করোনারি হৃদরোগ কী?
প্রকাশিত : ১৮:৪৫, ১৬ আগস্ট ২০২৩
মানবদেহ স্রষ্টার এক অপূর্ব সৃষ্টি। মহাবিশ্বে এত চমৎকার, এত বুদ্ধিমান, এত সৃজনশীল, এত সংবেদনশীল আর কোনো সৃষ্টির অস্তিত্ব এখন পর্যন্ত পাওয়া যায় নি। এ মানবদেহেরই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ হচ্ছে হৃৎপিন্ড। বুকের মাঝখানে দুই ফুসফুসের মাঝে এটি অবস্থিত।
হৃৎপিন্ডের গঠনের দিকে তাকালে দেখা যাবে, এর রয়েছে চারটি প্রকোষ্ঠ। ওপরের দুটিকে বলা হয় অ্যাট্রিয়াম বা অলিন্দ এবং নিচের দুটিকে বলা হয় ভেন্ট্রিকল বা নিলয়। আর হৃৎপিন্ড চারপাশে পেরিকার্ডিয়াম নামক একটি আবরণী দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে।
হৃৎপিন্ডকে আমরা বলতে পারি—এটি একটি পাম্প, যা একজন মানুষের জীবদ্দশায় প্রায় সাড়ে চার কোটি গ্যালনের চেয়ে বেশি রক্ত পাম্প করে থাকে। প্রতিদিন প্রায় এক লক্ষবার হৃৎস্পন্দনের মাধ্যমে হৃৎপিন্ড দেহের প্রতিটি কোষে প্রয়োজনীয় পুষ্টি ও অক্সিজেন পৌঁছে দিচ্ছে। আর এটি সম্ভব হচ্ছে ধমনী শিরা উপশিরা ও ছোট ছোট রক্তনালী মিলিয়ে প্রায় ৬০ হাজার মাইল পাইপলাইনের মধ্য দিয়ে।
কেউ কেউ মনে করেন, হৃদয় আর হৃৎপিন্ড অভিন্ন অস্তিত্ব। আসলে তা নয়। হৃৎপিন্ড সম্পর্কে বলা যায়, এটি একটি মাংসপিন্ড। আর হৃদয় একটি চেতনাগত অস্তিত্ব—যাকে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না; তবে এটি আমাদের অনুভূতিতে সাড়া দেয় ও প্রভাবিত হয়। হৃৎপিন্ড আর হৃদয় পরস্পর গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত এবং হৃদয় দ্বারা হৃৎপিন্ড দারুণভাবে প্রভাবিত হয়। বইয়ের পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে এ সম্পর্কে আমরা বিস্তারিত জানব।
আমরা জেনেছি, পাম্প করে সারা শরীরে রক্ত সরবরাহই হৃৎপিন্ডের অন্যতম প্রধান কাজ। মজার ব্যাপার, হৃৎপিন্ডের নিজের কোষ ও পেশিগুলোর সুস্থভাবে বেঁচে থাকা এবং কর্মক্ষম থাকার জন্যেও দরকার পর্যাপ্ত অক্সিজেন ও পুষ্টি। এ পুষ্টি পৌঁছে দেয়ার কাজটি সাধিত হয় রক্তের মাধ্যমে।
হৃৎপিন্ডে রক্ত সরবরাহের গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করে করোনারি ধমনী। হৃৎপিন্ডের প্রধান দুটি করোনারি ধমনী হলো যথাক্রমে বাম ও ডান করোনারি ধমনী বা লেফ্ ট মেইন করোনারি আর্টারি ও রাইট করোনারি আর্টারি। লেফ্ ট মেইন করোনারি আর্টারি আবার একটু নিচের দিকে এসে দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে—লেফ্ট অ্যান্টেরিয়র ডিসেন্ডিং আর্টারি (এলএডি) ও লেফ্ট সারকামফ্লেক্স আর্টারি (এলসিএক্স)।
হৃৎপিন্ডের অনেক ধরনের রোগ হয়ে থাকে। এর মধ্যে বর্তমানে সারা পৃথিবীতে যে রোগটি সর্বাধিক দুর্ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সেটি করোনারি আর্টারি ডিজিজ(Coronary artery disease) বা করোনারি হৃদরোগ। আর এ রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময় করতে হলে এ সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা থাকা প্রয়োজন।
ক্রমাগত ভুল জীবনযাপনের ফলে করোনারি ধমনীর ভেতরের দেয়ালে কোলেস্টেরল প্লাক বা হলুদ চর্বির আস্তর জমে। এতে রক্ত চলাচল ব্যাহত হয়। হৃৎপিন্ডের কোষ- গুলোতে রক্তের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন ও পুষ্টি পৌঁছাতে পারে না। ফলে রোগী একসময় বুকে ব্যথা অনুভব করেন। রক্ত চলাচল কমে গিয়ে এ সমস্যাটি দেখা দেয় বলে একে ইস্কিমিক হার্ট ডিজিজও (Ischaemic heart disease) বলা হয়।
করোনারি হৃদরোগজনিত এ ব্যথাটি চিকিৎসাশাস্ত্রে এনজাইনা (Angina) নামে পরিচিত। অধিকাংশ রোগীই এসময় বুকের মধ্যে ব্যথা, ভার ভার বা এক ধরনের চাপ অনুভব করেন। মূলত বুকের বাম দিকে বা বুকের মধ্যখানে এই ব্যথা অনুভূত হয়। কখনো কখনো শ্বাসকষ্টও অনুভব হতে পারে। বুকের এই ব্যথা সাধারণত গলা, বাম চোয়াল, ঘাড়, কাঁধ, ওপরের পিঠ, বাম শোল্ডার জয়েন্ট, বাম বাহু ও হাত হয়ে অনামিকা ও কনিষ্ঠা আঙুল পর্যন্ত ছড়িয়ে যেতে পারে।
এ-ছাড়াও হৃদরোগের ব্যথা ওপর পেট, থুতনি, বুকের ডান পাশ, পিঠ এমনকি ডান হাতেও যেতে পারে। করোনারি হৃদরোগের ব্যথা শুধু ওপরের পেটে হলে তা হতে পারে সবচেয়ে বিপজ্জনক। কেন?
আপনি হয়তো রাতে ভূরিভোজ করেছেন। মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। বুক জ্বলছে। সেইসাথে ওপরের পেটে একটা অস্বস্তি। স্বাভাবিকভাবেই মনে হবে রাতে গুরুপাক খেয়েছি, তাই হয়তো এসিডিটি হয়েছে। বাড়িতে এন্টাসিড থাকলে খেয়ে নিলেন একটা। তারপরও অস্বস্তি কমছে না দেখে ওমিপ্রাজল জাতীয় ওষুধও হয়তো খেয়ে নিলেন। তবুও কমছে না; বরং কিছুটা যেন বাড়ছে। ফোন করলেন আপনার ডাক্তার বন্ধুকে।
আপনার বর্ণনা শুনে ডাক্তারেরও প্রথমেই মনে হতে পারে—রাতের গুরুপাক খাবারই এর কারণ। অতএব এটা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা। ফলে আপনার আর হাসপাতালে যাওয়া হলো না। সকাল হওয়ার আগেই দেখা গেল আপনার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। কখনো কখনো হার্ট অ্যাটাকের অন্যতম চিত্র এটি। অর্থাৎ ওপরের পেটে ব্যথার লক্ষণ নিয়ে হার্ট অ্যাটাক হতে যাচ্ছে কিন্তু আপনি মনে করছেন এসিডিটি বা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা।
আবার এমনও নয় যে, হৃদরোগ হলে সবসময় আপনার ব্যথা হবে। কারো করোনারি ধমনীতে হয়তো ৭০%, ৮০% বা ৯০% ব্লকেজ, কিন্তু কখনোই ব্যথা অনুভব করেন নি। তিনি হয়তো প্রথমবারের মতো ব্যথা অনুভব করেন, যেদিন তার হার্ট অ্যাটাক হয়। এ-ছাড়াও ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ই ব্যথা অনুভ‚ত হয় না। অতএব করোনারি হৃদরোগ হলেই যে ব্যথা হবে এমন কোনো কথা নেই। আবার ব্যথা নেই মানেই যে হৃদরোগ নেই—সবসময় জোর দিয়ে বলা যায় না।
আবার কেউ হয়তো রাতে ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছেন—এক কোটি টাকা যে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করেছিলেন সেটা মার খেয়েছে। কিংবা ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের লোন করেছিলেন, শোধ করতে পারছেন না বলে ব্যাংক এখন মামলা করে দিয়েছে। পুলিশ ধরতে আসছে, তিনি পালাচ্ছেন। এমন সব দুঃস্বপ্ন দেখার সময় ঘুমের মধ্যেই হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেতে পারে। কিংবা তীব্র ব্যথায় ঘুম ভেঙে যেতে পারে। রাতে ঘুমের মধ্যে হয় বলে এমন ব্যথার নাম নক্চারনাল এনজাইনা (Nocturnal angina) |
লেখাটি ডা. মনিরুজ্জামানের "এনজিওপ্লাস্টি ও বাইপাস সার্জারি ছাড়াই হৃদরোগ নিরাময় ও প্রতিকার বই থেকে নেওয়া।"
এমএম//