ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪

কর্মছন্দে ফেরার প্রত্যাশা

অ্যাড. মো. মুনিরুজ্জামান ও রফিকুল ইসলাম সোহেল

প্রকাশিত : ২১:১৭, ২৩ জুলাই ২০২০ | আপডেট: ২১:৪৫, ২৩ জুলাই ২০২০

সম্প্রতি প্রকাশিত একটি রিপোর্টে দেখা গেল, করোনাকে হারিয়ে দিচ্ছেন শ্রমজীবীরা- এবং কেন করোনায় তাদের মধ্যে সংক্রমণের বহিঃপ্রকাশ কম, তা নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন মনে করছেন আইইডিসিআর এবং আইসিডিডিআরবি। আশার কথা হল, আমাদের দেশে করোনায় মৃত্যুহার যেখানে ১.৩ শতাংশের আশে পাশে, সেখানে সেরে উঠার হার প্রায় ৪০ শতাংশেরও বেশি (WHO Situation Report#17, 22 Jun,2020)।

করোনা সংক্রামক, কিন্তু কতটা প্রাণঘাতী, তা পরিসংখ্যানই বলে দেয়। তাই সে তর্কে না গিয়ে বরং আমরা মনোযোগ দেই সুস্থতার দিকে। সময়টা খুব অনুকূল নয়, এর মধ্যে অনেকের জীবন চালানোই মুশকিল হয়ে পড়েছে, কারণ কাজ কমে গেছে, রোজগারের পথ বন্ধ প্রায়। আইএমএফ বলছে, বিশ্বে শ্রমবাজারের যে ক্ষতি, তা প্রায় ৩০ কোটির বেশি লোকের কর্মসংস্থান হারানোর সমপরিমাণ। বাংলাদেশেও শ্রমজীবীদের প্রতি ৫ জনে ৩ জনই এই ক্ষতির সম্মুখীন। পরিবারে আয় কমেছে প্রায় ৭৪ শতাংশ পর্যন্ত।

আমাদের দেশের জনশক্তির একটা বড় অংশের জন্যে কর্মহীন দিন মানে অন্নহীন দিন। তাদের ঘরে বসে থাকার বিলাসিতার কোন সুযোগ নেই। তাই এখন আমাদের সুস্থ থেকে আগের রুটিনে ফিরে আসতে হবে। কাজ করতে হবে। কিন্তু করোনার ভয়- সংক্রমণ আতঙ্ক থেকে বেরিয়ে আসা সহজ নয়, যখন প্রতিদিন করোনায় মৃত্যু সংবাদ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা মহিয়সীদের (!) সতর্কবার্তা, নিকটজনদের সংক্রমণের খবর চারদিকে। আমরা আমাদের নিজেদের অবস্থান থেকে আতঙ্কের আধিক্যটা কমাতে পারি, যদি একটু সচেতন হই। আমরা প্রয়োজনীয় তথ্য জানব উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার জন্যে নয়, বরং আমাদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। আর যতটুকু তথ্য আমাদের জন্য প্রয়োজনীয়, তার বেশি জানতে গিয়ে অর্ধসত্য বা অসত্য বা

উদ্দেশ্যমূলক তথ্য দ্বারা আমরা ভারাক্রান্ত হতে পারি কিংবা প্রতারিতও হতে পারি। কারণ তথ্য খুবই শক্তিশালী, আর সংকট কালে যখন এটি ইনফোডেমিকের আকার নেয়, এর প্রভাব হয়ে উঠে আরও ব্যাপক।

এই অমানবিকতার কালে আমরা অন্ধকারের পাশে আলোর রেখাও দেখেছি। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে নানান সীমাবদ্ধতা আমাদের জন্য কিছুটা আশীর্বাদও হয়ে এসেছে। আমাদের দেশের মানুষের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা উন্নত দেশের মানুষের তুলনায় বেশি, যেহেতু ছোটবেলা থেকেই আমাদের নানান রোগবাহী জীবাণুর সাথে লড়াই করে বড় হতে হয় (গবেষকদের ভাষায় এটি হাইজিন হাইপো্থিসিস নামে পরিচিত)। অনেকে বলছেন আমাদের খাবারে নানান মসলার ব্যবহার আমাদের ইমিউনিটি তৈরীতে সহায়তা করেছে। তারচেয়েও বড় হল মনোবল, আমাদের শ্রমজীবী সাধারণ মানুষকে কাবু করে দিতে পারেনি এই আতঙ্ক। তারা নিজেদের কাজে ফিরতে চায়, জীবনকে আবার সচল করতে চায়। ৪০ শতাংশের নিরাময়ের খবরের চেয়ে ১.৩ শতাংশের মৃত্যুর খবর আমাদের বেশি বিচলিত করে। আসলে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে এবং ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী রাখার জন্য নিয়মিত স্বাস্থ্যের যত্ন নেয়া প্রয়োজন। এটি শুধু করোনা কালে নয়, সব সময়ের জন্যই প্রয়োজন। আর মনের সুস্থতাও জরুরি। 

নিজেকে সময় দেয়ার এত ভাল সুযোগ আর পাইনি আমরা। এতে সহায়ক হতে পারে নিয়মিত মেডিটেশন, ব্যায়ামচর্চা, পেশিকে সচল কর্মক্ষম রাখা। নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী লুইস জেইগনারোর গবেষণায় উঠে এসেছে নাক দিয়ে শ্বাস নিয়ে মুখ দিয়ে ছাড়লে ফুসফুসের সক্ষমতা বাড়ে। নিয়মিত দমচর্চা, প্রাণায়াম নিয়মিত করা প্রয়োজন এ কারণেই। কারণ এখন আমাদের সুস্থ থেকে আগের রুটিনে ফিরে আসতে হবে। কাজ করতে হবে।

আসলে, নিজের কাজ সবচেয়ে ভালভাবে করাই প্রকৃত দেশপ্রেম। একরকম অচলাবস্থার মধ্যেও কিছু মানুষ তাদের কাজ ঠিকই করে চলেছেন অবস্থা যাই হোক। এ অমানবিকতার কালে তাদের কাজ, তাদের মানবিক দায়িত্ববোধ আমাদের আশান্বিত করে। সরকারি বেরসকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত কর্মীরা যারাই আন্তরিকভাবে নিজেদের দায়িত্ব পালন কররছেন তারাই দেশপ্রেমের পরিচয় দিচ্ছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ও অর্থায়নে এ সংকট মোকাবেলায় কাজ করে চলেছে।

স্বেচ্ছাসেবীরা কেউ ত্রাণ বিতরণ, কেউ দাফন সৎকার ইত্যাদি কাজের সাথে জড়িত আছেন। দেশপ্রেমের এক অনন্য উদাহরণ তৈরি করেছেন তারা। সবাইকেই দেশপ্রেমের মানসিকতা নিয়ে নিজ নিজ কাজ করা জরুরি এখন। ঘরে বসে শুধু অনলাইনে পোশাক বা বিলাস দ্রব্য কিনে যাওয়া মানে নিজের স্বার্থপর ক্ষুদ্র মানসিকতাই প্রকাশ করে ফেলা, নিজের দেশপ্রেমহীন চরিত্রকে প্রকাশ করে ফেলা (দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এই ঘরে বসে থাকার সময়ে মানুষের মাঝে অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটার প্রবণতা খুব বেড়ে গেছে! অনলাইনে রেসিপি দেখে নিত্য নতুন খাবার বানানো ও সামাজিক মাধ্যমে তার ছবি পোস্ট করার চর্চা বেড়েছে)। আমার দেশেরই মানুষ না খেয়ে, চিকিৎসা না পেয়ে মারা যাচ্ছে, আমি ফেসবুকে করোনা গেম খেলব, স্কোর গুণব, খাবার আর পোশাক নিয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠব? এটাই কি এদেশের মুক্তিযুদ্ধের শিক্ষা?

করোনা মহামারীর এসময়ে এসে দেখা গেল, মৃত্যু কতটা অপ্রিয় সত্য, আর জীবন আমাদের কতটা প্রিয়! যারা সংক্রমিত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের প্রতি আমাদের গভীর সমবেদনা। আর যে বিপুল জনসংখ্যা কাজ হারিয়ে চরম দুর্ভোগে আপতিত, তাদের সাহায্যে যথাসাধ্য এগিয়ে আসাও আমাদের দায়িত্ব। 

এজন্যে আতঙ্ক কে পাশ কাটিয়ে নিয়ম মেনে আমাদের কাজ শুরু করতে হবে। আমরা যদি এটুকু উপলব্ধি করি যে আমাদের আজকের নিরাপত্তা নিশ্চিত হচ্ছে আরও হাজারো মানুষ তাদের করণীয় কাজটি করছেন বলেই। আমরা যেন নিজেদের ও পরিবারের সুস্বাস্থ্যের প্রতি যত্নশীল হই, সমমর্মী হই এবং নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রতিটি ভালও কল্যাণ কাজের সুযোগ গ্রহণ করি। দুর্যোগ পেরিয়ে নতুন পৃথিবী গড়ায় যেন আমাদেরও অবদান থাকে।

রেফারেন্স:
1. https://www.aljazeera.com/ajimpact/imf-forecast-global-economy-bad-worse-200624132035483.html
2. https://www.dw.com/en/coronavirus-economy-down-poverty-up-in-bangladesh/a-53759686
3. https://www.kalerkantho.com/online/world/2020/06/24/926909
4. http://coronajoy.quantummethod.org.bd/bn/detail/article/f8237670-a147-11ea-86ea-
144abe52a5ff

অ্যাডভোকেট মো. মুনিরুজ্জামান ও অ্যাডভোকেট রফিকুল ইসলাম সোহেল
আইনজীবি, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

আরকে//


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি