কক্লিয়ার ইমপ্লান্টে বদলে গেছে অর্পার জীবন [ভিডিও]
প্রকাশিত : ১৭:৫৮, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ | আপডেট: ১৮:৫২, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮
অর্পা
মিরপুর বাংলা স্কুল এন্ড কলেজের ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী সুমাইয়া তাসনিম খান অর্পা। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। অর্পা`র বয়স যখন দুই বছর তখন তার বাবা মা বুঝতে পারলেন তাদের মেয়ে কিছুটা অস্বাভাবিক। শব্দ শুনলে সাড়া দেয় না। অন্য শিশুদের মতো সহজে ডেকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায় না।
তাকে নিয়ে যাওয়া হলো ডাক্তারের কাছে। ডাক্তাররা নানা ধরনের পরীক্ষা করে জানালেন, অর্পা কানে শুনতে পায় না। সে কখনো কানে শুনতে পাবে না। যেকোনো বাবা মায়ের মানসিক অবস্থা তখন যেমন হয় অর্পা`র বাবা মায়ের অবস্থাও তেমনি হলো। মাথায় ভেঙ্গে পড়লো আকাশ। চোখে মুখে শুধুই অন্ধকার। এমন সুন্দর চঞ্চল একটা মেয়ে সারা জীবন প্রতিবন্ধীত্ব নিয়ে বেঁচে এটি তারা মেনে নিতে পারছিলেন না।
অর্পার মা-বাবা এখানে-ওখানে মেয়েকে নিয়ে ছোটাছুটি করছেন। এমন সময় জানতে পারলেন কক্লিয়ার ইমপ্লান্টের কথা। অর্পার বাবা-মাকে অনেকে পরামর্শ দিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নাক কান গলা বিভাগের অধ্যাপক ডা. আবুল হাসনাত জোয়ারদার- এর শরনাপন্ন হওয়ার জন্য।
অনেকের পরামর্শ মতো অর্পার বাবা মা মেয়েকে নিয়ে ডা. আবুল হাসনাত জোয়ারদার- এর কাছে গেলেন। ২০০৯ সালে ডা. আবুল হাসনাত জোয়ারদার অর্পার কানে কক্লিয়ার ইমপ্লান্টের মাধ্যমে একটি ডিভাইস প্রতিস্থাপন করেন। প্রতিস্থাপনের একুশ দিন পর নিয়মানুযায়ী ডিভাইসটির সুইচড অন করা হয়। এর পর অর্পাকে স্বাভাবিক নিয়মে স্পিচ থেরাপী দেওয়া হয়। তারপর থেকে অর্পা অন্য স্বাভাবিক শিশুদের মতো শুনতে পারে।
ধীরে ধীরে বয়স অনুযায়ী সে বলতেও শিখে। অর্পা প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পায়। পড়ালেখার পাশাপাশি তাঁর ছবি আকার হাত বেশ ভালো।
অর্পার মা লায়লা বেগম কান্নাজড়িত কন্ঠে একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে বলেন, আমরা যখন মেয়েকে নিয়ে অন্ধকার সমুদ্রে হাতড়াচ্ছি তখন কক্লিয়ার ইমপ্লান্টের খবর আমাদের আশার আলো দেখায়। আল্লাহর অশেষ রহমতে আমরা আমাদের মেয়েকে নিয়ে ভীষণ আশাবাদী।
ইনশাল্লাহ সে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবে। জানা যায়, কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট নামক ডিভাইসটি প্রতিস্থাপনের পর তাকে নিয়ম অনুযায়ী স্পিচ থেরাপী দেওয়া হয়। এরপর থেকে সে ধীরে ধীরে বলতেও শিখে। রাতে ঘুমানোর সময় ও গোসলের সময় ডিভাইসটি খুলে রাখতে হয়। ফলে এ সময় সে কোনো কিছু শুনে না।
অন্যদিকে প্রতিরাতে ঘুমানোর সময় যখন ডিভাইসটি খুলে রাখা হয় তখন ডিভাসের ব্যাটারীতে ইলেকট্রিকের চার্জ দিয়ে রাখা হয়।
জানা যায়, এই ডিভাইস ব্যবহারে অর্পাকে কোন ধরনের অস্বস্তিতে ভুগতে হয়না। এর কোনো ধরনের ক্ষতিকর দিক নেই বলেও দাবি করেন অর্পা`র মা লায়লা বেগম।
কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট কি: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ডেভলপমেন্ট অব কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট গ্রোগ্রাম ইন বিএসএমএমইউ’ এর কর্মসূচি পরিচালক ও ইমপ্লান্ট সার্জন অধ্যাপক ডা. আবুল হাসনাত জোয়ারদারের নেতৃত্বে একটি টিম ২০১০ সাল থেকে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারি ব্যবস্থাপনা করে আসছে।
