কোটা পদ্ধতি সংস্কারে একমত শিক্ষাবিদরা
প্রকাশিত : ১৭:২২, ৩ এপ্রিল ২০১৮ | আপডেট: ১৯:৩৭, ৪ এপ্রিল ২০১৮
সরকারি চাকরিতে প্রবেশে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি সংস্কারের জন্য বেশকিছু দিন আন্দোলন করে আসছেন চাকরি প্রত্যাশীরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে রাজপথ সবখানেই এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু কোটা পদ্ধতি। যৌক্তিক দাবি আদায়ে বড় ধরনের আন্দোলন হুঁশিয়ারি দিচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন যৌক্তিক বলে কোটা সংস্কারে একমত হয়েছেন শিক্ষাবিদরাও।
তারা বলছেন, কম সংখ্যক চাকরি প্রত্যাশীর জন্য কোটা পদ্ধতির মাধ্যমে বেশি পদ সংরক্ষণ করে রাখার কারণে একদিকে বেকার সমস্যা কমছে না, অন্যদিকে ৫৬ শতাংশ কোটায় নিয়োগ দেওয়ার প্রার্থী না পাওয়ায় পদও খালি থেকে যাচ্ছে।
নিয়োগ বিধি অনুযায়ী সরকারি চাকরির নিয়োগে কোটা বরাদ্দ রয়েছে ৫৬ শতাংশ। মেধার তুলনায় বেশির ভাগ পদ কোটায় বরাদ্দ থাকলেও পদ শূন্য থেকে যাচ্ছে। যেখানে মেধাবীরা সুযোগ পাচ্ছে না। এতে দেশের প্রকৃত মেধাবীরা চাকরির বাইরে থেকে যাচ্ছে। শিক্ষাবিদরা বলছেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার সময়ের তুলনায় বর্তমান বাংলাদেশের অবস্থানের অনেক পরিবর্তনও ঘটেছে, বদলেছে চাকরির বাজার, মানুষের আর্থ সামাজিক অবস্থা। ফলে কোটা সংস্কার এখনই প্রয়োজন।
এব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের সমন্বয়কারী মো. রাশেদ খান বলেন, ‘কোটার কারণে আজ প্রকৃত মেধাবীরা চাকরি পাচ্ছেন না, মেধাবীরা তাদের যোগ্যতা দিয়ে সঠিক কর্মস্থল পাচ্ছে না। আমরা লাখ লাখ চাকরিপ্রার্থী আন্দোলন করে যাচ্ছি। সরকারের উচিত আমাদের যৌক্তিক দাবি বিবেচনা করে কোটা প্রথা সংস্কার করা।
কোটা সংস্কারের বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, কোটা ব্যবস্থা একদম থাকবে না, এমনটা নয়। তবে পিছিয়ে পড়াদের জন্য সর্বসাকুল্যে ১০ শতাংশ কোটা রাখা যেতে পারে। এগুলো যেমন- শারীরিক প্রতিবন্ধী, উপজাতি, নারী এবং মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য রাখতে হবে। কোটার জন্য যোগ্য ও মেধাবীরা কোনোভাবেই যেন বঞ্চিত না হয় সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। মেধাবী ও যোগ্যতা সম্মত লোক বঞ্চিত হলে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে।
কোটা সংস্কারের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে বলেন, কোটা পদ্ধতি একটি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। সেই কারণেই আমরা এখানে কোটা পদ্ধতি করেছি। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম নারীদের জন্য কোটা করলেন। অন্যান্য ক্ষেত্রেও কোটা করলেন। পরবর্তীতে সামাকিজ বাস্তবতায় সেই কোটার পরিমাণ হয়তো বাড়ানো কমানো হয়েছে। কিন্তু এখন যে পর্যায়ে এসেছে, আমাদের মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের সুযোগ দেওয়ার জন্য এ পদ্ধতি নিয়ে পুন:মূল্যায়ন করা দরকার। সব ক্ষেত্রেই এখন হয়তোবা কোটার দরকার নেই। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে দরকার আছে। তথ্যের ভিত্তিতে এটা পুনর্গঠন করা যেতে পারে। কিন্তু একেবারে বিলুপ্তি এ মুহুর্তে সম্ভব না। এটা ধীরে ধীরে করা যেতে পারে। প্রতিযোগিতায় যারা একটু পিছিয়ে থাকে তাদেরকে টেনে তুলতে এ কোটা করা হয়। কিন্তু এখন সময় এসেছে কোন গোষ্ঠি বেশি এগিয়ে এসেছে, কোন গোষ্ঠি এখনও পিছিয়ে আছে সেটি মূল্যায়নের। এসব বিবেচনায় নিয়ে কোটা পদ্ধতির বিন্যাস করা দরকার। কারণ মেধাবীদের ক্ষতি করে কোটা প্রথা দেশের জন্য আরও বেশি ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। মেধাবীরা যেন কোনোভাবে উপলব্ধি না করে যে কোটার কারণে তারা সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
কোটা সংস্কারের বিষয়ে অভিন্ন অভিমত দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানও। তিনি বলেন, বর্তমান সময় চাকরিতে বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থার কারণে আমাদের দেশে প্রশাসনে মেধাবীদের চেয়ে কোটাধারী কম মেধাবীরা বেশি জায়গা করে নিচ্ছেন। আর শুধু সাধারণ ক্যাডার কেন, কলেজের শিক্ষক, বিচার বিভাগ সবখানেই তো কোটার কারণে অতি মেধাবীরা বঞ্চিত হচ্ছেন। কাজেই কোটা পদ্ধতির অবশ্যই সংস্কার হওয়া উচিত। কিছু কোটা থাকতে পারে যেমন, শারীরিক প্রতিবন্ধী, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটার আওতাভুক্ত থাকতে পারে। তবে সব মিলিয়ে ১০ শতাংশের বেশির থাকা উচিত।
এব্যাপারে জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও কোটা সংস্কার নিয়ে তৎকালীন গবেষণা টিমের প্রধান ড. আকবর আলি খান একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, অযৌক্তিক’ কোটা পদ্ধতির দৌরাত্ম্যে বিপন্ন হতে বসেছে দেশের বিপুলসংখ্যক মেধাবীর স্বপ্নের ভবিষ্যৎ। সরকারি বিভিন্ন চাকরিতে যোগ্যতার মানদণ্ডে এগিয়ে থেকেও কোটার মারপ্যাঁচে ছিটকে পড়ছে সাধারণ চাকরিপ্রার্থীরা। আর সেখানে কোটার কল্যাণে স্থান করে নিচ্ছে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীরা, ক্ষেত্র বিশেষে সুযোগ নিচ্ছে মেধাহীনরাও। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে কোটা পূরণ না হওয়ায় বছরের পর বছর শূন্যই থেকে যাচ্ছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পদ। এখানেও স্থান নেই মেধা তালিকার ওপরের সারিতে থাকা চাকরিপ্রার্থীদের। তাই এখননি কোটা পদ্ধতি সংস্কার করা উচিত।
কোটা সংস্কারের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক, লেখক ও প্রাবন্ধিক ড. সৌমিত্র শেখর একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, মেধাতালিকা স্বার্থ রক্ষায় কোটা পদ্ধতির বিষয় আমার স্পষ্ট বক্তব্য হলো-বংশ পরম্পরায় চাকরির ব্যাপারটি পুনর্বিবেচনার দরকার। এখানে বড় জোর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পর্যন্ত ঠিক আছে। এ সন্তানদেরও না দিলে-ই ভালো হয়। তবে সার্বিক দিক বিবেচনায় শুধু সন্তান পর্যন্ত রাখা যেতে পারে। পরবর্তী ধাপগুলোর সুযোগ উঠিয়ে দেওয়া উচিত। এটা করলে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ থেকে স্বাভাবিকভাবে কমে আসতে থাকবে। অর্থাৎ আমরা ঘোষণা দিয়ে বন্ধ না করেও পদ্ধতিগতভাবে এটা বন্ধ করে দিতে পারি।
পদ্ধতিটা হলো আমরা যদি বলি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। তাহলে মুক্তিযোদ্ধার নাতি আর আবেদন করতে পারবে না। এটা সরকারে একটা এক্সিট পয়েন্ট বলে আমি মনে করি। সরকারের পক্ষ থেকে একটা সিদ্ধান্ত দিয়ে সেখান থেকে ফিরে আসা কঠিন হয়। আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান করি। আমাদের পরিবার থেকেও মুক্তিযোদ্ধা আছেন। বহুজনের পরিবার থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। এদের অনেকে সার্টিফিকেট নিয়েছেন, আবার অনেকে সার্টিফিকেট নেননি। আমি মুক্তিযোদ্ধাদের সময়ের শ্রেষ্ঠ সন্তান বলে মনে করি। তার মানে এই নয় যে, স্বাধীন বাংলাদেশের ৫০ বছর হতে যাচ্ছে। সেই জায়গাই যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে কিন্তু সার্টিফিকেট নেননি, অথবা পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধ বা এ ধরণের ক্ষেত্র তৈরি হয়নি বলে মুক্তিযোদ্ধা হতে পারিনি। তাদেরকে চাকরির ক্ষেত্রে কোটার মাধ্যমে সঙ্কুচিত করে ফেলি।
সরকার যদি মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের সন্তানদের জায়গাই এসে কোটার বিষয় পুনর্বিবেচনা করেন। তাহলেই আমার মনে সরকারের জন্য এটি ইতিবাচক হবে। এটা বর্তমান প্রজন্মের কাছেও গ্রহণযোগ্য হবে। সরকারের জন্য ভালো হবে। বিষয়টি একটা সম্মানজনক জায়গায় দাঁড়াবে।
কোটা সংস্কারের বিষয়ে একই মত প্রকাশ করলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক, কলামিস্ট ও লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদও। একুশে টিভিকে অনলাইনকে তিনি তিনিবলেন, শারীরিক প্রতিবন্ধী ও দেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের ছাড়া চাকরির ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটাব্যবস্থা পুরোপুরি তুলে দেওয়া উচিত। কোটা পদ্ধতির কারণে তৈরি হচ্ছে এক শ্রেণীর সুবিধাবাদি গোষ্ঠী। ফলে অনেক শিক্ষিত যুবক যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কোটার জাতাকলে পিষ্ট হয়ে নিজেকে মেলে ধরতে পারছেন না। কোটা পদ্ধতি বহাল থাকলে দেশের মঙ্গল তো দূরের কথা জাতি সম্পূর্ণ মেধাহীন হয়ে পড়বে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরি বিশেষ করে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) মাধ্যমে নিয়োগের ক্ষেত্রে ৫৬ শতাংশ কোটা ব্যবস্থা প্রচলিত। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারী কোটায় ১০, জেলা কোটা ১০, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য পাঁচ এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে এক শতাংশ কোটা। বাদবাকি ৪৪ শতাংশ আসনের জন্য লড়াই করছেন সংখ্যাগুরু বিপুল সংখ্যক মেধাবী। সংখ্যাগুরু সাধারণ চাকরিপ্রার্থী এবং সংখ্যালগু কোটাধারীদের মধ্যে এত বড় বৈষম্য পৃথিবীর আর কোনো দেশে নেই।
টিকে