ঢাকা, সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

ওহুদের যুদ্ধ ও মুসলমানদের শিক্ষা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১২:২৬, ২২ নভেম্বর ২০১৯ | আপডেট: ১২:৪৫, ২২ নভেম্বর ২০১৯

বদরের যুদ্ধে বাজেভাবে পরাজিত হয়ে মক্কার কুরাইশদের মনে প্রতিহিংসার আগুন দাউদাউ করে জ্বলছিল। যথাযথ প্রতিশোধ নেওয়ার আগ পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছিল না কুরাইশ নেতৃবৃন্দ। এক দিকে তাদের বীর যোদ্ধা আবু জেহেল ও উতবার মৃত্যু, অপরদিকে মুসলিমদের হাতে মার খাওয়া কোনটিই মেনে নিতে পারছিল না তারা। তাই দ্রুত আরও একটি যুদ্ধের আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে কুরাইশরা। হিজরী তৃতীয় সন। শাওয়াল মাস। কুরাইশ মুশরিকরা বদরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যে মদীনার দিকে অগ্রসর হয়। মদীনার প্রায় চার মাইল দূরে ওহুদ পাহাড়। কুরাইশ বাহিনী ওহুদ পাহাড়ের পাদদেশে তাদের ছাউনী ফেলে। তাদের যোদ্ধার একটি বাহিনী ওহুদের দিকে রওয়ানা হয়। যা বদর যুদ্ধের এক বছর পর সংঘটিত হয়। এ সময় যে যুদ্ধ হয় তা ‘ওহুদের যুদ্ধ’ নামে পরিচিত।

সংখ্যায় কম হওয়া সত্ত্বেও মুসলিমরা প্রথমদিকে সাফল্য লাভ করেছিল এবং মক্কার সৈনিকরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। বিজয়ের খুব কাছাকাছি থাকা অবস্থায় মুসলিম বাহিনীর কিছু অংশের ভূল পদক্ষেপের কারণে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। মুহাম্মাদ (সা) মুসলিম তীরন্দাজদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে ফলাফল যাই হোক তারা তাদের অবস্থান থেকে সরে না আসে। কিন্তু তারা অবস্থান ত্যাগ করার পর মক্কার বাহিনীর অন্যতম সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদ মুসলিমদের উপর আক্রমণের সুযোগ পান ফলে মুসলিমদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা তৈরী হয়। এসময় অনেক মুসলিম নিহত হয়। মুহাম্মাদ (সা) নিজেও আহত হয়েছিলেন। মুসলিমরা ওহুদ পর্বতের দিকে পিছু হটে আসে। মক্কার বাহিনীকে এরপর মক্কায় ফিরে আসে।

বদরের যুদ্ধের এক বছরের মধ্যে ‘ওহুদের যুদ্ধ’র প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। ৬২৫ সালের ১১ মার্চ ৩,০০০ সৈনিক নিয়ে গঠিত মক্কার বাহিনী আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে মদিনার দিকে যাত্রা করে। এই বাহিনীর সাথে ৩,০০০ উট ও ২০০টি ঘোড়া ছিল। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে উতবাসহ মক্কার ১৫জন নারীও যুদ্ধক্ষেত্রে আগমন করে। কুরাইশ নেতাদের ধারণা ছিল যে নারীরা সঙ্গে থাকলে তাদের সম্মান রক্ষার জন্য বেশি আমরণ লড়াইয়ের উদ্দীপনা তৈরী হবে। তারা সরাসরি মদিনা আক্রমণ না করে শহরের নিকটে আকিক উপত্যকা অতিক্রম করে কিছুটা ডানে ওহুদের নিকটবর্তী আয়নাইনে শিবির স্থাপন করে। হিন্দ বিনতে উতবা প্রস্তাব দেন যে মুহাম্মাদ (সা) এর মায়ের কবর যাতে ধ্বংস করে দেয়া হয়। কিন্তু এর পরিণাম ভয়াবহ হতে পারে ভেবে নেতারা প্রস্তাবে সম্মতি জানাননি।

কুরাইশদের যুদ্ধযাত্রার খবর মুহাম্মাদ (সা) এর কাছে পৌছায়। এরপর মদিনার বিভিন্ন স্থানে আকস্মিক আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। যুদ্ধের জন্য গৃহিতব্য পদক্ষেপ নিতে সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে মুহাম্মাদ (সা) নিজের দেখা একটি স্বপ্নের কথা জানান।

