ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪

কেন এত হিংসা বিদ্বেষ?

প্রকাশিত : ১৮:৩৩, ২১ মার্চ ২০১৯

অবশেষে এটা প্রতীয়মান হয় যে, আপাতত ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হচ্ছে না। এ যুদ্ধ না হওয়ায় বা আপাতত থেমে যাওয়ায় গোটা বিশ্ব স্বস্তির মধ্যে ফিরেছে। আগামীতে এ উত্তেজনা আবার আসবে কিনা সেটা নির্ভর করছে এপ্রিল-মে মাসে অনুষ্ঠেয় ভারতের জাতীয় নির্বাচনের পর। এটা এখন অনেকটা সত্য যে, এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই অনেক বেশি উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল। কোনো শান্তি প্রিয় মানুষ বা সুস্থ্য সমাজ কাউকে হত্যার পরিকল্পনা করতে পারেনা। যুদ্ধতো সেটা আরও পরের বিষয়।

ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের গত ১৪ ফেব্রুয়ারী পুলওয়ামায় সিআরপির কনভয়ের উপর আত্মঘাতী হামলায় ভারতের সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্সের (সিআরপিএফ) ৪০জন জওয়ান নিহত হওয়ার ঘটনার পর থেকেই যেন ভারতে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। দেখা দেয় সাম্প্রদায়িক বিরোধ। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে, স্কুলের নিম্ন শ্রেণিতে পড়া ছোট ছোট মুসলিম শিক্ষর্থীরা কেও এই বিষ নিশ্বাস থেকে রেহাই পাননি।

পুলওয়ামা হামলা চালিয়েছিলেন একজন কাশ্মীরি যুবক। এ যুবক হামলার আগে একটি ভিডিও বার্তা রেকর্ডিং করেছিলেন। ওই ভিডিও বার্তা থেকে জানা যায়, তিনি পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন জইশ-ই-মুহাম্মদ বা জেইএমের হয়ে কাজ করেন। হামলার পর ভারত দাবি তোলে, পাকিস্তান যে জেইএমকে সহযোগিতা করে, তা স্বীকার করতে হবে এবং পাকিস্তান ও পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে অভিযুক্ত সংগঠনের মূল ধ্বংস করে দিতে হবে। এ কার্যক্রম এমনভাবে চালাতে হবে, যেন তা ভারত বিশ্বাস করতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছেও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ ও দাবি তুলে ধরে বিজেপি নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার। পাকিস্তান এ দাবি এড়িয়ে গেছে, এমনকি পুলওয়ামায় আক্রান্তদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করা ছাড়া আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পাকিস্তানের ওপর কোনো বড় চাপ সৃষ্টি করতে পারেনি যে দেশটি হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

বিগত বৎসরের দিকে তাকালেই বোঝা যায় উগ্র জাতীয়তাবাদের বর্তমান ধারাটি ভারতীয় সংবিধানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ধর্ম নিরপেক্ষতাকে ফোকলা করে ফেলেছে। পুলওয়ামায় সিআরপি গাড়ীবহরে হামলার পর সারা ভারত জুড়ে মুসলিম বিশেষ করে কাশ্মীরি মুসলমান ছাত্রদের নানাভাবে মারধর এবং নির্যাতনের যে সব ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা দেখেছি তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। স্কুল কলেজের কিশোর তরুনরা তাদের সহপাঠী বন্ধুকে ”তুমিতো ওসামা বিন লাদেন’, ’তুমি তালেবান’. ’তুমি মানব বোমা’ (you are bearing meat bomb) ইত্যাদি নামে ডেকে অপদস্ত করছে। অনেক মুসলিম ছেলেমেয়ে বাড়িতে এসে বাবা মাকে বলছে তাদের নাম পরিবর্তন করে দিতে। তারা আর মুসলিম নাম নিয়ে পরিচিত হতে চাচ্ছে না বা নিরাপদ বোধ করছে না।

কাশ্মীরে একজন অধ্যাপককে এজন্য হাঁটুগেড়ে বসে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হয়েছে। এ ধরনের ঘটনায় প্রমানিত হচ্ছে যে সমাজে দীর্ঘদিন থেকে চলে আসা পর-মত সহায়ক গনতন্ত্র এখন ক্রমেই তার জায়গা হারাচ্ছে। ভিন্ন মত হলেই তাকে আক্রমনাত্মক ভাষায় ভারত ছেড়ে পাকিস্থান চলে যেতে বলা হচ্ছে।

