করোনাকাল ও স্বাস্থ্য সেবার হাল!
প্রকাশিত : ২২:২২, ১০ জুন ২০২০ | আপডেট: ২২:৪০, ১০ জুন ২০২০
রাত পৌনে একটা। হঠাৎ অপির কলিগ হাসান ভাইয়ের ফোন। তার বন্ধু ফেরদৌস বাপ্পি’র করোনা পজেটিভ। বাসায় অক্সিজেন নিচ্ছেন। কিন্তু সিলিন্ডার শেষের পথে। আর মাত্র ২ ঘণ্টা চলবে। এরপর? দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। চেষ্টা করছেন তারা। কিন্তু কোথাও ফাঁকা নেই। কী করা যায়? বাধ্য হয়ে এত রাতে ফোন করেছেন।
তার কাছ থেকে নাম্বার নিয়ে কথা বললাম ফেরদৌস বাপ্পি ভাইয়ের স্ত্রী জেরিনের সাথে। বাপ্পি ভাই মিডিয়াতে খুব পরিচিত একটা মুখ। যারা বিতর্ক, কুইজ করেন তারা সবাই তাকে চেনেন। বিটিভিতে প্রায়ই দেখা যায় তাকে। সদা হাস্যোজ্জ্বল চেহারাটা মনে পড়ে গেল। জেরিন জানান, চেষ্টা করছেন তিনি। কিন্তু এত রাতে কোনো হাসপাতাল খালি পাচ্ছেন না। সব রোগী ভর্তি।
দেখছি বলে ফোন রাখলাম। রাত তখন প্রায় ১টা। এত রাতে কাকে কাকে ফোন করবো ভাবতে ভাবতেই প্রথমে করলাম সাংবাদিক নজরুল কবীরকে। নিজেকে বললাম, এত রাত বড় কথা না, একটা মানুষের প্রাণ আগে। নজরুল ভাই টকশোতে ছিলেন। বিরতির সময় বেরিয়ে এসে ফোন করলেন। বললাম হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে রোগী। হলি ফ্যামিলিসহ যেখানে হয়। বললেন দাঁড়ান জানাচ্ছি। অপেক্ষায় রইলাম। মিনিট সেকেন্ড টিকটিক করে চলে।
হাতে সময় কম। কী করবো বুঝছি না। শুধু মনে হচ্ছে একটা হাসপাতাল দরকার। এই পৃথিবীর একটা মানুষের অক্সিজেন কমে আসছে। তিনি নিঃশ্বাস নিতে পারছেন না। বাঁচতে চাচ্ছেন। তাকে বাঁচাতে হবে। মনে হতেই তার টেনশনে বুকের ভেতর দম যেন আমারই আটকে আসছে। জোরে শ্বাস নিয়ে ম্যাসেন্জারে নক করলাম হলি ফ্যামিলিতে ভর্তি বিটিভির রিপোর্টার খালিদ আহসানকে। যদি ও কিছু সাহায্য করতে পারে। খালিদ নিজেই করোনায় আক্রান্ত। এত রাতে বেচারা হয়তো ঘুমে আছে। দেখতে পাচ্ছে না ম্যাসেজ। নক করলাম আমাদের বিপদে সবসময় যে মানুষটা সারাক্ষণ হাসিমুখে থাকেন সেই হেলথ অ্যান্ড হোপের ডা. লেলিন ভাইকে। সোয়া একটায় নক করার সাথে সাথে যথারীতি তিনি সাড়া দিলেন। তবে খুব দুঃখ নিয়ে জানান, হাসপাতালের সব বেড ভর্তি। একটাও খালি নেই। অনুরোধ করলেন কাল সকালে আসতে পারবো কিনা। না এখনি লাগবে জানাতেই পরামর্শ দিলেন স্পেশালাইজড হসপিটালে ফোন করতে।
নেট ঘেটে নাম্বার নিলাম। পরিচয় দিয়ে ভর্তি করতে বললাম। ওরা বিনীতভাবে জানালো একটাও বেড নেই। কিছুই করতে পারবে না। বললো ল্যাবএইড, শাহাবুদ্দিন, স্কয়ার, আনোয়ার খান মর্ডানে চেষ্টা করতে। সব হাসপাতালে ফোন দিলাম- না, কোথাও বেড নেই। অপির দিকে তাকালাম। সময় বয়ে যাচ্ছে। অক্সিজেন শেষ হয়ে আসছে একটা মানুষের। কিছুই কী করার নেই?
