ঢাকা, মঙ্গলবার   ০৫ নভেম্বর ২০২৪

কোটি টাকা নিয়ে গা ঢাকা দিয়েছে এমটিএফইর রাজশাহীর প্রতারকরা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৬:০১, ২১ আগস্ট ২০২৩

অ্যাপের ফাঁদে ফেলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া চক্রের রাজশাহী অঞ্চলের মূল হোতারা এখন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে দুবাইভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ (এমটিএফই) বন্ধ হওয়ার পর পরই তারাও গা ঢাকা দিয়েছে। তাদের মাধ্যমে হাজারও যুবকের কয়েকশ কোটি টাকা খোয়া গেছে। 

জানা গেছে, সম্প্রতি এমটিএফই অ্যাপের বিরুদ্ধে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাংবাদ প্রচার হয়। সাংবাদটি আলোচিত হলে অজ্ঞাত আসামী করে গত ২৩ জুলাই রাজশাহী জজ কোর্টের এডভোকেট জহুরুল ইসলাম বাদি হয়ে সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের করেন। মামলাটি রাজপাড়া থানা পুলিশ, সিআইডি ও পিবিআইকে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন আদালত। তবে কোন আসামীকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা। 

বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাংবাদ প্রকাশের পরে বাংলাদেশ ব্যাংক সতর্ক বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। তারপরেও কার্যক্রম বন্ধ ছিলো না এমটিএফই অ্যাপের। এর মধ্যে গত ১৯ অগস্ট বন্ধ হয়ে যায় এমটিএফই অ্যাপ। এমটিএফই অ্যাপ বন্ধ হয়ে গেলে টনক নড়ে আ্যপে টাকা বিনিয়োগকারী রাজশাহীর হাজারও যুবকের। রাজশাহীতে ওই অ্যাপের প্রচারকারিদের বাড়িতে ছুটছে বিনিয়োগকারীরা।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, প্রায় শত কোটি টাকা এমটিএফই অ্যাপে বিনিয়োগ করে ধরা খেয়েছে রাজশাহী অঞ্চলের হাজারও যুবক। এমটিএফই অ্যাপ রাজশাহীতে প্রচারকারীরা সবাই বর্তমানে গা-ঢাকা দিয়েছে। বিভিন্ন উন্নত মানের রেস্টুরেন্ট ভাড়া নিয়ে সভা সেমিনার করে এমটিএফই আ্যপে বিনিয়োগ করার প্রচার চালাতেন তারা। অ্যাপটি উধাও হয়ে যাওয়ার পর দিশেহারা হয়ে পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা। কর্মকর্তাদেরও খুঁজে পাচ্ছেন না তারা।

রাজশাহী রাজপাড়া এলাকার সবুজ এমটিএফই আ্যপের সিইও ছিলেন। তার নেতৃত্বে কাজ করতেন শতাধিক যুবক। রাজশাহী নগরীসহ ৯টি উপজেলায় এমটিএফই অ্যাপের প্রচার প্রচারণা চালাতেন তারা। এছাড়াও তাদের কার্যক্রম নওগাঁ, সাপাহার ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় বিস্তৃতি ছিল। তাদের বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে সাধারণ মানুষকে নিয়ে গিয়ে এমটিএফই অ্যাপ প্রচারে বহু সভা সেমিনার করতে দেখা গেছে। সেমিনারের করে এমটিএফই অ্যাপের প্রচার করেছে এমন বহু ছবি ও ভিডিও এ প্রতিবেদকের হাতে রয়েছে। 

সবুজের সহযোগিদের মধ্যে অন্যতম রাজপাড়া এলাকায় এমটিএফই অ্যাপের সিইও আমজাদ, হুরায়, সবুজের স্ত্রী আশা মনি, চাঁপাইনবাবগঞ্জ শিবগঞ্জের সাকিল, নওগাঁ মহাদেবপুরের বাবু। 

এছাড়াও আলটিমা আ্যপ বন্ধ হওয়ার পরে এমটিএফইতে যোগদান করেন তানোর উপজেলার সাওর হাতিসাইল গ্রামের মুঞ্জিল প্রামানিকের ছেলে মাহমুদুর রহমান। মাহমুদুর আলটিমা অ্যাপে গ্রীন ডায়মন্ড পদে ছিলেন তিনি। ৫ থেকে ৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে মাহমুদুর। তার বিরুদ্ধে মামলা হলেও তাকে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। এ মামলা তদন্ত করছেন আরএমপির ডিবি পুলিশের এসআই আশরাফুল ইসলাম। 

অপরদিকে, চাঁপাইনবাগঞ্জ গোমস্তপুর চৌডালা কদমতলি গ্রামের জুল মোহাম্মাদ সরদারের ছেলে নুরুন্নবি পলাশ। তিনি বর্তমানে তেরোখাতিয়া স্টেডিয়ামের পুর্ব পাসে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকেন। পলাশ আলটিমা অ্যাপের পারপেল ডায়মন্ড পদে থেকে প্রতিদিন রেক্স বোনাস ৪৫ লাখ করে পেতেন। তিনি প্রায় ৫ থেকে ৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। পরে এমটিএফই অ্যাপে যোগদান করে সিইও পদে থেকে ২০ কোটি টাকার ডলার প্রতিদিন কেনা বেচা করতেন।

শিবগঞ্জের তরিকুল ইসলাম এমটিএফই একউন্টে ৩৬ লাখ ডলার সব সময় থাকতো। প্রতিদনি ১৫ থেকে ১৬ লাখ টাকা কামিয়েছে। প্রায় ৫০ কোটি টাকা কামিয়েছে এমটিএফই অ্যাপের মাধ্যমে তরিকুল ইসলাম।

