করোনার মত মহামারি আগামীতে আরও হবে : গবেষণা
প্রকাশিত : ১৫:০০, ১০ জুন ২০২০
পৃথিবীতে যে সভ্যতা গড়ে উঠছে, তাতে বন্যপ্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে রোগ সংক্রমণ এবং তারপর তা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ার ‘নিখুঁত ব্যবস্থা’ গড়ে উঠেছে। প্রাকৃতিক জগতে মানুষের অনুপ্রবেশ সেই প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করছে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
এমন কথা বলছেন সেই সব বিশ্বের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা, যারা কোথায় এবং কীভাবে নতুন রোগের বিস্তার ঘটে তা নিয়ে গবেষণা করছেন। এই প্রয়াসের অংশ হিসেবে তারা একটি পদ্ধতি তৈরি করেছেন, যাতে রোগ বিস্তার প্রক্রিয়ায় কী কী সাদৃশ্য দেখা যায় তা চিহ্নিত করা যায়। এই পদ্ধতিটির নাম দেওয়া হয়েছে প্যাটার্ন রিকগনিশন।
এ পদ্ধতির ফলে পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব যে, কোন কোন বন্যপ্রাণী মানুষের জন্য সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এর ফলে ভবিষ্যতে কোন ধরনের রোগবিস্তার ঘটতে যাচ্ছে, তার জন্য প্রস্তুত থাকার এক বৈশ্বিক প্রয়াস এটি। এই গবেষণার নেতৃত্ব দিচ্ছেন যুক্তরাজ্যের লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা।
লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ম্যাথিউ বেলিস বলেছেন, “গত ২০ বছরে আমরা ৬টি বড় বড় হুমকির সম্মুখীন হয়েছি। এর মধ্যে সার্স, মার্স, ইবোলা, এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং সোয়াইন ফ্লুর মতো পাঁচটি বুলেট এড়াতে পেরেছি। কিন্তু ছয় নম্বরটার হাত থেকে এখনও বাঁচতে পারিনি। আর এটাই যে আমাদের সম্মুখীন হওয়া শেষ মহামারি, তা মোটেও নয়।”
অধ্যাপক বেলিস আরও বরেন, “বন্যপ্রাণী থেকে মানবদেহে আসা রোগগুলোর দিকে আরও গভীরভাবে নজর দিতে হবে। সে উপলক্ষেই প্যাটার্ন-রিকগনিশন পদ্ধতি তৈরি করা হয়েছে, যার সাহায্যে আমরা বন্যপ্রাণী থেকে আসা যত রোগের কথা জানি তার সবগুলোর উপাত্ত অনুসন্ধান করতে পারবো।”
এ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা হাজার হাজার ব্যাকটেরিয়া, প্যারাসাইট বা পরজীবী এবং ভাইরাস সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। অধ্যাপক বেলিসের পদ্ধতি দিয়ে কোন কোন অণুজীব মানুষের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে তা চিহ্নিত করা গেলে বিজ্ঞানীরা আগেই তা ঠেকানোর উপায় উদ্ভাবনের গবেষণা চালাতে পারবেন।
অধ্যাপক বেলিস বলছেন, ঠিক কোন রোগ মহামারির চেহারা নিতে পারে তার গবেষণা সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার। কিন্তু আমরা এই প্রথম পদক্ষেপটির ব্যাপারে অগ্রগতি ঘটাতে পেরেছি। বিজ্ঞানীরা একমত যে, বন ধ্বংস এবং বন্যপ্রাণীর আবাসসভূমিতে মানুষের ঢুকে পড়ার ফলে এখন ঘন ঘন এবং সহজেই প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে
রোগ ছড়িয়ে পড়ছে।
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক কেট জোনস বলছেন, মানুষ যেভাবে ইকোসিস্টেমকে বদলে দিয়ে কৃষি বা বৃক্ষরোপণ করছে, তাতে জীববৈচিত্র কমে যাচ্ছে এবং মানুষের নানা সংক্রমণে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি বাড়ছে বলেই তারা তথ্যপ্রমাণ পাচ্ছেন।
তিনি বলছেন, অবশ্য সব রোগের ক্ষেত্রেই এমন হচ্ছে তা নয়। কিছু প্রজাতির ইঁদুর অনেক সময় রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীব ছড়ানোর ক্ষেত্রে বড় ভুমিকা রাখছে। এছাড়া
জীববৈচিত্র হারানোর ফলে মানুষ ও বন্যপ্রাণীর ঝুঁকিপূর্ণ সংস্পর্শ বেড়ে যাচ্ছে। তাতে কিছু কিছু ভাইরাস, ব্যকটেরিয়া বা প্যারাসাইট মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাচ্ছে।
মালয়েশিয়ায় ১৯৯৯ সালে নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল এক ধরনের বাদুড় দিয়ে এই সংক্রমণ ছড়িয়েছিল বনভূমির প্রান্তে থাকা একটি শূকরের খামারে। ফলের
গাছে এসে জঙ্গলের বাদুড় ফল খেতো। তাদের আধা-খাওয়া ফল মাটিতে পড়লে তা খেতো শূকর। ওই ফলে লেগে থাকতো বাদুড়ের মুখের লালা– যা থেকে শূকরের দেহে সংক্রমণ হয়। এই সংক্রমিত শূকরের দেখাশোনা করতো খামারের ২৫০ জনেরও বেশি কর্মী। ফলে তাদের দেহেও দেখা দিল ভাইরাস সংক্রমণ। তাদের মধ্যে ১০০ জনেরও বেশি লোকের মৃত্যু হয়।
কোভিড-১৯ ভাইরাসে মৃত্যুর হার সম্পর্কে এখনো গবেষণা চলছে। তবে অনুমান করা হয়, যত লোক করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয় তার প্রায় ১ শতাংশ মারা যায়। আর নিপাহ ভাইরাসের ক্ষেত্রে মারা যায় সংক্রমিতদের ৪০ থেকে ৭৫ শতাংশ।
লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয় ও কেনিয়ার আন্তর্জাতিক গবাদিপশু গবেষণা কেন্দ্রের অধ্যাপক এরিক ফেভরে বলছেন, যেসব এলাকায় রোগের প্রাদুর্ভাবের উচ্চ ঝুঁকি সেসব জায়গায় গবেষকদের সার্বক্ষণিক নজর রাখতে হবে। অস্বাভাবিক কোন কিছু দেখলেই তার বাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে। মানব বসতি আছে এমন জায়গায় প্রতিবছর তিন থেকে চার বার নতুন রোগের উদ্ভব হয়। শুধু এশিয়া বা আফ্রিকা নয়, ইউরোপ বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও এটা হচ্ছে।
অধ্যাপক বেলিস বলেন, নতুন রোগের ব্যাপারে নজরদারির গুরুত্ব এখন আরও বেড়ে যাচ্ছে। আমরা এখন পৃথিবীতে মহামারি ছড়ানোর জন্য প্রায় আদর্শ পরিবেশ সৃষ্টি করে ফেলেছি। এই কথার সঙ্গে একমত অধ্যাপক ফেভরেও। তার কথা, করোনাভাইরাসের মতো ঘটনা আগামীতে বার বার ঘটতে পারে। সূত্র : বিবিসি
এএইচ/