হঠাৎ মনে হলো ব্রডকাষ্ট জার্নালিষ্ট সেন্টার, বিজেসির কথা। বিজেসি গ্রুপে গিয়ে নাম্বার নিলাম ৭১ টিভির হুদা ভাইয়ের। ঘড়ির দিকে তাকালাম? বিরক্ত হবে? হোক বিরক্ত। দোটানায় কিছুটা ভুগে ফোন দিলাম। ফোন ব্যস্ত। একটু খুশিই হলাম। যাক ঘুমিয়ে পড়েননি। হুদা ভাই ফোন দিলেন। বললাম যেভাবে হোক হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে এক করোনা পেসেন্টেকে। উনি পরামর্শ দিলেন, বিজেসির হোয়াটসআপ গ্রুপে লিখতে। কেউ না কেউ নক করবে। লিখলাম টেক্স। মুহূর্তেই এটিএনের সাংবাদিক মানস দা লিখলেন রোগীর সব তথ্য দিন। ভর্তি করা যাবে। নিজের নাম্বারও দিলেন তিনি। আমার চোখে পানি চলে এলো। সেই মুহূর্তে দেবদূতের মতো মনে হলো মানসদাকে।
এবার নক করলাম জেরিনকে। উনি তখন জানালেন আমরা আজগর আলি হাসপাতালে যাচ্ছি। ওখানে এইমাত্র সিট পেলাম। আপনাকে জানাবো সে সময় আপনি ফোন দিলেন। একটা পাথর নামলো যেন বুকের ভেতর থেকে। যাক সিট পেয়েছেন। রাত তখন প্রায় ৩টা। নজরুল ভাই ফোন দিলেন। বললাম ভর্তি হতে পেয়েছেন তারা।
একটা অদ্ভূত রাত যেন গেল আমার। বসে বসে ভাবতে লাগলাম বাপ্পি ভাই এত পরিচিত একজন মানুষ। কত যোগাযোগ তার। অথচ করোনায় অসুস্থ হওয়ার পর একটা বেডের জন্য কী চেষ্টাটাই না করতে হয়েছে ওনার স্বজনদের। ওই রাতেই বুঝতে পারলাম যত যোগাযোগই থাক, হাসপাতালে সিট না থাকলে কত অসহায় হয়ে পড়ে আপনজন। ওই রাতে যতগুলো হাসপাতালে ফোন করেছি সবাই অপারগতা প্রকাশ করেছে রোগী ভর্তি নিতে। কেউ কেউ জানিয়েছেন কেউ একজন মারা গেলে বা সুস্থ হলে তবেই সিট পাওয়া সম্ভব। কী ভয়াবহ কথা। প্রিয়জন অসুস্থ হলে আমরা কী তবে অপেক্ষায় থাকবো অন্য কারো প্রিয়জন চলে যাক? তবেই পাবো আমি সিট?
কী হাল আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার। আজ ফেসবুকে দেখলাম বরিশালের এক প্রখ্যাত চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়ে এ্যাপোলো, স্কয়ার, আনোয়ার খান মর্ডান, ল্যাবএইড ঘুরেও সিট পাননি। পরে অন্য এক হাসপাতালে ভর্তি হয়ে মারা যান। যেটুকু তথ্য জানলাম বরিশালে সেই চিকিৎসকেরই অনেক বড় একটা হাসপাতাল রয়েছে। সব সুবিধা নেই বলে ওনি বাধ্য হয়েছেন ঢাকায় আসতে। ঢাকার অবস্থাও তথৈবচ।
ক্ষুব্ধ হই যখন দেখি আমাদের দেশে স্বাস্থ্যের সাথে জড়িতরা শুধু ভবন বানিয়ে গেছেন। আর হাজার কোটি টাকা দিয়ে জিনিস কিনেছেন। দক্ষ হাতে সেগুলো ব্যবহার না করে ফেলে রেখে নষ্ট করেছেন। আবার কিনেছেন। কেউ দেশের মানুষের কথা ভাবেননি। শুধু নিজের কথা ভেবেছেন। অসৎ সব মানুষদের খেসারত আজ দিতে হচ্ছে ১৬ কোটি মানুষকে। আজ আমাদের হিসেব কষে ভাবতে হয় অসুস্থ হলে আমি কোন হাসপাতালে যাব, কোন হাসপাতালে সব ধরনের সাপোর্ট আছে। সাথে এও ভাবতে হয় ওই হাসপাতালের খরচ আমি বহন করতে পারবো তো?
