ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪

ঐতিহ্যের মুরাদপুর-৬

সরদার রেজাউল করিম

প্রকাশিত : ১৪:৫৬, ৩০ আগস্ট ২০২০

গতকালের লেখার পর অনেক বন্ধু শুভাকাঙ্ক্ষী দেশ-বিদেশ থেকে এত উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন যে, আমি অভিভূত হয়ে গেছি। বন্ধু জাফর, স্নেহভাজন কয়েকজন এবং বিদেশ থেকে এক বড়ভাইয়ের মন্তব্য পড়ে নিজেই আবেগাপ্লুত হয়ে গেছি। আমাদের এই স্যারদেরকে এখনো তাদের ছাত্ররা শ্রদ্ধাভরেই মনে রেখেছেন এটা ভেবে আমি মুগ্ধ। 

গতকাল প্রধান শিক্ষক জনাব ফয়েজ আহমেদ চৌধুরী স্যারের কথা শুরু করেছিলাম, শেষ হয়নি। আসলে তার সম্পর্কে আমি কি লিখতে পারি! আগেই বলেছি, তিনি ছিলেন শিক্ষকদের শিক্ষক। আমাদের ইংরেজি পড়াতেন। Wise man of the old এবং Three questions, এই দুটো পড়াতে তিনি পুরো ক্লাস নাইন শেষ করে দিয়েছেন। Wise man of the old পড়ার সময় তিনি যখন সক্রেটিস এবং এরিস্টটলের ঘটনা বলতেন তখন তাকেই আমরা সক্রেটিস মনে করতাম। এক সময় আঁড়ালে তার নামই হয়ে গেল সক্রেটিস। অত্যন্ত চৌকস ও কেতাদুরস্ত জনাব ফয়েজ আহমেদ চৌধুরী স্যার দেখতেও ছিলেন অনেক সুন্দর ও সুপুরুষ, বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ একজন মানুষ। 

আমার বাবা আমার স্কুলে গেছেন সাকুল্যে দুবার। প্রথমবার ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তির সময়, দ্বিতীয়বার ক্লাস নাইনে আমার ফরম ফিলাপের সময়। ক্লাস নাইনের প্রথম দিকে আমার ডাক পড়াতে প্রধান শিক্ষকের কক্ষে গিয়ে দেখি আমার বাবা স্যারের সামনে বসে আছেন। স্যার আমাকে বললেন,  ‘নাতী, তোমার দাদা ছিলেন একজন কৃষক, আমি তাকে দেখেছি। তিনি খুবই শান্ত প্রকৃতির একজন সম্পন্ন গৃহস্থ ছিলেন। ( উল্লেখ্য যে, আমার বাবার ৭/৮ বছর বয়সেই আমার দাদা মৃত্যুবরণ করেন, আমার বাবা ছিলেন তার শেষ বয়সের সন্তান)। সেখান থেকে তোমার বাবা এই স্কুল থেকে এসএসসি এবং নাসিরাবাদ পলিটেকনিক থেকে ডিপ্লোমা নিয়েছেন। সেখানে তার ছেলে হয়ে তোমাকে কমপক্ষে বিএ পাস  করতে হবে। তুমি আমাকে কথা দাও তুমি বিএ পাস করবে।’ স্যারের এ কথা আমার সবসময় মনে থাকবে। 

হ্যা, আমরা কখনো তার সাবজেক্টে পাস করতে পারিনি, অর্থাৎ ৩৩ তুলতে পারিনি কেউই। কিন্তু কিভাবে যেন এসএসসির ফাইনালে প্রায় সবাই পাস করে গেলাম। অবশ্য তিনি বলতেন আমার সাবজেক্টে যে ১০/১৫ পাবে তারা এসএসসিতে পার পেয়ে যাবে। হয়েছেও তাই। আমাদের সময়ে ১৯৭৪ সালে এসএসসিতে পাসের হার ছিল ২২ শতাংশ। এর আগে যুদ্ধপরবর্তী দুবছরের তিনটি পরীক্ষায় পাসের এবং নকলের যে মহোৎসব চলছিল আমাদের সময় এসে সেটা এমন টাইট দেয়া হলো যে, অনেকেরই নাভিশ্বাস হয়ে গেলো।

ছয়দিনে দশ সাবজেক্টের পরীক্ষা শেষ,  দিনে দুই সাবজেক্ট করে। আমার মনে আছে, অংক পরীক্ষার দিন পরীক্ষার হলেই আমার প্রচন্ড জ্বর এসে গেল। আমাকে পরীক্ষার হলে আনা নেয়ার জন্য রিকশা ছিল। আমাকে বাড়ি নিয়ে আসা হলো। এসেই আমি সরাসরি বিছানায়, সারারাত আর কিছুই বলতে পারিনা। বেহুসের মতোই ছিলাম সারারাত। পরদিন ছিল একাউন্টটিং পরীক্ষা। 

মা বাবার ধারণা ছিল, পরীক্ষা এবার আর দেয়া হবে না। কিন্তু সকালে নির্ধারিত সময়ে রিকশা এসে বেল বাজালে আমি উঠে কোনরকমে কাপড় পড়ে রিকশায় উঠে বসলাম। এতই কঠিন ছিল সেই পরীক্ষা। তারপরও আমরা আমাদের ফার্স্টবয় আফছার, সেকেন্ড বয় মঞ্জুকে নিয়ে বেশ আশা-ভরসায় ছিলাম।  কিন্তু পরীক্ষার এমন কড়াকড়ি আগে কেউ দেখেনি। একদম নতুন ও টাইট পরিবেশ।  তাদের প্রাপ্তি প্রথম বিভাগই, মেধাতালিকায় ছিল না। তখন সীতাকুণ্ড আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় এসএসসিতে কুমিল্লা বোর্ডের মেধাতালিকায় নাম থাকতো প্রায়। ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ, চিটাগাং কলেজিয়েট স্কুল, মুসলিম হাইস্কুল, কুমিল্লা জিলা স্কুল, ফেনী পাইলট হাইস্কুল এর সাথে প্রতিযোগিতা করে মেধাতালিকায় স্থান করে নেয়া ছিল এক বিশাল ব্যাপার! 

