ঐতিহ্যের মুরাদপুর-৩
প্রকাশিত : ১৩:১৪, ২৬ আগস্ট ২০২০ | আপডেট: ১৫:৫০, ২৬ আগস্ট ২০২০
বয়স সম্ভবত: সাত হয়ে গেছে আমার। তাই মুসলমানি ও আকিকা দিতে হবে। পরিবারের প্রথম সন্তান। আয়োজন ভরপুর। বাবা মা ভীষণ ব্যস্ত।
মাইকের প্রচলন কখন হয়েছে জানিনা। তবে ঐ সময় কখনো কখনো পূর্ব মুরাদপুরে মাইকের গান বাজতো। তখন কারো বাড়ীতে মাইকের গান বাজানো মানে বিশাল ব্যপার। আশেপাশে বিভিন্ন বাড়ি থেকে উৎসূক্য জনগণ ভীড় করতো, কিভাবে রেকর্ড দিয়ে গান বাজান হয় সেটাই সবার কৌতুহল। বারাসাত ছবির- হাওয়া মে উড়তা যায়ে মেরে লাল দুপাট্টা মল মল- নাগিন সিনেমার- মন ডোলে মেরা তান ডোলে, সহ লতা, সামশাদ বেগমের বা মুহম্মদ রফি'র মনোহর করা গানের সাথে আমাদের আব্বাসউদ্দিন এর-মাঝি ভাইয়া যাওরে- আবদুল আলিমের- মেঘনার বুকে ঘর বান্দিলাম- অথবা-সর্বনাশা পদ্মানদী-তখন তুমুল তাল দিয়ে চলছে। মাইকের গান সন্ধ্যা থেকে সারা রাত বাজতো, ভোরে নামাজের সময় বন্ধ হয়ে আবার সকাল আটটা হতে শুরু হতো।
তো, সিদ্ধান্ত হলো- আমার আকিকায় মাইক বাজানো হবে।
আত্মীয়স্বজনে ঘর পরিপূর্ণ। দিনের বেলায় আমাদের বড় পুকুর থেকে জাল দিয়ে মাছ ধরা হয়েছে। রাতে গরু জবাই করা হয়েছে। হ্যজাক লাইটে পুরো বাড়ি আলোকিত। মাইক বাজছে ঈদু দা দের কাছারি ঘরে। ইদু দা বয়সে বড়, তাই মাতব্বরিটা তার, এবং সে যথারীতি মাতাব্বরি চালিয়ে ইচ্ছেমত পছন্দসই গান বাজাচ্ছে। সকাল দশটা থেকে খাওয়া শুরু হবে। কথা ছিল আমার নানা এসে সকাল বেলায় তকবির তাহলিল, দোয়ে খায়ের করে খাওয়ার উদ্বোধন করবেন। কিন্তু নানা এখনো আসেননি। মাইকে গান বাজছে, দাওয়াতি মেহমান আসা শুরু হয়েছে। কিন্তু নানার দেখা নেই। পরক্ষণে খবর পাওয়া গেল- নানা এসে মসজিদের ভিতর বসে আছেন, বাড়ী আসবেন না। কারণ বাড়ীতে মাইক বাজছে। মাইকে গান বাজানো বাড়ীতে নানা ঢুকবেন না, খাওয়াতো দূরের কথা। এ কথা শুনার সাথে সাথে আমার বাবা মাইক বন্ধ করে দিয়ে নানাকে মসজিদ থেকে যত্নকরে পুত্রস্নেহে বাড়ী নিয়ে আসেন।
আমাদের এই বড় পুকুর নিয়ে কিংবদন্তী আছে যা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। এই পুকুরের উত্তর পাড়ের মাঝের কিছু অংশ খোলা থাকবে, বন্ধ করা যাবে না এবং মাছ ধরার জন্য কাউকে নিষেধ করা যাবে না। প্রয়োজনে সরল মনে জাল দিলে প্রয়োজন মতোই মাছ পাওয়া যাবে। আমার আকিকার পূর্বদিন আমাদের এক প্রতিবেশী ঐ পুকুরে জাল দিলেন মাছ ধরার জন্য। কিন্তু বার বার জাল দিয়েও কোন মাছ পাওয়া গেল না, জালে মাছ উঠেনি। তারা নাখোশ মনে চলে গেল। আমরাও চিন্তিত হয়ে গেলাম। কালকে আমাদের সময় মাছ না পেলে কি অবস্থা হবে? তখন এ জাতীয় খানা পিনায় ভাজা রুই মাছ অত্যাবশ্যকীয় আইটেম ছিল। আল্লাহর রহমতে পরদিন আমাদের জাল ফেলার পর প্রথম টানেই প্রয়োজনাতিরিক্ত মাছ পাওয়া গেল। এটাই এই পুকুরের বৈশিষ্ট্য। কাউকে ঠকাতে গেলে নিজেকে ঠকতে হয়।
বেলা তিনটার মধ্যে খানাপিনা শেষ। এখন আমাকে ঠেংজানে করে গ্রাম প্রদিক্ষণ করে নানাবাড়ি নেয়া হবে। ঠেংজান সম্পর্কে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। এটার অন্যকোন নাম আছে কিনা আমি জানিনা। তখনতো গাড়ীর ব্যবস্থা ছিল না। বিয়েতে বর যেত ঠেংজানে করে এবং কনে নিয়ে আসতো পালকিতে করে। ঠেংজান পালকির মতোই বেহারা দিয়ে কাঁধে বহন করা হয়। শুধু পালকির চারিদিক বন্ধ থাকে দু’পাশে দু’টো ছোট্ট জানালা ছাড়া, কিন্তু ঠেংজান চতুর্দিকে খোলা থাকে। শুধু চারটা খুটির ফ্রেমের উপর সুদৃশ্য চেয়ার সাদৃশ্য আসন ব্যবস্থা সম্বলিত রাজকীয় বাহন। ঠেংজানে করে বেহারাদের কাঁধে চড়ে ভ্রমন রাজশিক বটে কিন্তু আমার ভাল লাগেনি। আমার কিছু করারও নেই। তখন বিকল্পও কিছু ছিল না।
যাইহোক, সুদৃশ্য নতুন পায়জামা পাঞ্জাবি পড়ে ঠেংজানে করে গ্রামের উত্তর মোল্লাবাড়ী হয়ে মুরাদপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় এর সামনে দিয়ে পুরো গ্রাম ঘুরে দক্ষিণে ছমিউদ্দিন মোল্লাবাড়ীতে আমার নানাবাড়ি গিয়ে সবাইকে সালাম করে এবং সব ঘরে নারকেল চিনির শরবত, মিষ্টি, সেমাই খেয়ে ও সেলামি নিয়ে সন্ধ্যা নাগাদ বাড়ী ফিরে এলাম। তখন আমার হাতে নগদ ষোল টাকা এবং আটটি সোনার আংটি। নানাবাড়ির প্রত্যেক ঘর থেকেই চার আনা, আট আনা, এক টাকা করে সেলামী পেয়েছি এবং নানা নানীসহ একদম ঘনিষ্টজনরা দিয়েছেন সোনার আংটি।
আজকের গ্রামে সেই মাইক, সেই ঠেংজান- পালকি নেই। সেই রাত গভীরের লতা মঙ্গেশকরের- ঠান্ডা ঠান্ডা পানি - বা পাকিজার - চলতে চলতে..... অথবা নীনা হামিদের - আমার সোনার ময়না পাখীর মনোহর সুর আর শোনা যায় না। কী নষ্টালজিক জীবন।
এমবি//
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।