স্বাস্থ্য সেবা পাওয়া আমার মৌলিক অধিকার। স্বাস্থ্য বিষয়ে তথ্য জানা, স্বাস্থ্য বিষয়ে সেবা পাওয়া ও স্বাস্থ্য বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার আমার রয়েছে। অথচ সে অধিকারের গোড়ায় গলদ। এই যে প্রতিমাসে সৎ ভাবে উপার্জন করে আমরা কর দেই। তার বিনিময়ে রাষ্ট্র কেন আমাদের এই মৌলিক অধিকারটুকু নিশ্চিত করবে না? আমাকে কেন রাতের পর রাত টেনশনে থাকতে হবে হাসপাতালে ভর্তি নিয়ে? একবার কলকাতায় যাচ্ছি। বিমানবন্দরে এক কর্মকর্তা জানান প্রতিদিন বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৫/ ৬ হাজার মানুষ চিকিৎসা নিতে সেখানে যান। বাইরোডের হিসেবটা আর কষলাম না। এদেশে ৪ হাজার রোগীর জন্য একজন ডাক্তার। সেই ডাক্তার তার সাধ্যমতো চেষ্টা করেন সেবা দিতে। করোনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো কী নাজুক আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা।
সুপ্রিয় বন্ধুরা, এখনই সচেতনতা দরকার। নিজেদের কেউ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে যেন পাগল পাগল না লাগে। আসুন সর্তক হই। সব হাসপাতাল, অ্যাম্বুলেন্সের ফোন নাম্বার সব হাতের কাছে রাখুন। কারা কারা আপনাকে সহায়তা করতে পারে তার সম্ভাব্য লিষ্টও করে রাখুন। প্রয়োজনে ডাক্তার বন্ধুদের সহায়তা নিন পরামর্শের জন্য। টাকা পয়সা, মাস্ক পিপিই স্যানিটাইজার সব কাছে রাখুন।
এ শহরে প্রিয়জন অসুস্থ হলে কত ঝড় যায় সে শুধু তারাই বোঝে। বাপ্পি ভাই আমাকে চেনেন না, অথচ সে রাতে মনে হচ্ছিলো এ শহরে আমারই যেন কোন ভাই অক্সিজেনের অভাবে রয়েছে। সে কষ্ট পাবে তা হতে দেয়া যায় না।
নিজের ছোট ভাই রাসেল আর আম্মাকে নিয়ে অনেক হাসপাতাল ঘুরেছি। কত যে অভিজ্ঞতা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিকার নিয়ে পিএসটিসিতে এ্যাডভোকেসির কাজ করেছি প্রায় সাড়ে ৩ বছর। আজো বুঝলাম না এ অধিকার কিভাবে পাওয়া যায়। বাজেটে স্বাস্থ্যখাতের মোটা অংকের বরাদ্দ কোথায় যায়, কী হয়, নাগরিক হিসেবে জানা হয় না কিছুই। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখি আমাদের দেশের বড় বড় মানুষেরা স্বাস্থ্যসেবা নিতে বিদেশ যান। তাদের প্রাণের মূল্য হয়তো রাষ্ট্রের কাছে বেশি। কিন্তু রাষ্ট্রের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমার সবুজ গ্রামের ঝর্না ফুপু কিংবা আগুনে পুড়ে যাওয়া কিশোরী মরিয়মের সেবা পাওয়ার অধিকারের দাবিও কিন্তু কম না।
করোনা আজ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে অনেক তো হলো এবার থামো। মানুষ ও প্রকৃতির জন্য করো কিছু। সেবা নিতে বিদেশ নয়, দেশেই করো বিশ্বমানের সেবা। এবারের বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্ধের ব্যবহার যথাযথ হোক এ প্রত্যাশা ও দাবি সবার।
লেখক: সাংবাদিক
এমবি//
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।