কুমোরটুলিতে এক শারদ সন্ধ্যায়
প্রকাশিত : ০৮:২৩, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২
ভোপাল থেকে কলকাতা দীর্ঘ ট্রেন ভ্রমণের ক্লান্তি, তার ওপর শরীরটাও ভালো ছিল না। এদিকে আবার ঢাকা ফেরার তাড়া। মাঝখানে কলকাতায় একটা মাত্র দিন। শরীর সইছিল না কিন্তু মনও মানছিল না। কুমোরটুলি যাব বলে তো পণ করে রেখেছি।
২৬ আগস্ট ২০২২, সন্ধ্যার পর এসপ্লানেড মেট্রোস্টেশন থেকে শোভাবাজার স্টেশন পর্যন্ত টিকেট কেটে মেট্রোতে চড়ে বসলাম। অফিস ও কাজফেরত যাত্রীদের চাপে বসার জায়গা নেই তাই দাঁড়িয়ে রইলাম। মাত্র কয়েক মিনিটেই পৌঁছে গেলাম শোভাবাজার। সেখান থেকে কুমোরটুলি বা কুমারটুলি পল্লী মাত্র সাত-আট মিনিটের পায়ে হাঁটা দূরত্বে।
কুমোরটুলি যেতে যেতে দেখলাম ট্রাকে বাজনা বাজিয়ে বিরাট শোরগোল করে গণেশের মূর্তি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কারণ কয়দিন পরেই ছিল গণেশ চতুর্থী। রাস্তার পাশেই কালি মন্দির। সেখানে গিয়ে কালি মা'র দর্শন নিয়ে আসলাম। কী সুন্দর ধূপের গন্ধ, আর মন্দিরের ঘণ্টা ধ্বনি।
কুমোরটুলি পল্লীর আটোসাটো গলির দুইপাশ জুড়েই দুর্গাসহ বিভিন্ন দেব-দেবীর প্রতিমা গড়তে ব্যস্ত মৃৎশিল্পীরা। এ যেন অন্য এক পরিবেশ, ভিন্ন এক জগৎ। কোনো প্রতিমাতে শুধু রঙের প্রলেপ দেওয়া বাকি, কোনো প্রতিমা অল্পখানি বানানো হয়েছে, কোনোটার আবার পেছনের অবয়বের ছাঁচ তৈরি করা হচ্ছে মাত্র। ছোট, মাঝারি, বড় নানা আকৃতির প্রতিমা বানানো চলছে। এ প্রতিমাগুলোই চলে যাবে ঘরোয়া ও বারোয়ারি পূজায়, দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মন্ডপে। কারিগরদের কতো শ্রম আর কষ্টের বিনিময়ে শৈল্পিক এই প্রতিমাগুলো গড়ে ওঠে!
প্রতিমাশিল্পী বিভাস বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন, ‘বর্তমানে এখানে প্রায় ৩০০ পরিবার আছে, যারা এই কাজে নিয়োজিত।’
তরুণ পাল নামের আরেক প্রতিমাশিল্পী বললেন, ‘আমারা এখানে থিম নির্ভর প্রতিমা গড়ি। বিভিন্ন বারোয়ারি পূজার আয়োজকরা থিম বলে যান। আমার ছেলে সেই থিমের উপর ভিত্তি করে নকশা তৈরি করে। সেই নকশাতেই প্রতিমাসহ আনুষাঙ্গিক বিষয় গড়া হয়। ৭০ হাজার থেকে শুরু করে এক লাখ ৩০ হাজার টাকায় আমি প্রতিমাগুলো বিক্রি করি।’
তবে করোনার কারণে গত দুই বছরে এ পাড়ায় যে স্থবিরতা নেমে এসেছিল, এবার আর তা নেই। এবার অর্ডার বেশি এলেও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মাটি, দড়ি, খড়সহ বিভিন্ন কাঁচামালের দাম। দেড়শ'র বেশি প্রতিমা এবার বিদেশে যাচ্ছে। বিদেশে যে প্রতিমাগুলো যায়, সেগুলো তৈরি করা হয় ফাইবার দিয়ে।
এক কারিগরকে দেখা গেল, রঙ-বেরঙের দুর্গার মুখ বানিয়ে তা কুলার মধ্যে সেটে নিয়েছেন। দুর্গার মাথায় আবার ককশিট দিয়ে বানানো মুকুট ও গলাতেও ককশিটের বিভিন্ন কারুকাজ। কুলাগুলো ঝুলিয়ে রাখায়, ঝুলন্ত দুর্গা মায়ের মুখগুলো দেখতে বেশ লাগছিল।
ইতিমধ্যে কলকাতার দুর্গাপূজাকে ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি’ তালিকায় যুক্ত করেছে ইউনেস্কো। এজন্য এবার কুমোরটুলিতে আনন্দ আরও বেশি।
আজ (২৫ সেপ্টেম্বর) মহালয়া। দেবিপক্ষের শুরু। এবার মর্ত্যে দেবী দুর্গার আগমণ গজে বা হাতিতে। গজ শান্তি ও সমৃদ্ধির প্রতীক। যার অর্থ শস্যপূর্ণা বসুন্ধরা। উমা কৈলাসে ফিরবেন নৌকায়, যার অর্থ শস্য বৃদ্ধি ও জল বৃদ্ধি।
দুর্গা হলেন দশভূজা। দশ হাত দিয়ে দান করেন ও দশ হাত দিয়ে গ্রহণ করেন। মা দুর্গা যেনো তাঁর সন্তানদের মঙ্গল করেন, এই পৃথিবীকে রক্ষা করেন, এই প্রার্থনাই হোক সবার। সবাইকে শারদীয় শুভেচ্ছা। পৃথিবী হোক অসাম্প্রদায়িক। নারীশক্তির জয় হোক।
'মায়ের মূর্তি গড়াতে চাই,
মনের ভ্রমে মাটি দিয়ে।'
এএইচএস//এনএস//
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।