কুলসুমের স্বপ্ন!
প্রকাশিত : ১৭:১৫, ১০ এপ্রিল ২০১৮ | আপডেট: ০০:০৫, ১৫ এপ্রিল ২০১৮
ধানমণ্ডি লেক। রাত ৯ টা। ইমরান ও কুলসুম কাঁধে কাঁধ দিয়ে গলাগলি করে দ্রুত হাঁটছে! দুজনের চেহারায় শঙ্কার ছাপ ! কখনো এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। ভদ্রোজন দেখলে একগাল মুচকি হাসি দিচ্ছে। ভাইয়্য-আপু, আঙ্কেল-আন্টি বলে কাছে গিয়ে ভিড়ছে। কখনো অফুরাণ হাসি নিয়ে ওই ভাইয়্যা-আপু-আঙ্কেল-আন্টি থেকে ফিরে আসছে, আবার কখনো রাজ্যের শঙ্কামাখা মলিন মুখখানা নিয়ে ফের গলাগলি করে লেকের পাড়ে হাঁটছে।
ইমরান! বয়স কত হবে, বড়জোর ৮ বছর। কালো-ঘন লম্বা ও জ্বলজ্বলে চুলগুলো কপাল পেরিয়ে নেত্রকেও ঢেকে ফেলেছে। স্লিম দেহের শিশুটিকে প্রথম দর্শনে দেখলে যে কেউ প্রেমে পড়ে যাবে। ওদিকে কুলসুমের বয়স ছয় বছর। অথচ তাঁর বাগ্মীতা, বলার ধরণ, উপস্থাপনার ভঙ্গি, আদরমাখা শব্দচয়ন কোমলতাকেও ছাড়িয়ে যায়। ছাড়িয়ে যায় কোটি কোটি মাইল দূরের দীপ্তিমান `লিটল স্টারের‘ সৌন্দর্যকেও।
প্রতিদিন বিকেলে ইমরান-কুলসুম গলাগলি করে বের হয় ভিক্ষা করার উদ্দেশ্যে। আর তাদের গন্তব্য হয় ধানমণ্ডি লেক। লক্ষ্য একটাই দৈনিক ৫০ টাকা আয়। ভাই-বোন মিলে কোনোরকমে ১০০ টাকা আয় করতে পারলেই মনের সুখে গান ধরে বাসার দিকে রওয়ানা হয়। পরদিন আবারও আসে ধানমণ্ডি লেকে। আবারও ভাইবোন বাসায় ফিরে। এভাবেই কাটে তাদের দিন।
৮ এপ্রিল রাত ৯টা। ধামণ্ডি লেকের ভেতর বসে আছি। পাশে কেউ নেই। একদল লোক জগিং করছে। আরেকদল হাঁটছে। এক শ্রেণীর তরুণ-তরুণী জোড়া হয়ে বসে প্রেম বিনিময় করছে। এসবে আমার মন নেই। বসে আছি আর বসে আছি। এরই মধ্যে দূর থেকে সুললিত কণ্ঠের এক মেয়ে বলে ওঠলো, ভাইয়্যা, ভাইয়্যা একটা গল্প বলব? `হুম বলো‘। `না, না ভাইয়্যা, একটা গান গাইব‘? `হুম গাও‘। `না ভাইয়্যা, একটা কবিতা পড়ি‘? `হুম পড়ো‘।
এবার পুরো মনোনিবেশ করলাম তাঁর উপর। দেখি এরইমধ্যে দুই ভাইবোন গলাগলি করেই দাঁড়িয়ে আছে। নাম জিজ্ঞেস করতেই মেয়েটি বলে ওঠলো, `ভাইয়্যা, আমি কুলসুম। আর অ ইমরান‘। কে বড় মুখ থেকে পড়ার আগেই, কুলসুম ছট করে বলে ওঠলো `ভাইয়্যা অ বড়‘। ইমরানের মুখে স্বর নেই। সে মুচকি মুচকি হাঁসছে। দুই ভাই-বোন আমার সঙ্গে ঘেঁষে বসে পড়লো।
এরপর শুরু হলো আলাপন। গল্প-গান-আড্ডা। কুলসুমের কণ্ঠে `মধু হয় হয় আরে বিষ হাবাইলা‘ `টুইঙ্কেল টুইঙ্কেল লিটল স্টার‘ মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেই গেলাম।
ইমরান-কুলসুমদের ৬ জনের সংসার। কুলসুম বলে জানো ভাইয়্যা `বাবা রিক্সা চালায়। বিড়ি, গাঁজা খাইয়্যা বাবা প্রায়ই মাতাল হইয়্যা বাসায় আসে। দাদী অন্যের বাসায় রান্নার কাজ করে। আর মা ছোট ভাইকে নিয়ে ঘরে থাকে। আগে মা অন্যের বাসায় কাজ করতেন। ছোট ভাইয়ের জন্মের পর থেকে মা বাসায় থাকে। জানো ভাইয়্যা, বাবা প্রতিদিন মাকে বকে। মাঝেমধ্যে পিটাই। আর জানো ভাইয়্যা, আমরা দুইজনে যদি ৫০ টাকা করে বাবাকে না দিই, তাহলে বাবা আমাদেরও ধরে পিটাই। ইমরান ভাইয়্যা তো ৫০ টাকা কামাইতে পারে না। আমি প্রতিদিন ২০-৩০ টাকা দিয়ে ভাইয়্যার ৫০ টাকা মিলাই বাবাকে ১০০ টাকা দিই। আর যেদিন আমি ভাইয়্যাকে টাকা দিতে পারি না, ভাইয়্যাও বাবাকে টাকা দিতে না পারার কারণে মার খায়‘।
ইমরান-কুলসুমের বাসা রায়ের বাজার বস্তিতে। দুই রুমের ঘর, ভাড়া তিন হাজার টাকা। টিনশেটের ঘরে দাদীর সঙ্গে থাকে ইমরান-কুলসুম। কুলসুম পড়ে স্থানীয় একটি ভ্রাম্যমাণ স্কুলে। ইমরানও পড়ে একই স্কুলে। সকাল হতে দুপুর অবধি স্কুলের পড়া শেষে বিকেলে ভিক্ষা করতে ধানমণ্ডি লেকে ছুটে আসে দুই মানিকজোড়। ইমরান বুঝে, বাবার পিটুনির হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে তাকে ৫০ টাকা রুজগার করতেই হবে। আর কুলসুম বুঝে, ভিক্ষা না নিলে খাবে কি? মায়ের-ছোট ভাইয়ের ওষুধ আনবে কিভাবে? স্কুলে কলম-খাতা নিয়ে যাবে কিভাবে?
