‘কাপ সং’ দিয়ে ভাইরাল হওয়া অবন্তীর গল্প
প্রকাশিত : ১১:৩২, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮
ডাক নাম অবন্তী। পুরো নাম অবন্তী দেব সিঁথি। বেড়ে ওঠা জামালপুরে। মফস্বল শহরের আলো-ছায়ায় বেড়ে ওঠা অবন্তী কখনো ভাবেননি কণ্ঠশিল্পী হবেন। গান গেয়ে মানুষের মন জয় করার চিন্তা তো আরও অনেকদূরে।
নিজের ভেতর গুটিয়ে থাকা একটি মেয়ে। ছোটবেলায় বড়বোনের পাশে বসে গান শুনতেন। সেখান থেকেই গানের প্রতি আগ্রহ বাড়ে। এভাবেই একসময় নিজেই বাদ্যযন্ত্র নিয়ে গেয়ে ওঠেন মিতালী মুখার্জি, সাবিনা, রুনার গান।
বড় বোন পড়াশোনার চাপে গান ছেড়ে দেন। কিন্তু অবন্তী শুরু করেন ভালোভাবে। মা-বাবাও মেয়ের গানের প্রতি আগ্রহ দেখে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। ওস্তাদ সুশান্ত দেব কানু’র কাছ থেকে নেন গানের তালিম।
এক কথায় ছোটবেলা থেকেই গানের সঙ্গে যোগাযোগ তার। জামালপুর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক আর দিগপাইত শামসুল হক ডিগ্রি কলেজে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থী থাকার সময় গান গেয়ে পরিচিতি পান তিনি। গিটার আর হারমোনিয়াম বাজানো শিখেছেন সেই ছোটবেলাতেই। কলেজে পড়ার সময় বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও গান করতেন অবন্তী। ২০০৩ ও ২০০৪ সালে লোকগান ও নজরুলসংগীত গেয়ে জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছেন। এ ছাড়া ২০০৫ সালে ক্ল্যাসিক্যাল ও লোকসংগীত গেয়ে পেয়েছেন ‘ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান স্বর্ণপদক’।
২০০৬ সালে ক্লোজআপ ওয়ান প্রতিযোগিতায় নিজের নাম লেখান, কিন্তু শুরুতেই থেমে যায় তার স্বপ্ন। প্রথম ৫৫ জনের ঘরে এসেই ছিঁটকে পড়েন অবন্তী। তারপর পড়ালেখার কারণে গানের জগত থেকে একটু দূরে অবস্থান করেন। তবে মনের মধ্যে সেই সুর প্রতিনিয়ত বেজে ওঠে। থেমে থাককে পারেননি অবন্তী। ২০১১ সালের কথা। অবন্তী তখন ঢাকায় বাস করেন। নিজেই গান শেখানো শুরু করেন। ছাত্রদের গান শেখানোর পাশাপাশি নিজের চর্চাটাও শুরু করেন পুরোদমে। ২০১২ সালে আবারও নাম লেখান ক্লোজআপ ওয়ান প্রতিযোগিতায়। এবার আর পিছিয়ে পড়া নয়, আস্তে আস্তে জায়গা করে নেন সেরা দশে। কিন্তু বিধিবাম, পরবর্তী রাউন্ডে বাদ পড়ে যান। তবে এ নিয়ে তার কোনো আক্ষেপ নেই। এতো সময় যে গল্পটা হলো তা সাধারণ এক সঙ্গীত প্রেমী অবন্তীর গল্প। কিন্তু এরপরে অবন্তী সিঁথি সবার সামনে উপস্থিত হন অন্য এক আলো নিয়ে।
সেই প্রথম তাকে দেশের মানুষ চিনেছে ফেসবুকে। ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে নজড় কেড়েছিলেন তিনি। খালি গলায় গান গাইছিলেন। বাদ্যযন্ত্র বলতে তেমন কিছুই ছিল না। ফয়েল পেপার, ধাতব মুদ্রা আর প্লাস্টিকের দুটি কাপ। সুরের মায়াজাল তৈরি করে গেয়ে চলছিলেন ‘যেখানে সীমান্ত তোমার …’। একবার নয়, বেশ কয়েকবার গানটি শুনে নিজের অজান্তেই সবাই বলে উঠেছেন- ‘আহা, কী মিষ্টি গলা! কী নিখুঁত পারফরমেন্স!’
লাখ লাখ ভিউয়ার্স দেখে ফেলেছে অবন্তীর সেই ভিডিওটি। কেউ কেউ মেয়েটির গলার প্রশংসা করার পাশাপাশি রূপেরও প্রশংসা করে। এক কথায় শিক্ষিত সুন্দরী অবন্তী। তবে ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ার পর সবাই তাকে কাপ সিঙ্গার বলে ডাকতে শুরু করে।
ক্লোজআপ ওয়ানে সেরা দশে থাকার কল্যাণে স্টেজ শো-সহ গান গেয়ে উপার্জনের পথটা খুলে যায় অবন্তীর। এরইমধ্যে দুটি সিনেমার দুটি প্লেব্যাকে কণ্ঠও দিয়েছেন তিনি। সায়মন তারিক পরিচালিত ‘মাটির পরী’ ও ওয়াজেদ আলী সুমন পরিচালিত ‘পাগলা দিওয়ানা’ সিনেমাতে গান গেয়েছেন।
এবার আমরা প্রবেশ করব কাপ সঙ্গীতের নেপথ্যের গল্পে। প্রথম বাংলাদেশি মেয়ে, যে ‘কাপ সং’ পারফর্ম করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। যে কারণে অবন্তীকে আজ সবাই চেনে। সেই মাহেন্দ্রক্ষণের গল্পটি শোনা যাক অবন্তীর মুখেই।
‘আমি কখনো ভাবিনি কাপ সং আমাকে রাতারাতি জনপ্রিয় করে দেবে। দুই তিন-ঘণ্টার ব্যাবধানে হাজার হাজার দর্শক মিলবে। খুলেই বলি, বেশ কিছুদিন আগের ঘটনা। ইউটিউবে দুটি বিদেশি মেয়ের কাপ সং পারফর্ম দেখে ভালো লাগে আমার। এরপর ইউটিউব ঘেঁটে কাপ সংয়ের ওপর কিছু টিউটোরিয়াল দেখে নিই। পরে নিজে নিজেই চেষ্টা করি। কয়েকটি গান ট্রাই করার পর ভাবলাম যে এবার নিজের কিছু গান ভিডিও করে ইউটিউবে ছাড়লে কেমন হয়! নিজের ইউটিউব চ্যানেলে নিজের গান পোস্ট করার মজাই আলাদা। এরই মধ্যে একদিন বাসার সবাই চলে গেছে গ্রামের বাড়ি। একা বাড়িতে বসে ভিডিও করে ফেললাম ‘যেখানে সীমান্ত তোমার’ গানটি। তখন সন্ধ্যা। গানটি আপলোড করে ফেসবুকে শেয়ার দিয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়ি। ঘণ্টা দুয়েক পরে ফেসবুকে ঢুকে দেখি প্রচুর নোটিফিকেশন। আমি তো দেখে অবাক। সাধারণত এত লাইক এত কমেন্ট কখনো আমি পাইনি। ফেসবুকে ঢুকে দেখি প্রায় ২০ হাজার ভিউয়ার্স। এরপর অন্য আরেকটি পেজে দেখলাম আমার এই গানটি। সেখানে প্রায় ৫ লাখ ভিউয়ার্স। আমি, তো তাজ্জব।’
সেই যে শুরু এখন তার যাত্রা আরও প্রশস্ত হয়েছে। ইউটিউবের মাধ্যমে ‘কাপ সং’ উপহার দিয়ে প্রথম দফায় ভালোই ভাইরাল হন অবন্তী সিঁথি। তবে গত ১৫ সেপ্টেম্বর ভারতীয় একটি টিভি চ্যানেলে তিনি যা দেখিয়েছেন, সেটি দেখলে চমকে যাবেন সবাই। রবিবার সকাল থেকে অবন্তীর গাওয়া ও শিস বাজানো কিশোর কুমারের ‘আকাশ কেন ডাকে’ গানটি ভাইরাল হয়ে ঘুরছে দুই বাংলার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
শনিবার রাতে ভারতের জি বাংলার জনপ্রিয় রিয়েলিটি শো ‘সারেগামাপা’র মঞ্চে এসে উপস্থিত সবাইকে চমকে দেন বাংলাদেশের মেয়ে অবন্তী সিঁথি। তার কণ্ঠ, কাপ মিউজিক আর শিস শুনে বিস্ময়কর এক ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছেন। তার পরিবেশনা দেখে উপস্থিত বিচারক শ্রীকান্ত আচার্য, শান্তনু মৈত্র, কৌশিকী চক্রবর্তী, মোনালী ঠাকুর, পণ্ডিত তন্ময় বোস, রূপঙ্কর বাগচী, জয় সরকার ও শুভমিতার মতো নন্দিত শিল্পী-সুরকাররা আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। করতালি আর প্রশংসায় ভাসিয়ে দেন বাংলাদেশের অবন্তীকে।
এই অনুষ্ঠানের নতুন পর্বের শুটিংয়ে অবন্তী সিঁথি এখন ভারতের কলকাতায় অবস্থান করছেন।
এবারের পরিবেশনাটি এরকম প্রশংসিত হওয়া প্রসঙ্গে অবন্তীর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘সম্মানিত বিচারকদের অ্যাপ্রিসিয়েশন পেয়ে আমি আসলে কথা হারিয়ে ফেলেছিলাম। স্টেজে দাঁড়িয়ে তখন নিজের হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছিলাম। ভাবতেই পারিনি এই পরিবেশনা সবার এতটা ভালো লাগবে। আমি খুব খুশি।’
এসএ/