তিনি বলেন, ‘আল্লাহর শপথ আমি একটি ভালো জিনিস দেখেছি। আমি দেখি যে কতগুলি গাভী জবাই করা হচ্ছে। আরো দেখি যে আমার তলোয়ারের মাথায় কিছু ভঙ্গুরতা রয়েছে। আর এও দেখি যে, আমি আমার হাত একটি সুরক্ষিত বর্মে‌র মধ্যে ঢুকিয়েছি।’

এর ব্যাখ্যা হিসেবে তিনি বলেন, ‘কিছু সাহাবি নিহত হবে, তলোয়ালের ভঙ্গুরতার অর্থ তার পরিবারের কেউ শহীদ হবে এবং সুরক্ষিত বর্মে‌র অর্থ মদিনা শহর।’

তবে পদক্ষেপ নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে মতপার্থক্য ছিল। মুহাম্মাদ (সা) সহ কারো কারো মত ছিল শহরের ভেতর থেকেই প্রতিরোধ করা। কারণ মদিনা সুরক্ষিত শহর ছিল এবং প্রতিপক্ষ নিকটবর্তী হলে সহজে তাদের আক্রমণ করা যেত এবং নারীরা ছাদের উপর থেকে ইট পাটকেল ছুড়তে পারত। অন্যদিকে হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিবসহ কিছু সাহাবি ভিন্নমত দেন। তাদের দাবি ছিল এভাবে শহরের ভেতর থেকে প্রতিরক্ষা করলে শত্রুর মনোবল বৃদ্ধি পাবে এবং অগ্রসর হয়ে খোলা ময়দানে লড়াই করলে ভবিষ্যতে তারা সহজে আক্রমণ করতে সাহস করবে না।

এর ফলে মদিনার বাইরে গিয়ে শত্রুর মোকাবেলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। মুসলিম বাহিনীর মোট সেনাসংখ্যা ছিল ১,০০০। এর মধ্যে ১০০জন বর্ম পরিহিত ছিল এবং ৫০জন ছিল অশ্বারোহী। মুহাম্মাদ (সা) মুসলিম বাহিনীকে তিনভাবে বিভক্ত করেন। এগুলি হল, মুহাজির বাহিনী, আউস বাহিনী ও খাজরাজ বাহিনী। এই তিন বাহিনীর সেনাপতি ছিলেন যথাক্রমে মুসআব ইবনে উমায়ের, উসাইদ ইবনে হুজাইর ও হুবাব ইবনে মুনজির।

প্রায় ১,০০০ মুসলিমের বাহিনী মদিনা থেকে যুদ্ধের জন্য বের হয়। তারা শাওত নামক স্থানে পৌছানোর পর ইতিপূর্বে শহরের বাইরে গিয়ে যুদ্ধে অস্বীকৃতি জানানো আবদুল্লাহ ইবনে উবাই তার ৩০০ অনুসারী নিয়ে দলত্যাগ করে। এর ফলে ৭০০ সৈনিক নিয়ে মুসলিমরা ওহুদের দিকে যাত্রা করে। যাত্রাপথে প্রতিপক্ষের মুখোমুখি না হওয়ার জন্য ভিন্ন পথ অবলম্বন করা হয় এবং পথপ্রদর্শক আবু খাইসামা এসময় প্রতিপক্ষকে পশ্চিমে ছেড়ে দিয়ে বনি হারিসা গোত্রের শস্যক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে ভিন্ন একটি পথ অবলম্বন করে ওহুদের দিকে মুসলিম বাহিনীকে নিয়ে যান।

এরপর মুসলিমরা উপত্যকার শেষ প্রান্তের উহুদ পর্বতে শিবির স্থাপন করে। এই অবস্থানে মুসলিমদের সম্মুখে ছিল মক্কার বাহিনী ও পেছনে ছিল ওহুদ পর্বত এবং মদিনা ও মুসলিম বাহিনীর মধ্যবর্তী স্থানে মক্কার বাহিনী অবস্থান করছিল।

এই যুদ্ধে মাত্র সাত শত যোদ্ধা নিয়ে আল্লাহর রাসূল (সা) তিন হাজার যোদ্ধার সম্মুখীন হন। এই অসম যুদ্ধে মুসলিমরা বীর বিক্রমে লড়াই করেন। সত্তর জন মুসলিম শহীদও হন। আল্লাহর রাসূল (সা) গুরুতর আহত হন। যদিও যুদ্ধে কারোই চূড়ান্ত বিজয় হয়নি। তবে কুরাইশরা মদীনায় প্রবেশ না করেই ফিরে যায়।

ওহুদের যুদ্ধের পর মুমিনদের প্রশিক্ষণের জন্যে আল্লাহ বাণী পাঠান-

তার একাংশে বলা হয়; - ‘মন ভাংগা হয়ো না, চিন্তা ক্লিষ্ট হয়ো না। তোমারই বিজয়ী থাকবে যদি তোমরা সত্যিকার মুমিন হও। এখন যদি তোমাদের উপর কোন আঘাত এসে থাকে, ইতি পূর্বে অন্য দলের উপরও অনুরূপ আঘাত এসেছে। এটা তো কালের পরিবর্তন যা আমি মানুষের মধ্যে আবর্তিত করে থাকি।

এটা এজন্য এসেছে যে আল্লাহ দেখতে চান তোমাদের মধ্যে কারা খাঁটি মুমিন এবং তোমাদের মধ্যে থেকে কিছু শহীদ তিনি গ্রহণ করতে চান। যালিমদেরকে আল্লাহ মোটেই পছন্দ করেন না। এই পরীক্ষার মাধ্যমে খাঁটি মুমিনদেরকে আলাদা করে কাফিরদেরকে ধ্বংস করতে চান। তোমরা কি ভেবেছো যে তোমরা এমনিতেই জান্নাতে চলে যাবে অথচ আল্লাহ এখনো দেখেননি যে তোমাদের মধ্যে এমন কারা আল্লাহর পথে লড়াই করতে প্রস্তুত এবং কারা ছবর অবলম্বন কারী।

[আলে ইমরান : ১৩৯-১৪২]

ওহুদ যুদ্ধে যে সমস্ত শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে, সে সম্পর্কে আল্লাহ্ তা‘আলা সূরা আল-ইমরানের ১২১ নং আয়াত থেকে শুরু করে ১৬০ নং আয়াতের মধ্যে বর্ণনা করেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় শিক্ষা হচ্ছে মুসলমানদেরকে রসূলের কথা অমান্য করা, মতভেদ করা এবং ছত্রভঙ্গ হওয়ার মন্দ পরিণাম সম্পর্কে জানিয়ে দেয়া। যাতে তারা ভবিষ্যতে সতর্ক হয়ে যায় এবং যে সমস্ত বিষয় তাদের পরাজয়ের কারণ হতে পারে তা থেকে বিরত থাকে।

নাবী-রসূল ও তাদের অনুসারীদের ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তা‘আলার বিশেষ একটি হিকমত ও রীতি হচ্ছে তারা কখনও জয়লাভ করবে আবার কখনও পরাজিত হবে। তবে সর্বশেষে তাদেরই বিজয় হবে। সবসময় তাদেরকে বিজয় দান করলে সত্যিকার মুমিন ও অন্যদের মাঝে পার্থক্য করা সম্ভব হবেনা। আর সবসময় পরাজিত করলে নাবী-রসূল প্রেরণের উদ্দেশ্য সফল হবেনা।

‘তোমরা বর্তমানে যে অবস্থায় আছো, আল্লাহ মুমিনদের কখনও সেই অবস্থায় থাকতে দিবেন না। পাক-পবিত্র লোকদেরকে তিনি নাপাক ও অপবিত্রকে লোকদের থেকে আলাদা করেই ছাড়বেন। কিন্তু তোমাদেরকে গায়েবের খবর জানিয়ে দেয়া আল্লাহর রীতি নয়। কিন্তু আল্লাহ্ তাঁর রসূলদের মধ্যে হতে যাকে ইচ্ছা বাছাই করে নেন। সুতরাং আল্লাহর উপর এবং তাঁর রসূলগণের উপর তোমরা ঈমান আনয়ন কর। তোমরা যদি বিশ্বাসী হও এবং তাকওয়া অবলম্বন কর, তাহলে তোমাদের জন্যে রয়েছে বিরাট প্রতিদান।’

অর্থাৎ মুমিন ও মুনাফিকরা যেভাবে একসাথে মিশ্রিত অবস্থায় আছে, আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে সে অবস্থায় রেখে দিবেন না। বরং তিনি প্রকৃত মুমিনদেরকে মুনাফেকদের থেকে আলাদা করবেন। যেমন তিনি করেছিলেন উহুদ যুদ্ধের দিন। আল্লাহ্ তা‘আলা কাউকে গায়েবের খবর অবগত করেন না। কেননা গায়েবের মাধ্যমেই তিনি বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীদের মধ্যে পার্থক্য করেন। আল্লাহ্ তা‘আলা চেয়েছেন যে, বাহ্যিকভাবেও যেন বিশ্বাসী ও মুনাফেকদের মধ্যে পার্থক্য হয়ে যায়। আর ওহুদ যুদ্ধে তাই হয়েছিল।

সূত্র : বিভিন্ন ইসলামী পুস্তক ও ইন্টারনেট

এসএ/

 

 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি