কোথায় হারালো সেই আদর্শ লিপির নীতিকথা
প্রকাশিত : ১৭:১৬, ২৮ মার্চ ২০২০
ছোটবেলায় বাংলা সিনেমায় দেখতাম অনেক শিক্ষণীয় বিষয় থাকতো। বাবা-মা সন্তানের অনৈতিক কাজকর্ম সমর্থন করতেন না। সন্তানের ঘুষের টাকার খাবার ছুঁতেন না। অপকর্ম করলে বৃদ্ধ বাবা প্রতিবাদে ঘর ছেড়ে চলে যেতেন। সেই বাংলা সিনেমা এখন হারিয়ে গেছে।
কাঠ পেন্সিল ধরার শুরুতে হলুদ রঙের আদর্শ লিপি বই ধরতে হয়েছিল। উচ্চস্বরে পড়তে হতো ‘ উর্ধমুখে পথ চলিওনা। গুরুজনে ভক্তি করো। অসহায়দের প্রতি সদয় হও। অহংকার পতনের মূল।’ ইত্যাদি। সেই আদর্শলিপি হারিয়ে গেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখন কি আদর্শ শিক্ষা দেয়া হয় তা টের পাওয়া যায় পথে-ঘাটে।
হাফপ্যান্ট পড়া বয়েসেই মা শিখাতেন মুরুব্বিদের সালাম দিতে হয়। কদমবুচি করতে হয়। এখনকার মা জি-বাংলার বেয়াদবি দেখানো শেখান। সমাজের অধঃপতন হবে নাতো কি হবে?
করোনার এই সময়ে কাজে বের হয়েছে বলে যশোরের এসিল্যান্ড সাইয়েমা হাসান তার বাপের বয়েসি ভ্যানচালকদের প্রকাশ্যে কান ধরে উঠবস করালেন। তখন তার চোখে বাবার চেহারাটি একবারও ভেসে উঠলোনা? আমরা কোথায় নেমেছি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আরও ছবি দেখলাম রিকশা চালককে কান ধরে দাঁড় করাতে। অপরাধ কি? করোনার এই খারাপ সময়েও রিকশা নিয়ে বের হয়েছে দুটাকা উপার্জনের আশায়। ওদের টাকা গচ্ছিত নেই। দিনে এনে দিনে খেতে হয়। যারা ওদের কান ধরে উঠবস করালেন। লাঠির দাগ বসিয়ে দিলেন। আদর্শ লিপির নীতিবাক্য বাদই দিলাম। ওদের বাসার খাবার কি আপনি দিয়ে আসবেন। ৩৪ ডিগ্রি তাপমাত্রায় রোদে পুড়ে কার সখ প্যাডেল মেরে হাপাতে। একজনের গায়ে লাঠি তোলার আগে নিজের বাবার চেহারা ভাবুন। এসব দৃশ্য দেখে এক বন্ধুর লেখাটি মর্মস্পর্শী ছিল।
ইঞ্জিনে রিক্সা চালানো বন্ধ হয়েছে। ইঞ্জিনের সঙ্গে উধাও হয়েছেন তরুণ রিক্সা চালকেরা। তারা বিকল্প পেশায় চলে গিয়েছে। এই শহরে যারা রিক্সা চালায় তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেছেন? সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদে বাকি সবাই বয়োবৃদ্ধ। চুল দাঁড়ি পেকে সাদা হয়ে গেছে। শরীরের হাড় ও পাজর গণনা করা যায়। জরাজীর্ণ জামা, লুঙ্গী। প্যাডেল মারার সময় বয়সী পায়ের শিরা ও রগ ফুলে ফুলে ওঠে।
তবুও তাদের ফুসরত নেই। থেকে নেই প্যাডেল মেরে নিজের ও পরিবারের জীবন বাঁচানোর লড়াই। ওদের ঘরে জমিয়ে রাখা অর্থ নেই। থাকলে করোনা সংক্রমণের এই ভয়াল সময়ে ওরা হয়তো চরম ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় নামতো না। কিন্ত বাস্তবতা হলো এই, একবেলা আয় না করলে পরের বেলা গোটা পরিবার নিয়ে অভুক্ত থাকতে হয়।
হুকুম অমান্য করে রাস্তায় বের হওয়ায় ওরা শাস্তিযোগ্য অপরাধে অপরাধী। রাষ্ট্র আপনাকে বন্দুক দিয়েছে, বেয়নেট দিয়েছে, ব্যাটন দিয়েছে। প্রয়োগের সুযোগ তো আর রোজ রোজ আসেনা! অতএব অপেক্ষা না করে হাতের লাঠির সদ্ব্যবহার করুন।
তবে পিটুনি খেয়ে খোড়াতে খোড়াতে ওরা যখন ফিরে যাবে, তখন অন্তত কেজি খানেক চাল, ডাল, আলু, তেল, ম্যাচ রিক্সার পাদানিতে ছুড়ে দিয়েন।
ওর ব্যথা জর্জরিত শরীর আর অপমানক্লিষ্ট মনে প্রলেপ লাগানোর দায়িত্বটা না হয় আর সব সময়ের মতো ওর বউই পালন করবে।
হায়রে সমাজ, হায়রে রাষ্ট্র, হায়রে সভ্যরা! এই সমাজে করোনা আগ্রাসী হবেনাতো কি হবে?
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।