করোনার শততম দিন ও বদলে যাওয়া বাংলাদেশ
প্রকাশিত : ১১:৪৮, ১৫ জুন ২০২০ | আপডেট: ১২:১১, ১৫ জুন ২০২০
এক
আমরা যে যার ধর্মই পালন করি না কেন, প্রতিটি ধর্মের মূলে রয়েছে সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য আর ভালবাসা। আস্থা এবং বিশ্বাসের উপর পরিচালিত হয় ধর্ম। যারা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী তারা হয়ত অনেকেই জানেন, কেয়ামতের দিন মহান আল্লাহ তায়ালা সবাইকে পুনরুজ্জীবিত করবেন। সবার হিসেব নিকেষ শুরু হবে। চারিদিকে দৌড়াদৌড়ি শুরু হবে। সবাই ‘ইয়া নাফসি, ইয়া নাফসি’ অর্থাৎ ‘আমার কী হবে, আমার কী হবে ’ করতে থাকবে। এদিন সবাই থাকবে উলঙ্গ। কিন্তু সবাই এতটাই ব্যস্ত থাকবে যে কেউ কারও দিকে তাকানোরও সময় পাবে না। এমনকি বাবা তার সন্তানের দিকে তাকাবে না, মা তার ছেলেকে চিনবে না, ভাই তার বোনের পরিচয় দিবে না।
কথাগুলো বলার কারণ হলো- করোনা মহামারির এই বর্তমান সময়ের সাথে ওইদিনের কিছুটা মিল খুঁজে পাই। কারণ আমাদের অবস্থা এতটাই খারাপ যে, মাহামারি আকার ধারণ করা করোনা ভাইরাসের কারণে এতোদিনের ভালবাসার প্রিয় মানুষ নিজের স্ত্রী তার স্বামীকে পর করে দিচ্ছে, স্বামী তার স্ত্রীকে পর করে দিচ্ছে, সন্তান তার বাবাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। এককথায় যাদেরকে আপনি জীবনের চেয়েও বেশি ভালবাসেন তারাও আপনাকে পর করে দিচ্ছে যদি আপনি অদৃশ্য শত্রুর শিকার হন। যদিও বিচার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এছাড়া আমাদের আর কোনো উপায়ও নেই।
দুই
ভোরবেলা। পাখির কিচির মিচির শব্দ। ফজরের নামাজ পড়ে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে একটু রাস্তায় হাটব বলে বের হয়েছি। বাসার গেট খুলতেই দেখি চিৎকার-চেচামেচি। তাড়াতাড়ি করে বাইরে বের হয়ে দেখি পাশের বাড়ি থেকে শব্দ। বাসার নিচে সিএনজি। করোনায় আক্রান্ত রোগী। খুব কষ্ট পাচ্ছে। হাসপাতালে নিয়ে যাবে। রোগীকে বাইরে বের করা হচ্ছে। রোগীর চিৎকারে প্রকম্পিত হচ্ছে এলাকা। কেউ কাছে ভিড়ছে না। এরই মধ্যে করোনা রোগী দেখে পালিয়েছে সিএনজি চালক। এবার পার্শ্ববর্তী হাসপাতালে ফোন। অ্যাম্বুলেন্স দরকার। এদিকে রোগীর অবস্থা খুব খারাপ। রোগীর একজন আত্মীয় সাথে আছেন। তিনিও নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখছেন। গোটা এলাকা নিঃস্তব্ধ। সবাই জানালার ফাঁক দিয়ে উকি মেরে দেখছে। একটা মানুষ কিভাবে মারা যাচ্ছে। কিন্তু কারও কিছুই করার নেই। আসলেই তো কিছু করার নেই। কে কাছে যাবে? কে ঝুঁকি নেবে?
অবশেষে যা হবার তাই হলো- অ্যাম্বুলেন্স আসার আগেই না ফেরার দেশের পাড়ি দিলেন ওই ব্যক্তি। এমন দৃশ্য দেখে সকাল বেলা খুব মনটা খারাপ হলো। নিজের অজান্তেই বার বার মনে হলো এটাই জীবন, এটাই বাস্তবতা। আমাদের সবাইকেই চলে যেতে হবে এই দুনিয়া ছেড়ে। তাহলে কেন আমাদের এতো অহংকার? এতো দাম্ভিকতা?
তিন
করোনার হটস্পট ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ। এই তিন এলাকার মানুষ মানেই আলাদা একটু আতঙ্ক। কারণ এই তিন এলাকার মানুষই সবচেয়ে বেশি করোনার শিকার। বলা চলে সারাদেশে করোনা ছড়ানোতে অনন্য ভূমিকা পালন করেছে এই তিন এলাকা।
ঢাকায় বসবাস করার সুবাদে করোনার এই পরিস্থিতিকে নতুনভাবে অনূভব করেছি। জীবনে এ পর্যন্ত দুএকটি ঈদ গ্রামের বাড়ি ছাড়া করেছি। ঈদে গ্রামের বাড়ি না গেলে মনে হয় না ঈদ। শত ব্যস্ততা আর কষ্ট করে হলেও ঈদ গ্রামের বাড়িতে করতাম। কিন্তু এবার হয়েছে তার উল্টো। লকডাউনের মধ্যে শতভাগ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এবার ঈদে বাড়িতে যাব না। ঢাকাতেই ঈদ করব। আমার নিজেরই কোনো ইচ্ছা ছিল না যে এবার গ্রামের বাড়িতে ঈদ করব। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো ঈদে বাড়ি যাওয়ার জন্য গ্রামের বাড়ি থেকে কোনো জোরাজুড়ি ছিল না, ছিল না কোনো আবদার। কথাগুলো বলার একটাই কারণ আমাদের মাঝে বিরাজমান এই করোনার আতঙ্ক আপন মানুষগুলোকেও পর করে দিচ্ছে। যদিও এসবের বাস্তবতাও আছে।
চার
করোনা আমাদের একঘরে আর সেলফিশ করে তুলেছে। প্রাণঘাতি এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির লাশ পর্যন্ত কেউ ছুঁতে পারছে না। প্রিয়জনরা শেষ দেখাটাও দেখতে পারছে না। জানাজা দিতে পারছে না। মনে হচ্ছে কেউ কারও আপন নয়। একজন আরেকজনের সাথে কথা বলতেও ভয় পাচ্ছি। কেউ কাছে আসলে দূরে সরে যাচ্ছি। এ এক নতুন পৃথিবী।
বর্তমানে করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি আমাদের সবারই জানা। এক অদৃশ্য শত্রু এ অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে সারাবিশ্ব আজ যুদ্ধরত। প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। মৃত্যুর মিছিলে শামিল হচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। থমকে গেছে বিশ্ব, বন্ধ হয়ে গেছে সব আনন্দ, ক্ষমতার দাপট, শক্তিধর রাষ্ট্রনায়কদের হুঙ্কার। পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র, আধুনিক সমরাস্ত্রসমৃদ্ধ রাষ্ট্র, মহাকাশজয়ী বিজ্ঞানীসহ চিকিৎসা বিজ্ঞানও আজ করোনার কাছে পরাস্ত।
গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর চীনের হুবেই প্রদেশের উহান থেকে উৎপত্তি হওয়া প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। বাদ যায়নি ইউরোপ-আমেরিকাও। এশিয়া মহাদেশেও এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কম নয়। তবে আক্রান্ত ও মৃত্যুর মিছিল ইউরোপের চেয়ে তুলনামূলক এশিয়ায় কম। এদিক থেকে এশিয়ার হটস্পট পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত। দেশটিতে হু হু করে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। ইতিমধ্যে ভারত ইউরোপের অনেক দেশকেই ছাড়িয়ে গেছে। ছাড়িয়ে গেছে চীনকেও।
পাঁচ
বাংলাদেশে আজ করোনার শততম দিন। আজ থেকে একশ দিন আগে অর্থাৎ ৮ মার্চ দেশে প্রথম কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয় এবং করোনায় প্রথম রোগীর মৃত্যু হয় ১৮ মার্চ। সরকারি হিসেব অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত এই প্রাণঘাতি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন এক হাজার ১৭১ জন। আক্রান্তের সংখ্যা ৮৭ হাজার ৫২০ জন। এছাড়া সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন মোট ১৮ হাজার ৩৩১ জন।
প্রতিদিনই বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যু সংখ্যা। দীর্ঘ হচ্ছে লাশের সারি। টানা ৬৬ দিন লকডাউন থাকলেও করোনা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। মানুষের জীবন-জীবিকা নির্বাহের জন্য খারাপ পরিস্থিতিতেও সরকারকে বাধ্য হয়ে তুলে দিতে হয়েছে লকডাউন। এমনই এক পরিস্থিতিতে করোনায় বিপর্যস্ত দেশের মানুষ।
প্রাণঘাতি এই করোনা ভাইরাস বিশ্ব থেকে কবে বিদায় নেবে তা এখনো কেউ ঠিক করে বলতে পারছে না। প্রতিমুহূর্তে ভেসে আসছে মৃত্যুর খবর। দেশের বর্ষীয়াণ রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে বিশিষ্ঠজনরা কেউই বাদ যাচ্ছেন না এই মুত্যুর মিছিল থেকে। লাশের মিছিলে বিশ্ব এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত হচ্ছে। বিশ্ব এখন আর্থিকভাবে পঙ্গু, সামাজিকভাবে বিপদগ্রস্থ এবং মনুষ্য জাতি এখন মানসিকভাবে অস্থির হয়ে উঠছে। প্রিয়জন, আপনজন দূরে সরে যাচ্ছে। আত্মীয় স্বজন পর করে দিচ্ছে। দুনিয়াটা প্রতিনিয়ত সংকুচিত হয়ে আসছে।
কঠিন এই পরিস্থিতিতে ইতালির প্রধানমন্ত্রী জুসেপ্পে কন্তে বলেছিলেন, ‘আমরা সমস্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছি। আমরা শারীরিক ও মানসিকভাবে মারা গেছি। আর কী করতে হবে তা আমরা জানি না। পৃথিবীর সমস্ত সমাধান শেষ হয়ে গেছে। এখন একমাত্র সমাধান আকাশের কাছে।’ তার এ বক্তব্য বিশ্ববাসীর হৃদয়কে নাড়া দিয়েছিল। আমাদেরও আজ একটাই প্রার্থনা-হে প্রভু অশান্ত পৃথিবীকে শান্ত করে দাও, সবার মাঝে ফিরে দাও ভালবাসা, সৌহার্দ্য আর সম্প্রীতি।
লেখক: সাংবাদিক
এমবি//
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।