বাংলাদেশে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট চিকিৎসায় পথিকৃত বিএসএমএমইউর অধ্যাপক ডা. আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ শ্রবণ প্রতিবন্ধী রোগীদের দেখছেন।
বাংলাদেশে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারিতে পথিকৃত এই চিকিৎসক এই সম্পর্কে জানান, কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট বা বায়োনিক ইয়ার হলো শ্রবণ সহায়ক অত্যাধুনিক এমন একটি ইলেকট্রনিক ডিভাইস যা মারাত্মক বা সম্পূর্ণ বধির ব্যক্তিকে শব্দ শুনতে সহায়তা করে। ইমপ্লান্ট চালুর পর বধির ব্যক্তির কাছে তখন পৃথিবীটা শব্দময় হয়ে ওঠে। কক্লিয়ার ইমপ্লান্টের দুটি অংশ- একটি অংশ কানের বাইরে থাকে, যে অংশে থাকে মাইক্রোফোন, স্পিচ প্রসেসর ও ট্রান্সমিটার এবং আরেকটি অংশ কানের ভেতরে থাকে, যে অংশে থাকে রিসিভারস্টিমুলেটর এবং ইলেকট্রোড। অপারেশনের মাধ্যমে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট অন্তঃকর্ণের কক্লিয়াতে স্থাপন করা হয়।
মাইক্রোফোনের মাধ্যমে গৃহিত শব্দ এনালগ ইলেকট্রিক সিগনালে পরিবর্তিত হয়। স্পিচ প্রসেসর সেই সিগনালকে প্রসেসিং করে কোডেড ডিজিটাল সিগনালে রূপান্তর করে। ট্রান্সমিটার কয়েলের মাধ্যমে কোডেড সিগনাল রেডিও ফ্রিকোয়েন্সির মাধ্যমে ইন্টারনাল রিসিভার স্টিমুলেটরে প্রেরিত হয়। রিসিভার স্টিমুলেটর সেই কোডেড সিগনালকে ইলেকট্রিক ইমপালসে পরিবর্তিত করে ইলেকট্রোডে প্রেরন করে। ইলেকট্রোড ইলেকট্রিক ইমপালসকে অডিটরী নার্ভের মাধ্যমে মস্তিস্কে প্রেরন করে এবং মস্তিস্ক সেই ইমপালসকে শব্দ হিসেবে চিহ্নিত করে। ফলে শ্রবন প্রতিবন্ধী ব্যাক্তি শব্দ শুনতে পায়।
জানা গেছে, একটি টিমওয়ার্কের মাধ্যমে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট সেবা প্রদান করা হয়। এই টিমের মধ্যে থাকে ইএনটি সার্জন, অডিওলজিস্ট, স্পিচ থেরাপিস্ট বা অডিটরিভারবাল থেরাপিস্ট, সাইকোলজিস্ট ও সমাজকর্মী। বিভিন্ন রোগে অন্তঃকর্ণের ক্ষতিগ্রস্ত কক্লিয়ার জন্য কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা তা নিশ্চিত হতে শিশু বা ব্যক্তির শ্রবণ বধিরতার মাত্রা দেখার জন্য প্রথমে কিছু অডিওলজিক্যাল ও রেডিওলজিক্যাল টেস্ট করা হয়। এই টেস্টের রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারির। এর পর রোগীর সাইকোলজিক্যাল ও জেনারেল অ্যানেসথেসিয়ার উপযুক্ততার জন্য কিছু টেস্ট করা হয়। কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারির ২-৩ সপ্তাহ পর অডিওলজিস্ট সুইচ অন এবং ম্যাপিং করে যথার্থ শব্দ শোনার বিষয়টি নিশ্চিত হয়। তারপর ইমপ্লান্ট গ্রহিতাকে শব্দ শোনা ও ভাষা শেখানো হয় বা হ্যাবিলিটেশন করে স্পিচ থেরাপিস্ট।
ডা. জোয়ারদার জানান, শুধু কক্লিয়ার স্থাপনের মাধ্যমেই এই চিকিৎসা শেষ নয়। রোগীকে ফলোয়াপে থাকতে হবে। কোনো সময় কোনো সমস্যা দেখা দিলে টিমের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। তিনি জানান, দেশের বাইরেও এই অত্যাধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি চালু আছে। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে রোগীরা এই টিমের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন।
অা অা// এআর/