ভিক্ষা করে জীবন চালালেও কুলসুমের চোখেমুখে রাজ্যের স্বপ্ন এসে ভিড় করে। মাত্র ছয় বছর বয়সে কুলসুম স্বপ্ন দেখে বড় হওয়ার। বাবা-মাকে টাকা কামাই করে খাওয়ানোর। ভাই ইমরানকে পড়ালেখা করানোর। টাকা জমিয়ে জায়গা কিনে ছোট্ট একটি ঘর করার। কুলসুম যখন বলছিল, `টুইঙ্কেল টুইঙ্কেল লিটল স্টার, হাউ আই ওয়ান্ডার হোয়াটস ইউ আর‘। সত্যি কুলসুম ‘হাউ ইউ ওয়ান্ডার‘। এই লেকের পাড়ে অন্য শিশুরা যখন বাবা-মায়ের সঙ্গে বেড়াতে এসে দই-পুচকা-আইসক্রি খায়, তখন তুমি ভিক্ষা মাগো। সত্যিই এর চেয়ে বড় বিস্ময়ের আর কি থাকে? এরপরও স্বপ্নের রাজ্যে ভেসে কুলসুম স্বপ্ন দেখে বড় একজন অভিনেত্রী হওয়ার। বিশ্বাস করুন, তার গলার স্বর এত সুন্দর, এত সাবলীল তার বাক্যচয়ন , একটু যত্ন পেলে সে নিঃসন্দেহে দেশসেরা অভিনেত্রী হয়ে ওঠবে একদিন।
এটাই পুঁজিবাদী সমাজের বৈষম্যপূর্ণ জীবন। কেউ স্বপ্ন দেখে আর কেউ স্বপ্ন বিক্রি করে। রাত ৯ টায় এক কুলসুম রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ভিখ মেগে স্বপ্ন বিক্রি করে। হয়তো আরেক কুলসুম- ধনীর দুলালী সোফায় বসে হাউজ টিউটরের সামনে স্বপ্নের বীজ গলাধঃকরণ করে। এক কুলসুম ৫০টা টাকার আশায় বিকাল থেকে রাত অবধি ভিক্ষা করে, আরেক কুলসুম হয়তো বাবা-মায়ের পরম মমতায় ভবিষ্যতের বীজ বুনে। যে কুলসুমকে বারবার সাধার পরও একটা আইসক্রিম নেয়নি, সেই কুলসুমের ব্যক্তিত্ব নিয়ে কোন প্রশ্ন আসে? আসে না, হয়তো কোনদিন অর্থ হলে, বিত্তবান হলে কুলসুম-ই হবে দেশের সবচেয়ে ব্যক্তিত্ববাণ নারী।
কুলসুম এগিয়ে যাও...। সমাজ তোমার চোখের পানি মুছে দেবে না। তোমার চোখের পানি তোমাকেই মুছতে হবে। তোমার চলার পথ তোমাকেই রচনা করতে হবে। দেশে বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। এরপরও তোমার মতো কুলসুমদের ভাগ্যের সিকিটুকুনও পরিবর্তন ঘটেনি। বরং দিনে দিনে কুলসুমদের সংখ্যা আরও বাড়ছে। ১৭ মার্চ আসলে আবারও হয়তো তোমাদের চকোলেট দিয়ে, রং মাখিয়ে মিডিয়ায় উন্নয়নের ফেনা তোলা হবে। কিন্তু তোমাদের ভাগ্যের কি কোন পরিবর্তন ঘটবে? শাসক মহল, বিত্তবান ও সমাজের দায়িত্বশীল মানুষদের কাছে প্রশ্ন, আমাদের কি কোন দায়িত্ব নেই? বিবেককে প্রশ্ন করুন, তাহলেই জবাবটা পেয়ে যাবেন।
এমজে/