কারওয়ান বাজারের পাশেই গড়ে উঠেছে মাদক বাজার
প্রকাশিত : ১৮:২৪, ২৪ জুলাই ২০১৭ | আপডেট: ১৩:৪০, ২৫ জুলাই ২০১৭
কাঁচা বাজারের পাইকারি মার্কেট হিসেবে পরিচিত রাজধানীর কারওয়ান বাজারের পাশেই গড়ে উঠেছে আরেক বাজার। তবে এটি মাছ কিংবা সবজির বাজার না, এটি মাদকের বাজার। প্রতিদিন ভোর থেকে শুরু হয়ে এ বাজার সকাল ১০টার আগেই শেষ হয়ে যায়। আবার বিকেল ৩টা থেকে শুরু হয়ে চলে গভীর রাত পর্যন্ত। মাদকের বাজারের সঙ্গে জুয়াড়িরা বসায় জুয়ার আসর। যেন দেখার কেউ নেই। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয় শিগগিরই শতভাগ মাদকমুক্ত এলকায় পরিণত হবে কারওয়ান এলাকা।
জানা গেছে, কারওয়ান বাজার রেললাইনের পাশে গড়ে ওঠা বস্তিতে রয়েছে প্রায় ৮ শতাধিক ঝুপড়ি ঘর। প্রতিটি ঝুপড়ি ঘরই যেন এক-একটি মাদকের দোকান। প্রকাশ্যেই ঝুপড়ি ঘরের সামনে মাদক বিক্রি হয়। গাঁজা থেকে শুরু করে ইয়াবা, ফেনসিডিল সব মাদকই এই বস্তিতে সহজলভ্য। এ বাজারে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় ইয়াবা। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে গাঁজা এবং তৃতীয় অবস্থানে হেরোইন। তবে ফেনসিডিল প্রকাশ্যে না আনলেও চাহিদার আলোকে ঘর থেকে এনে দেয় বিক্রেতারা।
জানা গেছে, কারওয়ান বাজার রেলওয়ে এলাকায় মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত প্রায় ৪০০ জন। যাদের শতভাগই নারী। মাদক ক্রেতাদের ক্ষেত্রেও রয়েছে ভিন্নতা। সকালের ক্রেতা সাধারণত ৩০-ঊর্ধ্ব ব্যক্তিরা আর বিকেলের ক্রেতা ছাত্র-যুবক। যাদের বয়স ১৫ থেকে ৩০ এর মধ্যে। মাদকের পাশাপাশি এখানে নিয়মিত বসে জুয়ার আসর। যেখানে প্রতিনিয়ত সর্বশান্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
ক্রেতা সেজে এই প্রতিবেদক সনিয়া (ছদ্দনাম) নামের এক মাদক বিক্রেতার কাছে ইয়াবার দাম জানতে চয়ে। জবাবে সনিয়া জানায় চম্পা ৩২০ টাকা লাগব, সেভেন আপ আছে ৬’শ টাকা। প্রতিবেদক অন্যজনের কাছে গাঁজার দাম জানতে চাইলে বলে, স্টিক পড়ব ৫০ টাকা। তবে সে জানাল তার কাছে ২০ টাকা থেকে ১০০ টাকার স্টিকও আছে। ফেনসিডিল পাওয়া যাবে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে সে বলে পাওয়া যাব তবে ৬শ’ টাকা লাইগব।
রাজধানীর ফার্মগেট এলাকা থেকে মাদক কিনতে আসা সিহাব জানায়, স্কুলে থাকাবস্থায় বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে সিগারেট ধরি। ২০১০ সালে কলেজ জীবনে ধরি হেরোইন। পরিবারের উদ্যোগে চিকিৎসায় কিছুদিন ভালো ছিলাম। পরে ফেনসিডিলে আসক্ত হই। এখন ‘বাবা’ (ইয়াবা) খাই।
কারওয়ান বাজারের রেললাইনের এ বাজারে চার রকমের ইয়াবা বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে গাঢ় লাল রঙের ‘চম্পা’ প্রতি পিস ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায় বিক্রি হয়। টেকনাফে এটি কেনা হয় ১৫০ থেকে ১৭০ টাকায়। হালকা গোলাপী রঙের ‘আর সেভেন’ ইয়াবার দাম সবচেয়ে বেশি। এটি ঢাকায় কমপক্ষে ৫০০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। হালকা গোলাপী রঙের আরেক ধরনের ইয়াবার নাম ‘জেপি’। এর খুচরা মূল্য ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা। ‘ডগ’ নামের মাটি রঙের ইয়াবা বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকায়। এছাড়াও বিভিন্ন উপাদান মিশিয়ে দেশেই তৈরি হচ্ছে এক রকমের ভেজাল ইয়াবা। এগুলো ১৫০ টাকায় পাওয়া যায়। তবে বিশেষ বিশেষ কোনো উপলক্ষ্যে প্রতিটি ইয়াবা ট্যাবলেটের খুচরা দাম ১ হাজার টাকাও ছাড়িয়ে যায়। আর গাঁজা বিক্রি হয় ২০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত প্রতিটি স্টিক। এছাড়া এ বাজারে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা দামে মিলছে ‘ছোট পুরিয়া’ ও ‘বড় পুরিয়া’র হিরোইন। এক পুরিয়ায় এক থেকে ১০ গ্রাম পর্যন্ত হেরোইন থাকে।
মনোবিদ্যা বিশেষজ্ঞ জিএম তরিকুল ইসলাম ইটিভি অনলাইনকে বলেন, মাদকাসক্তরা নিজেদের স্বাভাবিক জীবন ধ্বংস করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও সদস্যদের সঙ্গে মাদক ব্যবসায়ীদের সম্পর্ক ও যোগসাজশ আছে। পুলিশ-অপরাধীর এই নেটওয়ার্ক বিপজ্জনক। এটাকে নির্মূল করতে হবে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার পাশাপাশি পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
মাদকের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর তৎপরতা বৃদ্ধি পেলেও কাঙ্খিত সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। অবৈধ মাদকের চোরা ব্যবসা ও অপব্যবহার রোধে আইনের যেমন সুনির্দিষ্ট ভূমিকা রয়েছে, তেমনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। অভিযোগ রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা ও সদস্যদের সঙ্গে মাদক ব্যবসায়ীদের যোগসাজশ আছে।
এ বিষয়ে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবদুর রশিদ ইটিভি অনলাইনকে বলেন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতিনিয়ত আমরা বিভিন্ন ধরনের অভিযান পরিচালনা করছি। সাদা পোশাকে ডিউটিতে আছে আমাদের বাহিনীর সদস্যরা। কয়েক দিন ধরে একাধিক অপরাধীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
প্রশাসনের সঙ্গে হাত করেই এই ব্যবসা চলছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা গোপনে কেউ করছে কিনা বলতে পারব না। তবে এ ধরনের কাজের সঙ্গে কেউ জড়িত থাকলে সঙ্গে সঙ্গেই তার বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজহার হোসেন ইটিভি অনলাইনকে বলেন, এ অঞ্চলে আমাদের থানায় কিছু এলাকা পড়েছে। আমরা নিয়মিত অভিযানে যাচ্ছি। বলতে পারি আজকের পর থেকে আর মাদকের ব্যবসা থাকবে না ওই এলাকায়।
ডব্লিউএন