প্রিয় স্যারঃ মৌলভী মফজ্জল হক

তিনি আরবি পড়াতেন। কি যে আনন্দের ক্লাস ছিল সেটি! কখন কী পড়াতেন তিনি নিজেও জানতেন না। তার ক্লাসে ছেলেরা দুষ্টামিও করতো খুব বেশি। কেউ মার খায়নি এমন দিন খুব কম গেছে এই স্যারের ক্লাসে। ছেলেরাও স্যারকে জ্বালাতেন বেশি। বড় মহব্বতের স্যার ছিলেন তিনি। ষষ্ঠ ও সপ্তম তাঁর ক্লাস করেছি৷ কখনো পাশ করেছি কিনা মনে পড়ে না। তিনিও ছিলেন খুবই হাসিখুশিতে। এই সুযোগে আমরাও দুষ্টামীর সকল সুযোগ নিতাম ক্লাসে। মহান আল্লাহ এই দরদী শিক্ষককে জান্নাতুল ফেরদৌসের ফয়সালা করে দিন। 

প্রিয় শিক্ষক আলী হোসেন স্যার। বিশাল দেহের বেত হাতে আলী হোসেন স্যার হেটে আসছেন তবুও ছাত্ররা ভয় পাচ্ছে না!  কারণ ছাত্ররা জানতো  তিনি দেখতে যেমন বিশাল ছিলেন তেমনি কিন্তু স্যারের মনটাও ছিল বিশাল, মানুষ হিসেবে ছিলেন ঠিক তেমন, একদম অমায়িক। মুখে সবসময় হাসি লেগেই ছিল। তিনি ক্লাসে আমাদের এক একজনকে এক এক নামে ডাকতেন। বিচিত্র সেই সব নাম নিয়ে আমরা ক্লাসে হাসাহাসি করতাম। এত সাদাসিধা সোজা লোকটাকে অবসর জীবনে তাঁর এলাকার লোকজন (বারৈয়ারঢালা ইউনিয়ন) ধরে চেয়ারম্যান বানিয়ে দিয়েছে এবং এতেই তার সহায় সম্পদ সব গেছে বলে শুনেছি। কারণ তিনি ছিলেন শিক্ষক, তিনি কিভাবে চোরা পরিষদ চালাবেন! যদ্দিন পেরেছেন নিজের অর্থসম্পদ খরচ করে পরিষদ চালিয়েছেন। তাই, যা যাবার তা গেছে! মহান আল্লাহ তাকে বেহেশত নসিব করুন। 

এর মাঝে ক্লাস এইটের প্রথমদিকে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন জনাব আবু তাহের বিএসসি। তিনি প্রথম তিন মাসই ছিলেন। পরে স্বাধীনতা যুদ্ধ লেগে গেলে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। যুদ্ধ পরবর্তীতে তিনি আর শিক্ষক হিসেবে ছিলেন না।

আমাদের আরও একজন প্রিয় স্যার ছিলেন পন্ডিত স্যার, আমরা উনাকে জেঠামনি বলে ডাকতাম। তিনি সংস্কৃত পড়াতেন। সবসময় হাসিখুশিতে থাকতেন তিনি। কখনো কারো উপর রেগেছিলেন কিনা আমার জানা নেই। পরবর্তীতে তার কোন খবর আমি জানি না। 

আমাদের আরও অনেক প্রিয় শিক্ষক ছিলেন। ডেম স্মার্ট ক্লাস টিচার এবং ক্রীড়া শিক্ষক বাবু প্রবীর স্যার, ক্লার্ক কাম শিক্ষক বাবু দীপক স্যার, অংকের শিক্ষক বাবু নিতাই রঞ্জন স্যার, এরা ছিলেন ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে। অষ্টম, নবম, দশম শ্রেণিতে ছিলেন অলস্কোয়ার বাবু হরিবিলাশ স্যার, অংকের নজির আহমেদ স্যার, আরেকজন বশির আহমেদ স্যার, বাংলার লালবাবু স্যার, বিজ্ঞানের নির্মাণ স্যার, বিজ্ঞানের আরেক শিক্ষক জনাব রফিকুল ইসলাম, ভূগোলের আবুল কালাম স্যার। 

এদের মধ্যে শুধু নজির আহমেদ স্যার জীবিত আছেন। গতমাসে বাবু হরি বিলাস স্যার মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনমাস আগেও হরিবিলাস স্যারের সাথে আমার ঢাকায় দেখা হয়েছে। অন্যরা নিয়মের পরিক্রমায় এই জীবন ছেড়ে পরপারে চলে গেছেন। 

হে মহান আল্লাহ, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি, আমাদের এই শিক্ষকগণ অত্যন্ত সৎ, পরহেজগার, নিরহংকার, এবং নির্বিবাদী জীবনযাপন করেছেন। আপনি তাদেরকে আলমে বরযখে বেহেশতী হেফাজতে রাখুন এবং বিচারের দিনে বিনা হিসেবে জান্নাতুল ফেরদৌসের ফয়সালা করে দিন।

এমবি//


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি