কোমল পানির নামে কি বিষ খাচ্ছি?
প্রকাশিত : ১৪:৩৯, ২৩ জুলাই ২০১৮ | আপডেট: ১১:১৯, ২৪ জুলাই ২০১৮
বাইরে গরম পড়ছে বেশ। গরমে মানুষের দিশেহারা অবস্থা এক প্রকার বলা যায়। এমন গরমে দোকান থেকে কিনে কোমল পানীয় পান করেন না এমন কেউ আছেন ভাবাটা এক প্রকার কঠিন বলা যায়। ফ্রিজ থেকে বের করা একটি কোমল পানীয় অামাদের দেহ ও মনে এনে দেয় তৃপ্তি। কিন্তু অামরা কী একবারও ভেবে দেখেছি, এই কোমল পানীয় অামাদের জন্য উপকারী নাকি ক্ষতিকর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাজারে যেসব কোমল পানীয় পাওয়া যায় তার কম বেশি সবই অামাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
এই কোমল পানীয়তে ব্যবহৃত হয় প্রচুর পরিমাণ চিনি। যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। পাশাপাশি শরীরে পানি শোধন প্রক্রিয়ায় কোমল পানীয় কিডনির ওপর চাপ ফেলে। অর্থাৎ সাধারণ মিনারেল ওয়াটার শোধন যতোটা স্বাভাবিকভাবে হয় কোমল পানীয় তা না হওয়ায় কিডনীতে প্রভাব ফেলে। শুধু এখানেই শেষ নয়। শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হৃদপিন্ড, লিভার বা যকৃতও নিয়মিত কোমল পানীয় পান করলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কোমল পানীয় পানে বাড়ে ক্যান্সারের ঝুঁকি। তাই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা নিষেধ করছেন কোমল পানীয় পান করতে।
কোমল পানীয় আসলেই স্বাস্থ্যসম্মত কি না, এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে ও হচ্ছে। সুইডিশ বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণা প্রতিবেদনে দেখিয়েছেন, কোমল পানীয় আসলে কোমল নয়। প্রতিদিন একটি কোমল পানীয় পানে মূত্রথলিতে ক্যান্সারের ঝুঁকি প্রায় ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।
জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অধ্যাপক অাবদুস সালাম বলেন, কোমল পানীয় প্রস্তুত করার সময় যেসব রং মেশানো হয়, তা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। আর ওই পানীয়কে আকর্ষণীয় করতে যে ‘ফুড অ্যাডিটিভ’ ব্যবহার করা হয় সেই উপাদানও কম ক্ষতিকর নয়। কোমল পানীয় মোটেও উপকারী নয়, এটি মানবদেহের প্রতিটি অঙ্গের ক্ষতি করে।
গবেষকদের দাবি, একটি ৫০০ গ্রামের কোমল পানীয়ের বোতলে ১৭০ ক্যালরি সোডা ও ১৫ চামচ চিনি ব্যবহার করা হয়, যা ক্ষুধামন্দা, অবসাদ, হার্ট অ্যাটাক, দাঁতের ক্ষয় এবং বন্ধ্যাত্বের মতো রোগের ঝুঁকি মারাত্মকভাবে বাড়িয়ে দেয়। কেবল তাই নয়, লিভার সিরোসিস, হাঁপানিসহ ফুসফুসের নানা জটিল রোগ, ওজন বেড়ে যাওয়া, পাকস্থলীতে ক্যান্সারসহ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও অনেকগুণ বেড়ে যায় কোমল পানীয় গ্রহণের ফলে।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. গোবিন্দ চন্দ্র রায় একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে বলেন ‘কোমল পানীয় পানে সাময়িক তৃষ্ণা মেটে, সাময়িক শান্তি হয়তো হয়, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী বিবেচনায় এর প্রতিক্রিয়া সাংঘাতিক। কোনওভাবেই এটি স্বাস্থ্যসম্মত নয়। কোমল পানীয়তে ব্যবহৃত রিফাইন সুগার মানবদেহের প্রতিটি অঙ্গের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
ডা. গোবিন্দ চন্দ্র রায় আরও বলেন, ‘অনেকে মনে করে থাকেন কোমল পানীয় হজমে সাহায্য করে। কিন্তু মানব শরীর খাবার হযমের জন্য প্রয়োজন হয় সাধারণত ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা। অথচ কোমল পানীয় গ্রহণ করার সময় এর তাপমাত্রা থাকে ৩ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর খাবারের পরপরই যখন একেবারে ফ্রিজ থেকে বের করা কোমল পানীয় পান করা হয়, তখন হজমে সাহায্য তো দূরে থাক, সেটি ভেতরে পচন ধরায়।’
তিনি অারও বলেন, যাদের হার্টে সমস্যা, কোলেস্টরেল বেশি, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, ওজন বেশি তাদের কোনওভাবেই কোমল পানীয় পান করা যাবে না।
ডা. গোবিন্দ চন্দ্র রায় পশ্চিমা দেশগুলোর উদাহরণ টেনে বলেন, মুটিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ এই কোমল পানীয়। আর এই অতিরিক্ত ওজন মানবদেহের সব রোগের অন্যতম উৎস।’ কয়েকটি বিদেশি জার্নালের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, কোমল পানীয় যেন বরফের মতো জমাট না বাঁধে, সেজন্য এতে ইথিলিন গ্লাইকোল নামের এক ধরনের উপাদান ব্যবহার করা হয়, যা আর্সেনিকের মতো ক্ষতিকর। যারা অধিকমাত্রায় এই জাতীয় পানীয় পান করে থাকেন, তাদের কিডনিতে পাথর জমা হওয়ার হার প্রায় তিনগুন বেশি। আবার এসব পানীয়তে যে স্যাকারিন ব্যবহার করা হয়, তা মূত্রাশয়ের ক্যান্সারের অন্যতম কারণ।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. আবু সায়ীদ বলেন, বাজারে যেসব কোমলপানীয় পাওয়া যাচ্ছে তা মানুষের ব্রেইন, কিডনি ও লিভারকে ক্ষতিগগ্রস্ত করে। ঝুঁকি থাকে স্ট্রোক ও ক্যানসারেরও। কোমল পানীয়গুলোতে এক ধরনের কার্বোনেটেড সুডা থাকে যা খেলে মানুষের উদরাময় হয় ও ক্ষুধামন্দা হয়। এছাড়া কোমল পানীয়গুলোতে স্যাকারিন ও এসপার্টেজের উপস্থিতির কারণে তা মানুষের ব্রেইনের নার্ভকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, স্নায়ু দুর্বল করে ফেলে এবং মূত্রথলিতে ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। কোমল পানীয়গুলোতে আরও আছে প্রিজারভেটিস নামক এক ধরনের কেমিক্যাল যা লিভার ও কিডনির মারাত্মক ক্ষতি করে থাকে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে লিভার বিশেষজ্ঞ ডা. এ এস এম এ রায়হান একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে বলেন, কোমল পানীয়তে থাকে অতিরিক্ত পরিমাণে চিনি। যা লিভার বা যকৃতের জন্য বিপদজনক। লিভার ফ্রুক্টোজ থেকে ফ্যাট বা চর্বি তৈরি করে। ফ্রুক্টোজ এক ধরণের শর্করা বা চিনি জাতীয় খাবার। অতিরিক্ত পরিমাণ পরিশোধিত চিনি এবং উচ্চ মাত্রার ফ্রুক্টোজ সম্বলিত সিরাপ লিভারে এক ধরণের চর্বির প্রলেপ তৈরি করে, যা থেকে পরবর্তীতে লিভারে রোগ তৈরি হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, শর্করা ও চিনি জাতীয় খাবার লিভারের জন্য অ্যালকোহলের মতই বিপদজনক।
কোমল পানীয় হিসেবে অামরা টাকা দিয়ে কিনে যা তৃপ্তির সঙ্গে পান করছি তা কতোটা ক্ষতিকর তা হয়তো অামরা সরাসরি টের পাই না। কিন্তু চাইলে কিছু পরীক্ষা করে নেওয়া যায়। এক চুমুক কোলা যদি এক ঘণ্টা ধরে মুখের ভেতরে রাখেন তাহলে দেখবেন দাঁতগুলো হলুদ হয়ে গেছে।
আবার টয়লেট ক্লিনার হিসেবে কোক ঢেলে এক ঘণ্টা পর ওয়াস করলে দেখা যাবে, অন্যান্য ( বাজারে পাওয়া যায় এমন, হারপিক জাতীয়) টয়লেট ক্লিনারের চেয়ে সেটি বেশি পরিষ্কার করেছে।
তাছাড়া ব্যাটারি বা লোহা জাতীয় দ্রব্যে জং ধরা কাটাতে, কাপড়ে মাংসের ঝোল লেগে গেলে কোমমল পানীয় ব্যবহার করে দাগ দূর করা সম্ভব।
বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষামূলকভাবে দাবি করছেন, এক গ্লাস কোকের ভেতরে একটি দাঁত রেখে দিলে এক সপ্তাহ পর সেই দাঁতের অস্তিত্ব থাকবে না।
১৫ বছর ধরে গবেষণা করার পর সুইডিশ বিজ্ঞানীরা অারও বলেছেন, যারা প্রতিদিন ৩০০ মিলিলিটার কোমল পানীয় পান করেন, অন্যান্য মানুষের চেয়ে তাদের মূত্রথলিতে ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা ৪০ শতাংশ বেশি। বিজ্ঞানীরা প্রায় ৪৫ থেকে ৭৩ বছর বয়সী আট হাজার সুস্থ মানুষের ওপর ১৫ বছর ধরে গবেষণা চালান। এ সময় তাদের খাদ্যাভ্যাস পর্যবেক্ষণ করা হয়। গবেষণা শেষে যাদের মূত্রথলিতে ক্যান্সার হয়েছে, তাদের খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে সুস্থ মানুষের খাদ্যাভ্যাস মিলিয়ে দেখা হয়। দেখা গেছে, যারা কোমল পানীয় পান করেননি, তাদের চেয়ে যারা পান করেছেন তাদের মূত্রথলিতে ক্যান্সার হওয়ার হার ৪০ শতাংশ বেশি। তবে কোমল পানীয়র সঙ্গে মূত্রথলির ক্যান্সারের কী সম্পর্ক তা নিয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেন নি তারা।
এসএইচ/