রাজশাহী বাগমারা উপজেলার তাহেরপুরের প্রায় ৩ শতাধিক মানুষ এমটিএফই অ্যাপে কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ধরা খেয়েছে। তাহেরপুরে এমটিএফই অ্যাপে বিনিয়োগ করার জন্য কিছু যুবক প্রচার করে। এর মধ্যে কেউ কোটি টাকা কামিয়েছে আর বেশির ভাগ মানুষ ধরা খেয়েছে। এছাড়াও বাগমারার সোনাডাঙ্গা ইউনিয়নের লিকড়াপাড়া গ্রামের ১৬০ জন মানুষ প্রায় কোটি টাকা বিনিয়োগ করে সর্বশান্ত হয়েছে। এদের মধ্যে সবচে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ওই গ্রামের আব্দুর রহমান, বিপুল, সাগর, সৈকত।

নগরীর রাজপাড়া থানার ভেড়িপাড়া এলাকার ফিরোজ আলী এমটিএফইতে ১৪ লাখ টাকা খুয়েছেন। সবুজের মাধ্যমে তিনি এই অ্যাপে তিনি বিনিয়োগ করেন। 

ফিরোজ বলেন, অ্যাপ বন্ধ হয়ে পাওয়ার পর সবুজের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি আমাকে জানিয়েছেন টাকা আমি তুলে দিবো। কিন্তু এখন আর সবুজকে খুজে পাচ্ছি না।

ফিরোজ আরও বলেন, সবুজ ও তার পিতা ডালু, মা এবং সবুজের স্ত্রী সবাই জড়িতো এমটিএফই অ্যাপের সাথে। আমি শুধু না, তাদের কথা শুনে শুধুমাত্র রাজপাড়া এলাকায় শতাধিক যুবক কোটি টাকা বিনিয়োগ করে সর্বশান্ত আজ। দ্রুত তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা না নিয়ে তারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান ফিরোজ আলী।

এমটিএফই রাজশাহীতে প্রচারকারি ও সিইও সাকিল হোসেনের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আগে করতাম। এখন করিনা। আপনারা নিউজ করার জন্য করিনা আর।

তিনি আরো বলেন, মানুষ কতো কোটি কোটি টাকা বিদেশে অর্থ পাচার করছে তাদের বিরুদ্ধে লিখতে পারেন না, আমাদের পিছনে লেগেছেন। 

এর আগেও রাজশাহীতে মুভি অ্যাপ নামের একটি অ্যাপে টাকা বিনিয়োগ করে মানুষ কোটি কোটি টাকা প্রতারণার শিকার হয়েছে। মুভি অ্যাপের রাজশাহীর নগরীর শিরোইলে অফিস খুলে বসে ছিলেন মানিক নামের এক যুবক। ওই অ্যাপে গোদাগাড়ীর প্রেমতলী এলাকার শতাধিক মানুষ টাকা বিনিয়োগ করে প্রতারণার শিকার হয় হঠাৎ অ্যাপ বন্ধ হয়ে গেলে। ওই ঘটনায় আরএমপি চন্দ্রীমা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হলে বেশকিছু আসামী গ্রেপ্তার হয়।

যুবক, ডেসটিনির পর এবার এমএলএম ব্যবসার নামে প্রায় হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে দুবাইভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ (এমটিএফই)। এমএলএম কম্পানির এই প্রতারণায় জড়িয়ে সর্বস্বান্ত দেশের লক্ষাধিক যুবক।

দুই সপ্তাহ আগে তথাকথিত সিস্টেম আপগ্রেডের মাধ্যমে সমস্যার শুরু। এর পর থেকে ব্যবহারকারীরা অ্যাপটি থেকে কোনো টাকা তুলতে পারছিলেন না।

গত বৃহস্পতিবার রাতে প্রায় সব ব্যবহারকারীর ভার্চুয়াল অ্যাকাউন্ট ঋণাত্মক দেখানো শুরু করে অ্যাপটি। গ্রাহকদের পক্ষে স্বয়ংক্রিয় লেনদেনের পর বিপুল লোকসান হয়েছে বলে দাবি করেছে অনিয়ন্ত্রিত এই সংস্থা। এমটিএফই দাবি করেছিল, তারা কানাডায় নিবন্ধিত সংস্থা। এর কার্যক্রম শ্রীলঙ্কা, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান ও ভারতেও ছড়িয়ে ছিল। এসব দেশের ব্যবহারকারীদেরও পরিণতি একই।

সূত্র জানায়, ক্রিপ্টো, বৈদেশিক মুদ্রা, পণ্য, এমনকি বিদেশি স্টক পর্যন্ত নিজের ছায়া প্ল্যাটফরমে ট্রেড করার সুযোগ দিয়ে এই অ্যাপ সম্প্রতি অবিশ্বাস্য রকমের জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। ট্রেডিং থেকে উপার্জন এবং অর্থ পরিশোধের কথা বলে অ্যাপটি ব্যবহারকারীদের অবিশ্বাস্য সহজ পথে অর্থ আয়ের আমন্ত্রণ জানায়। বাংলাদেশে মোট কতজন এই স্কিমের প্রতারণার শিকার হয়েছেন, এর কোনো স্পষ্ট তথ্য নেই।

তবে গ্রাহকদের বিভিন্ন দলের নেতারা অনুমান করছেন, এই সংখ্যা এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ হতে পারে। তাঁদের ধারণা, এই কাণ্ডে প্রায় হাজার কোটি টাকা খুইয়েছেন বিনিয়োগকারীরা।

এসবি/ 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি