করোনাকালে সুস্থ থাকতে কি খাবেন?
প্রকাশিত : ১৭:১৭, ৪ এপ্রিল ২০২১ | আপডেট: ২১:১৯, ৪ এপ্রিল ২০২১
এই করোনাকালে সুস্থ দেহ-মনের জন্যে প্রয়োজন একটি জোরদার ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা। আর এই দেহ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে তুলতে চাই আমাদের খাদ্যের সচেতনতা। দৈনন্দিন খাওয়ার ক্ষেত্রে নিতান্তই ছোট ছোট কিছু পদক্ষেপ আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে করে তুলতে পারে অধিকতর কার্যকরী। ভাইরাসের বিরুদ্ধে মূল লড়াই করে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউন সিস্টেম। এই ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী থাকলে বাইরের ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া কিছু করতে পারে না।
মূলতঃ সঠিক ও সুষম খাদ্যাভ্যাস কার্যকর রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। যা আমাদের দেহ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে সর্বতোভাবে কর্মক্ষম করে তোলে। যে-কোনও ক্ষতি কাটিয়ে পুরো প্রক্রিয়াকে মেরামত ও পুনরুদ্ধার করে। নানা রকম সংক্রমণ ও অসুস্থতার বিরুদ্ধে আমাদের দেয় সংহত সুরক্ষা। সব মিলিয়ে বলা যায়, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার একটি বড় উৎসই হলো- সুস্থ ও বিজ্ঞানসম্মত খাদ্যাচার। আর পর্যাপ্ত ভিটামিন, খনিজ এবং আঁশ জাতীয় খাবারের আধিক্যই আমাদের প্রতিদিনের খাবারকে করে তোলে স্বাস্থ্যকর।
অনেকগুলো গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে- মেডিটেরেনিয়ান বা ভূমধ্যসাগরীয় খাদ্যাভাস এক্ষেত্রে অন্যতম। স্থূলতা, হৃদরোগ, হাড়ক্ষয়, ডায়াবেটিস, পার্কিনসন্স, আলঝেইমার এমনকি ক্যান্সার প্রতিরোধে যার রয়েছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। ১.৫ মিলিয়ন মানুষের ওপর বড় পরিসরে পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, এ খাদ্যাভ্যাস করোনারি হৃদরোগ এবং সেই সাথে অকাল মৃত্যুর হার কমায়।
ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে প্রচলিত খাদ্যতালিকায় আধিক্য রয়েছে মূলতঃ ফলমূল, শাকসবজি, সালাদ, হোল গ্রেইন বা পূর্ণখাদ্যশস্য (বাদামি চাল, আটা ইত্যাদি), বাদাম, ডাল-শিম-বীজ-মটরশুঁটি জাতীয় খাবার, টক দই এবং দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, সামুদ্রিক মাছ, চর্বিহীন মাংস (ন্যূনতম)। এরকম একটি খাদ্যতালিকা এখানে তুলে ধরা হলো।
দৈনন্দিন খাবারে ভাত, মাছ ও গোশতের পরিমাণ সীমিত রাখুন। সবুজ সবজি সালাদের পরিমাণ বাড়িয়ে দিন। করলা বাঁধাকপি ডাঁটা লালশাক পুঁইশাক সজনেসহ মৌসুমি ও আঁশজাতীয় সবজি পর্যাপ্ত পরিমাণে খান। আধা সেদ্ধ শাকসবজি সহজে হজম হয়। প্রতিদিন সালাদ খান। সালাদে লেটুস, টমেটো, ধনে পাতা, পুদিনা পাতা, গাজর, শশা, লাল বাঁধাকপি, ক্যাপসিকাম রাখুন। সামুদ্রিক মাছ খাওয়ার অভ্যাস বৃদ্ধি করুন।
খিচুড়ি প্রাণিজ আমিষের বিকল্প। সকালের নাশতা হিসেবে দু-বছর বয়সী শিশু থেকে পূর্ণবয়স্ক সবার জন্যেই লাসা/ ঢিলা সবজি-খিচুড়ি আদর্শ খাবার হতে পারে। চিনির পরিবর্তে গুড় এবং ময়দার পরিবর্তে লাল আটা খান। অথবা দুই-তৃতীয়াংশ গমের সাথে এক-তৃতীয়াংশ ভুট্টা মেশানো আটার রুটি খান।
সপ্তাহে দুই দিন শুধু নিরামিষ খান। গোশত মাসে চার দিনে সীমিত রাখুন। পাতলা ডালে উপকার বেশি। মসুরি মুগ মাশ বুট মটর অড়হরসহ যে-কোনো ডাল প্রতিদিনের খাবারে পরিমিত রাখুন। রাতে মসুর ডাল না খাওয়া ভালো। নিয়মিত মাশরুম খান। শীতকালে পালংশাক টমেটো ব্রোকোলি ও গাজর খান। গরমের দিনে সকালে ও দুপুরে শশা বা ক্ষীরা খান, রাতে খাবেন না।
খাবারে অতিরিক্ত তেল, মশলা, টেস্টিং সল্ট, কাঁচা লবণ, ঝাল ও ভাজাপোড়া বর্জন করুন। রেস্তোরাঁ ও বাইরের খাবার যত কম খাবেন তত ভালো। ভোজ্যতেলের ধরন যা-ই হোক না কেন কম-বেশি সবই চর্বিবর্ধক। তাই তরকারিতে পরিমিত তেল ব্যবহার করুন।
ফাস্ট ফুড, জাংক ফুড, প্রক্রিয়াজাত ও প্যাকেটজাত কৃত্রিম খাবারে রয়েছে কালার, ফ্লেভার, টেস্টার এবং এডিক্টিভ উপাদান। নিয়মিত এসব খাবার গ্রহণ শরীরের মেদ বৃদ্ধি ছাড়াও ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। হাড়, দাঁত ও চোখের জটিলতা, এমনকি কিডনি ও মূত্রাশয়ের ক্যান্সার সৃষ্টির কারণ হতে পারে।
সফট ড্রিংকস আপনার শরীরের জন্যে অত্যন্ত হার্ড। সফট ড্রিংকস বা কোমল পানীয়ের প্রতিটি চুমুক আর্সেনিকের মতোই ধীরে ধীরে শরীরের অন্তর্গত শক্তি ক্ষয় করে। শরীরের মেদ বৃদ্ধি ও আসক্তি সৃষ্টি ছাড়াও এ পানীয় হাড়ক্ষয়, অকাল বার্ধক্য, বদহজম, শ্বাসকষ্ট, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার রোগ সৃষ্টি করে এবং কিডনির বিনাশ ঘটায়।
এনার্জি ড্রিংকসের উচ্চমাত্রার ক্যাফেইন আপনার নার্ভাসনেস, বদমেজাজ, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, পেশির খিঁচুনি, অনিদ্রা, মাথাব্যথা, শ্বাসকষ্ট ছাড়াও সন্তানধারণে জটিলতা, এমনকি সন্তানধারণে অক্ষমতার কারণ হতে পারে। কোমল পানীয় ও এনার্জি ড্রিংকস নিজে পান করা ও অন্যকে পরিবেশন করা থেকে বিরত থাকুন।
বিকেলে নাশতা হিসেবে গোল আলু, মিষ্টি আলু সেদ্ধ করে খান। মাসে এক-আধবার কেক খেলেও ঘরে তৈরি কেক খান। ওজন কমাতে তেলে-ভাজা খাবার, কেক বিস্কুট চকলেট আইসক্রিম এবং বিকেলে নাশতার পর্ব পরিহার করুন। নিয়মিত সব ধরনের বাদাম খাওয়ার অভ্যাস করুন।
পানীয় হিসেবে ডাবের পানি পান করুন। ডাব না পেলে লেবু পানি পান করুন। গরমের তাপদাহ কমাতে তেঁতুল-গুড়ের শরবত পান করুন। দেহের রেচন প্রক্রিয়াকে স্বাভাবিক রাখার জন্যে প্রতিদিন কমপক্ষে ছয় গ্লাস বা দেড় লিটার পানি পান করুন। খালি পেটে চা বা কফি পান করবেন না। দুধ-চায়ের পরিবর্তে হালকা লিকার চা/ ‘গ্রিন টি’ বা গুড়-চা পান করুন।
পানীয়ের রাজা চুম্বক পানি। নিয়মিত চুম্বক পানি পানে হজমশক্তি ও ক্ষুধা বাড়ে, এসিডিটি হ্রাস পায়, আলসার ও মূত্রাশয়ের ব্যাধি নিরাময় হয়, গলব্লাডার ও কিডনিতে পাথরসহ দেহে অপ্রয়োজনীয় কোনোকিছু জমাট বাঁধতে পারে না।
দেশীয় মৌসুমি ফল পর্যাপ্ত খান। মৌসুমি ফল সে মৌসুমের রোগব্যাধির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। প্যাকেটজাত ফলের জুসের পরিবর্তে দেশীয় ফল খান। টিনজাত, প্রক্রিয়াজাত ও পরিশোধিত খাবার বর্জন করুন। আনারস নিয়মিত খাওয়া শুরু করুন। ফ্লু থেকে মুক্ত থাকবেন। তবে খালি পেটে আনারস খাবেন না।
লিভারের সমস্যা থাকলে বেশি করে জাম খান। আর ডায়াবেটিস থাকলে জামের সাথে সাথে বিচিও চিবিয়ে খান। ফলের মহারাজা কাঁঠাল বলকারক, রোগ প্রতিষেধক এবং রং ফর্সাকারক। হজমের অসুবিধা হলে ৮/১০ কোষ কাঁঠাল খেয়ে একটি বিচি চিবিয়ে শুধু রসটুকু খান, ছোবা ফেলে দিন।
এ সময়ে প্রতিদিন সকালে নাশতার সাথে কালোজিরা ও সমপরিমাণ রসুনের পেস্টের মধ্যে এক চা-চামচ মধু মিশিয়ে খাওয়ার অভ্যাস করুন। আবার আলাদা, আলাদাভাবেও খেতে পারেন। ঠাণ্ডা-সর্দিতে তুলসী পাতার রসে মধু মিশিয়ে তিন বার গরম লোহার সেক দিয়ে তা পান করুন।
নিয়মিত চিনি ছাড়া দই (ইয়োগার্ট) খান। মিষ্টি দই না খাওয়া ভালো। মিষ্টি, বিশেষত রং দেয়া মিষ্টি খাবেন না। খাবারের কৃত্রিম রং ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। তামাক পাতা, জর্দা, সুপারি ওরাল বা মুখের ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। দাঁত ও মাড়িকে মজবুত করতে সবসময় নরম খাবার না খেয়ে চিবুতে হয় এমন শক্ত খাবার (আখ, পেয়ারা, হাড় ইত্যাদি) খাওয়ার অভ্যাস করুন।
প্রতিদিন ৫/১০ গ্রাম স্পিরুলিনা খান। প্রচুর প্রোটিন, বিটা কেরোটিন ও লৌহ সমৃদ্ধ এ খাবার দেহকোষকে প্রাণবন্ত করে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
পুষ্টির জন্যে নিয়মিত এক চা-চামচ মধু, এক গ্লাস দুধ ও একটি ডিম খান। দুধ হজমে অসুবিধা হলে বা গ্যাস ফর্ম করার প্রবণতা থাকলে এক গ্লাস দুধে দুই-তৃতীয়াংশ পানি মিশিয়ে নিন। সকালে একমুঠো ভিজানো কাঁচা ছোলা ও এক টুকরো আদা এক চিমটি বিট লবণসহ খাওয়ার অভ্যাস করুন। পুষ্টিগুণ বজায় রাখতে মাড়সহ ভাত রান্না করুন। শাকসবজি ভালোভাবে ধুয়ে তারপর কাটুন। ডিম আধা সেদ্ধ না করে পুরো সেদ্ধ করুন। ভাজি করলে দুই পিঠ ভালোভাবে ভাজুন। কারণ কাঁচা বা আধা সেদ্ধ ডিমে টাইফয়েডের জীবাণু সক্রিয় থাকে।
পরিশ্রমজনিত দুর্বলতা কাটাতে কিংবা তাৎক্ষণিক এনার্জি পেতে দুই-তিনটি খেজুর খেয়ে এক গ্লাস পানি পান করুন। সম্ভব হলে সপ্তাহে একদিন অথবা ১৫ দিনে একদিন রোজা বা উপবাস করুন। এতে হার্টবিট ও রক্তচাপ কমবে; ডায়াবেটিস—এমনকি মস্তিষ্কের বয়সজনিত রোগগুলোর ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করবে।
সেহরিতে সামান্য সবজি-ভাত কিংবা খেজুর-কলা খান। প্রোটিন-জাতীয় খাবার পানির তৃষ্ণা বাড়ায় বলে তা পরিহার করুন। ভাজাপোড়া বাদ দিয়ে শুধু খেজুর-পানি দিয়ে ইফতার করুন। মাগরিবের নামাজের পর রাতের খাবার (মাছ-মাংস-ডালসহ অন্যান্য সুষম খাবার) খেয়ে নিন। এ খাদ্যাভ্যাস পুরো রমজানে আপনাকে সারাদিন ঝরঝরে রাখবে, পানির তৃষ্ণা কম হবে।
প্রার্থনা খাবারের তৃপ্তি বাড়ায়। তাই খাওয়ার আগে প্রার্থনা করুন। আর খাওয়া শেষে বলুন, শোকর আলহামদুলিল্লাহ/ থ্যাংকস গড/ হরি ওম বা প্রভু ধন্যবাদ, বেশ তৃপ্তির সাথে খেয়েছি। সকল প্রশংসা আল্লাহর। তিনিই রিজিকদাতা! তিনি আমাদের পানাহার করিয়েছেন এবং বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
এককথায় আপনার ধর্মবিশ্বাস ও রুচি অনুসারে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খান। রাজসিক-তামসিক খাবারের প্রতি আসক্তি বর্জন করুন। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে খাওয়ার অভ্যাস করুন। সকালে ভরপেট নাশতা করুন, দুপুরে তৃপ্তির সাথে খান, সন্ধ্যার পর পরই রাতের হালকা খাবার গ্রহণ করুন। রাতে চর্বিদার-গুরুপাক খাবার (গরু-খাসী-পাঁঠার মাংস, বিরিয়ানি/ কাচ্চি) গ্রহণ এবং খেয়েই শুয়ে পড়া দুঃস্বপ্ন বা হার্ট অ্যাটাকের কারণ হতে পারে। কী পরিমাণ খাবেন তা নির্ধারণ করবে আপনার পাকস্থলীর আয়তন। চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, পাকস্থলীর এক তৃতীয়াংশ খাবার, এক তৃতীয়াংশ পানীয় দ্বারা পূর্ণ করা এবং বাকি এক তৃতীয়াংশ ফাঁকা রাখা স্বাস্থ্যসম্মত। এতে ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকবে। ‘চোখের খিদে’কে সংযমের সাথে দমন করুন। ভোজনরসিক নয়। শুধু খিদে লাগলেই খাবেন। কিছুটা খিদে রেখেই খাওয়া শেষ করবেন।
এএইচ/