করোনা তাণ্ডবের তিন কারণ
প্রকাশিত : ১৮:২৩, ১৩ মে ২০২০ | আপডেট: ১৮:২৫, ১৩ মে ২০২০
করোনা ভাইরাস ও মায়ের কোলে রহিমা- ছবি সংগৃহিত।
ঠিক চল্লিশ বছর আগে ৮ মে বিশ্ব গুটি বসন্তমুক্ত বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। পৃথিবীর সর্বশেষ গুটি বসন্তের রোগী ছিল বাংলাদেশের ভোলার কুড়ালিয়া গ্রামের ভোলার রহিমা বানু। উপরের ছবিটি রহিমার (তার মায়ের কোলে), ১৯৭৫ সালের অক্টোবর। বহু মানুষের আত্মত্যাগে, অনেক বিজ্ঞানীর অক্লান্ত পরিশ্রমে, একাধিক বিশ্ব নেতার অঙ্গীকারের যৌথ ফসল ছিল মানব জাতির এ অর্জন। ক্ষুদ্র স্বার্থকে দূরে রেখে, সীমিত রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে, বৈশ্বিক সংহতির এক হিরন্ময় প্রতীক এটি।
আজ ‘করোনা সন্ত্রাস’ কালে উপর্যুক্ত কথাগুলো সত্যিই অর্থময় ও প্রাসঙ্গিক। সন্দেহ নেই, তেজ ও তাণ্ডবের দিক থেকে করোনা সারা বিশ্বকে দিশেহারা করে করে ফেলেছে, মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে এটা জীবন ও জগতের চিত্র বদলে দিয়েছে। গত কয়েক দশকে এমনতরো সঙ্কট তো আরো হয়েছে। তা’হলে আমরা এমন বিপর্যস্ত কেনো? তিনটে কারণ বোধ হয় প্রাসঙ্গিক।
এক, এর ব্যাপ্তি ও তীব্রতা। সাম্প্রতিক দশকসমূহের সঙ্কটগুলোর মতো করোনা সঙ্কট দেশজ বা আঞ্চলিক নয়, এটি বৈশ্বিক। এ পর্যন্ত ২১২টি দেশ ও ভূখন্ড এর শিকার হয়েছে। সেই সঙ্গে এর তীব্রতাও লক্ষণীয়। একদিনের স্বল্প প্রকোপ থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে এটি একটি তাণ্ডবে পরিণত হতে পারে। দু’মাস আগে বৃটেনে করোনা মৃত্যু ছিল ৩০০ এর মতো। আজ তা ৩০ হাজার ছাড়িয়েছে।
দুই, এর সম্পর্কে এক অজানা আতঙ্ক এবং এর সংক্রমণ্যতা। কোথা দিয়ে কেমন করে যে এটা আক্রমণ করবে তার পুরো প্রক্রিয়াটি আমাদের এখনো অজানা। এ যেন এক অদৃশ্য শত্রু। এ আগুনে পোড়ে না, ঠাণ্ডায় মরে না। ক্ষেত্র বিশেষে বেঁচে থাকে ২৪ থেকে ৭২ ঘন্টা। সংক্রমিত হলে মানব শরীরের নানান অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নষ্ট করে মৃত্যু পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায়।
তিন, এর কোন প্রতিষেধক বা চিকিৎসা নেই। এখনও করোনা সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা নিতান্ত সীমিত। ফলে একে রুখবার কৌশলগুলোও নিতান্ত নাজুক ও ভঙ্গুর। ফলশ্রুতি, এ পর্যন্ত ৭০০ কোটি মানুষের বিশ্বে ৪০ লাখ মানুষের সংক্রমণ ও প্রায় ৩ লাখ মানুষের মৃত্যু করোনার কারণে।
পুরো ব্যাপারটিকে একটু ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত থেকে দেখা যাক। ১৯১৮ সালে বিশ্বে স্প্যানিশ ফ্লুর সংক্রমণ দেখা গিয়েছিল। ১৮৬ কোটি মানুষের বিশ্বে ৫০ কোটি মানুষ তাতে আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং প্রাণ হারিয়েছিলেন ৫ কোটি। বোঝাই যাচ্ছে, সে সময়ে স্প্যানিশ ফ্লুর তেজ ও তীব্রতা কতোটা ভয়ংকর ছিলো।