ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪

করোনায় অনেক অগ্রজকে হারিয়েছি

কামরুল ইসলাম চৌধুরী

প্রকাশিত : ১৭:৫১, ১৫ জুলাই ২০২০ | আপডেট: ১৯:২২, ১৫ জুলাই ২০২০

কয়েক ঘন্টা পর খুলছে জাতীয় প্রেসক্লাব। অবসান হচ্ছে দীর্ঘ প্রতীক্ষার। করোনা মহামারীর আকালের এই অবরুদ্ধ কালে চার মাস ক্লাব রয়েছে লকডাউনে! অবশেষে সীমিত আকারে খুলছে ১৬ জুলাই। আমরা যাব আমাদের প্রিয় প্রাঙ্গণে। সদস্যদের পদচারণায় মুখরিত হবে আবার আমাদের দ্বিতীয় গৃহ। ফিরে কি পাবো আগের সেই প্রেসক্লাব! একাত্তরের রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধ শেষে ক্লাবে ফিরে যেমন পাওয়া যায়নি রেখে যাওয়া পুরোনো দ্বিতীয় গৃহ!

আবার ক্লাবে যাবো। কিন্তু আমাদের নিত্যদিনের সেই আড্ডায় আমাদের মাঝে আর থাকবেন না বেশ ক’জন অগ্রজ, আমাদের শ্রদ্ধেয় মানুষ! এক দু'জন নয়! ন'জন প্রিয় জ্যোতিময় সাংবাদিক। দিকপাল সাংবাদিক ভিপি বড়ুয়া, দ্যুতিমান সাংবাদিক আবু জাফর পান্না, রং ছড়ানোর কারিগর রওশন উজ্জামান, মুক্তিযোদ্ধা কবি মাশুক চৌধুরী, মুক্তিযোদ্ধা কাজ পাগল মোহিতুল ইসলাম রনজু, পরিশ্রমী ফারুক কাজী, সিদ্ধহস্ত রাশীদ উন নবী বাবু, গেদুচাচাখ্যাত খোন্দকার মোজাম্মেল হক চলে গেলেন না ফেরার দেশে।

                                                   সাংবাদিক ভিপি বড়ুয়া, আবু জাফর পান্না, রাশীদ উন নবী বাবু

এই করোনা মহামারীকালে মায়াভরা এই পৃথিবী ছেড়ে আকাশের তারা হয়ে গেছেন। কেউ সাংবাদিকতা শুরু করেছেন পন্চাশের দশকে, কেউ উত্তাল সত্তরের শুরুতে, মাঝে বা শেষে রক্তঝরা সময়ে! সাংবাদিকতা পেশায় নিখাদ পেশাদার এই মানুষগুলো রেখেছেন অনন্য অবদান। কতো অম্লমধুর স্মৃতি আমাদের। কতো যুগ দশক মমতায় জড়িয়ে ছিলাম।

সজীব হাসিখুশি একানব্বই বছর বয়সী বড়ুয়া দা ছিলেন আমার প্রধান সম্পাদক। চমৎকার ইংরেজি লিখতেন। ১৯৫৮ সালে মর্নিং নিউজ দিয়ে তার সাংবাদিকতা শুরু।

বাংলাদেশ অবজারভার আর লন্ডনের ফিনান্সিয়াল টাইমস খ্যাত পান্না ভাই আশি ছুঁই ছুঁই বয়সেও কি চৌকস সাংবাদিক! ‘কি মিয়া কামরুল, খবর আছেনি’ বলে আর কোনদিন কাছে ডাকবেননা আমাদের তারকা পান্না ভাই। দেবেন না আর সংবাদের নানা টিপস্। পরিচয় করিয়ে আর দেবেন না হরেকরকম মানুষের সাথে।

সুদর্শন রওশন ভাই কতো অসাধারণ মিষ্টি রিপোর্ট করেছেন, অন্যের কপি যত্ন নিয়ে এডিট করেছেন। লন্ডনে প্রশিক্ষণ পাওয়া জেমিনি নিউজের সংবাদদাতা রওশন ভাই ছিলেন অনেকের গুরু! কবিতার মতো স্নিগ্ধ ছিল তার লেখা! আমার বক্তৃতার খসড়া আর তিনি করে দেবেননা!

রওশন উজ্জামান, গেদুচাচাখ্যাত খোন্দকার মোজাম্মেল হক, মোহিতুল ইসলাম রনজু

মনে পড়ে কবি মাশুক ভাই কি তাক লাগানো হেডিঙ করতে পারতেন। কপি দেখতেন নীরবে! ছিলনা বার্তা সম্পাদকের হাঁকডাক, ঠাটবাট, তর্জন গর্জন! বাবু টেনশন না নিয়ে টিম ওয়ার্ক করতো। অনুজ সহকর্মীদের কি মমতায় না ও আগলে রাখতো! সহ সম্পাদক থেকে ধীরে ধীরে হয়েছিল সম্পাদক!

রন্জু মাঠের রিপোর্টার থেকে সম্পাদক! কি মিষ্টভাষী, নিরহংকারী! ফারুক কাজী হাড় ভাঙা পরিশ্রমী রিপোর্টার হিসেবে নমস্য। আইন আদালত রিপোর্ট ছিল ঝরঝরে!

পেশাদার সৎ এবং মহতী এই নির্ভেজাল সাংবাদিকদের কি আমরা ভুলতে পারবো! জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক, যুগ্ম সম্পাদক এবং ব্যবস্হপনা কমিটির সদস্য থাকাকালীন তাদের অকুন্ঠ সমর্থন পেয়েছি! ভোট দিয়েছেন, ভোট ছেয়েছেন! কতো মমতা ছড়িয়েছেন! হাজারো স্মৃতি!

ফারুক কাজী, কবি মাশুক চৌধুরী, আসলাম রহমান

মোজাম্মেলের সাপ্তাহিক কাগজে গেদুচাচার কলাম ছিলো তুমুল জনপ্রিয়। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আমাদের সময়ে ২০১৫ সালে ক্লাব সদস্য হতে পেরেছিল বলে বেশ সমীহ করতো মোজাম্মেল! ক্লাবের দক্ষিনের বারান্দার সেই বিখ্যাত টেবিলে সাংসদ মুহম্মদ শফিকুর রহমান আর আমার সামনে এসে আর কোনদিন বসবেনা !

হাযরে জীবন! এই নির্ভেজাল তারকা সাংবাদিকদের পায়ের চিহ্ন আর পড়বেনা জাতীয় প্রেসক্লাবে! আর তো কখনো দেখা হবে না তাদের সাথে ! ভাবতেই চোখ অশ্রু সজল হয়ে যায়। ক্লাব অঙ্গন থেকে তাদের আমরা শেষ বিদায়ও জানাতে পারিনি। এদের অবদানের স্বীকৃতিও আমরা দেইনি। এরাই সত্যিকারের 'আনসাঙ হিরোজ অব আওয়ার প্রফেশন'! আমাদের ক্ষমা করে দিন! জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।

মওলানা রুমির কথা দিয়ে বলি, সঠিক বেঠিকের উর্ধে হয়তো আবার দেখা হবে বেহেশতের বাগানে!

লেখক: সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেসক্লাব ও জেষ্ঠ অর্থনৈতিক রিপোর্টার

এসি

 


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি