পরিচয় কেউই আবিষ্কার করতে পারলেন না । আয়ারল্যাণ্ডের সেই কফিন বাহকের সাথে লিফট চালকের কোনো যোগসূত্রও বের করতে সক্ষম হলেন না কেউ। কিন্তু সেই স্বপ্নই লর্ড ডাফরিনকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে ছিল ।