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার তেজ ও তীব্রতা হারিয়ে স্প্যানিশ ফ্লু দুর্বল হয়ে সাধারণ ফ্লুতে পরিণত হয়েছে, যার সংক্রমণ প্রতিবছরই হয়। আমরা যাকে ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ফ্লু বলি, সে ওই মহাপরাক্রমশালী স্প্যানিশ ফ্লুরই দুর্বল বংশধর। সে আরও অসহায় হয়ে পড়েছে ফ্লুর প্রতিষেধক আবিষ্কারে। তবুও আজ ৭০০ কোটি মানুষের বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৩০ থেকে ৫০ লাখ মানুষ সাধারণ ফ্লুতে আক্রান্ত হয় এবং প্রায় ৫ লাখ মানুষ এতে মৃত্যু বরণ করে।
এতো কথা বলার উদ্দেশ্য তিনটিই। এক, আজ এতো ভয়াবহ হলেও সময়ের অনুক্রমণিকায় এটাও দুর্বল হয়ে ‘ভিজে বেড়ালে’ পরিণত হবে। আগামী দিনে এরও পরিণতি হবে কোন সাধারণ ফ্লুতে। তখন সে আর ভয়ংকর কিছু বলে প্রতীয়মান হবে না। আমার নিজের মনে হয়, কয়েক মাসের মধ্যেই এ বছরের মতো করোনা বিলীন হয়ে যাবে এবং খুব সম্ভবত: আবার সে নতুন করে আত্মপ্রকাশ করবে।
দুই, সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা দিক থেকে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যু ব্যাপ্তি কিন্তু পূর্বের সংকটের তুলনায় অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে তাৎক্ষণিক স্বল্পকালীন সময়ে বিরাট অঘটন এটা ঘটায়। সুতরাং আতঙ্ক সংক্রমণেও এর জুড়ি নেই। কিন্তু তারপরেও চূড়ান্ত ফলাফলের ক্ষেত্রে অনেপক্ষ ও আপেক্ষিক উভয় দৃষ্টিভঙ্গী থেকে এর মরণঘাতী প্রভাব অন্যান্য আগের সঙ্কটের তুলনায় ব্যতিক্রমধর্মী নয়। তবে মানুষের মৃত্যু মানে একটি সংখ্যা বা উপাত্ত শুধু নয়, এর সঙ্গে জড়িত একটি মানব জীবন, একটি পরিবার, একটি জনগোষ্ঠী।
তিন, সারা বিশ্বে করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্যে সর্বাত্মক একটি প্রচেষ্টা চলছে। বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা আলাদা ও যৌথভাবে রাতদিন এ লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন। কোথাও কোথাও পরীক্ষামূলক ভাবে নবতর টীকাগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে একদল সাহসী স্বেচ্ছাসেবকের ওপরে। বহুকাল আগে একদিন যেমন গুটিবসন্তের প্রতিষেধক বেরিয়েছে, তেমনি আগামী কোন এক নব প্রভাতে করোনার প্রতিষেধকও বেরুবে।
এখন যা প্রয়োজন তা হচ্ছে, বিশ্বের সব দেশে করোনার বিরুদ্ধে চলমান প্রতিরোধ অব্যাহত রাখা, নতুন করে প্রতিঘাতের দেয়াল নির্মাণ এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে বৈশ্বিক একটি সংহতি গড়ে তোলা। সে সংহতির বিস্তার ঘটাতে হবে নানান দেশের মধ্যে একটি সহায়তার কাঠামো বিনির্মিত করে। যার একটি মূল কেন্দ্র হবে প্রতিষেধকের জন্যে আন্ত:রাষ্ট্র সহযোগিতা। আজকের এ সঙ্কটের ব্যাপ্তি বৈশ্বিক এবং সে কারণে প্রয়াসটিও হতে হবে বৈশ্বিক। সারা মানবজাতির সে প্রয়াসের মধ্যেই আমাদের মুক্তি। এ মুহূর্তে শঙ্কিত আমরা নিশ্চয়ই হতে পারি, কিন্তু নিরাশ হওয়ার কোন সঙ্গত কারণ আমাদের নেই।
লেখক- বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক ও কলামিস্ট।
এনএস/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।