এখন এই জাতীয়তাবাদের ধারাটির পালে বিজেপির পাশাপাশি গনমাধ্যমের একটি বিরাট অংশ ও যোগ দিয়েছে। ভারতের আনুমানিক ৪০০ টি (জাতীয় ও আঞ্চলিক) বেসরকারি চ্যানেল রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ বা আর এস এস এর মুখপাত্রের মতো কাজ করছে। বর্তমানে অত্যন্ত জনপ্রিয় অর্নব গোস্বামী (Times Hour এর উপস্থাপক) ভিন্নমত পোষনকারীদের ভারতের শত্রু বলে ক্রমাগত বিষোদগার করে যাচ্ছেন।

ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক ধারা ১৯৩৩ সালে জার্মানীর হিটলারের উগ্র জাতীয়তাবাদের উত্থানের সেই সময়কে মনে করিয়ে দেয়। ইহুদী বিদ্বেষকে পুঁজি করে জার্মানীর ক্ষমতার মসনদকে পাকাপোক্তভাবে দখল করে। অর এস এস এর সাম্প্রতিক এক সভায় ভারতের তিন শত্রুকে চিহ্নিত করা হয়েছে-ক) মুসলিম যারা আবর্জনাতুল্য,খ) খ্রীস্টান যারা রক্ত পিপাসু এবং গ) বাম ধারা / কমিউনিস্টদের প্রগতির অন্তরায়।

ভারতীয় জাতীয় পতাকার ডিজাইন যিনি করেছিলেন, তিনি ছিলেন একজন ভারতীয় মুসলিম নারী সুরাইয়া তাইয়েবী। আজ সেই ভারতের মুসলিমদের আবর্জনার সাথে তুলনা করা হয় যেমনটা ইহুদীদের কে তুলনা করা হয়েছিল ইঁদুর এবং তেলাপোকার সাথে।

উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং দেশপ্রেম সমার্থক নয়। আজ ভারতীয় গণমাধ্যমে একটি অংশ দেশ প্রেমের নামে উগ্র জাতীয়তাবাদকে উসকে দিচ্ছে। টিভি ৯ চ্যানেল এর উপস্থাপক ভারতীয় সামরিক পোষাক পরিধান করে খেলনা বন্দুক হাতে যেভাবে দর্শকের সামনে উপস্থিত হয়েছিলেন তা কোন ক্রমেই দর্শকের মনে সুস্থ ধারার জন্ম দিতে পারে না। ভারতীয় গনমাধ্যমগুলি বিশেষ করে মধ্যরাতের টকশোগুলি নিজেদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগীতায় টিকে থাকার জন্য অধিক দর্শক ধরা এবং অধিক অর্থ উপার্জনের অন্য কোন পথ না পেয়ে উচ্চকিত কন্ঠের হাই ড্রামাকে বেছে নিয়েছে।

ভারতে আধুনিক টেলিভিশনে নতুন ধারার প্রবর্তক হিসাবে যাকে আইকন হিসাবে গন্য করা হয় অর্নব গোস্বামীর মতে একজন ভালো সাংবাদিক হতে হলে তাকে সর্বাজ্ঞে একজন ভালো জাতীয়তাবাদের ধারক হতে হবে। তার মতো অনেকেই তার এই ধারাটি গ্রহন করে মিডিয়ার র‌্যাংকিংয়ে উপরে থাকার তীব্র প্রতিযোগীতায় মেতে উঠেছে। চির শত্রু পাকিস্থানকে হাঁটুতে নামিয়ে আনার তীব্র প্রতিযোগীতায় ভারতীয় মিডিয়া তাদের ৭০ বছরের গনতন্ত্রের গলা টিপে ধরেছে।

পুলওয়ামায় একজন আত্মঘাতী যুবক বোমা মেরে ৪০ জন জওয়ানের জীবননাশ করে যে ক্ষতি করেছে, পুলওয়ামায় উত্তর ভারতব্যাপী হিংসাত্মক ঘটনায় ইন্ধনের মাধ্যমে অনেক বেশি ক্ষতি করেছে ভারতীয় মিডিয়া। দেশ-দ্রোহী খোঁজার এই উন্মত্ত সময়ে অনেকেই ক্ষতটি উপলব্ধি করতে পারছে না। কারন ভারতে আজ সময়ের বিপরীতে দাঁড়ানোর মত সাংবাদিকের অভাব তীব্র। কুলদীপ নায়ারের মতো প্রাজ্ঞ সাংবাদিকের পরিবর্তে আজ রগচটা, অর্নব গোস্বামীদের রাজত্ব। আর এখানেই রয়েছে ভারতের অসাম্প্রদায়িক ধর্ম নিরপেক্ষ সমাজ ব্যবস্থার প্রতি বড় হুমকি। ভারতের টিভি মিডিয়া হিংসার আবহ তৈরিতে বড় ভুমিকা রাখছে।

এসি

 


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি