ঢাকা, মঙ্গলবার   ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪

কোরআন ও হাদিসের আলোকে পবিত্র শবে-বরাত

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৩:৫০, ১ মে ২০১৮

আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। আরবি শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে লাইলাতুল বরাত কিংবা শবেবরাত বলে। ‘শব’ কিংবা ‘লাইলা’ শব্দের অর্থ রাত। আর ‘বারাআত’ অর্থ হচ্ছে মুক্তি। বাংলায় ‘বরাত’ শব্দটি ভাগ্য বা সৌভাগ্য অর্থে ব্যবহৃত হলেও আরবিতে এ শব্দটির অর্থ সম্পূর্ণ ভিন্ন। আরবিতে “বারাআত” শব্দটির অর্থ বিমুক্তি, সম্পর্কচ্ছিন্নতা, মুক্ত হওয়া, নির্দোষ প্রমাণিত হওয়া ইত্যাদি।

ফার্সি ‘শবেবরাত’, আরবি “লাইলাতুল বারাআত” বা “বিমুক্তির রজনী” বলতে আরবি ৮ম শাবান মাসের মধ্যম রজনী বুঝানো হয়। সুতরাং মানুষ যদি এ রাতে নিজ কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে চক্ষু হতে অশ্রু প্রবাহিত করে তাহলে মহান রাব্বুল আলামিন তার পাপরাশি মুক্ত করে দেন। কুরআন ও হাদিসে “লাইলাতুল বারাআত” পরিভাষাটি ব্যবহার করা হয়নি। সাহাবী-তাবিয়ীগণের যুগেও এ পরিভাষাটির ব্যবহার জানা যায় না। এ রাতকে হাদিস শরীফে “লাইলাতুন নিসফি মিন শা’বান” বা “মধ্য শা’বানের রজনী” বলা হয়েছে। সাহাবী-তাবিয়ীগণের যুগের অনেক পরে এ রাতকে “লাইলাতুল বারাআত” বা “বিমুক্তির রজনী” বলে আখ্যায়িত করার প্রচলন শুরু হয়। মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিকরা উল্লেখ করেছেন যে, ৪৪৮ হিজরি সনের বাইতুল মুকাদ্দাসে প্রথম এ রাতে এ পদ্ধতিতে সালাত আদায়ের প্রচলন শুরু হয়। মিরকাতুল মাফাতীহ ৩/৩৮৮

তবে কুরআনুল কারীমের একটি আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাস্সিরগণ “শবেবরাত” প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, “আমি তো তা অবতীর্ণ করেছি এক মুবারক (বরকতময়) রজনীতে এবং আমি তো সতর্ককারী। এ রজনীতে প্রত্যক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরিকৃত হয়। (সূরা দুখান-৩-৪ আয়াত)। অবশ্য অধিকাংশ মুফাসসির একে শবেকদরের সাথেই সম্পৃক্ত করেছেন। অবশ্য ‘শবেবরাত’ বা ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’সম্পর্কে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে।

শবেবরাতের গুরুত্ব : এ সম্পর্কে হাদিসে ব্যাপক আলোচনা বিদ্যমান রয়েছে। এক হাদিসে রয়েছে- নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, তোমরা রমজান মাসের জন্যে শাবান চাঁদের হিসাব রাখো। হুজুর (সা.) রমজানের রোজা ব্যতীত শাবান মাসে যতো অধিক রোজা রাখতেন, অন্য মাসে ততো অধিক রোজা রাখতেন না। এ জন্যেই হুজুর (সা.) শাবান মাসকে নিজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছেন। হযরত আসমা ইবনে জায়েদ (রা.) সূত্রে বর্ণিত-রাসূল ইরশাদ করেছেন: শাবান আমার মাস, আর রমজান আল্লাহ্র মাস।

আবু মুসা আশআরী (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ বলেছেন,“মহান আল্লাহ বরাত রজনীতে তাঁর সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন (ইবনু খাজাহ)।” আবু সা’লাবা আল-খুশানী (রা:) বলেন, রাসূলুল্লাহ বলেছেন : “যখন মধ্য শাবানের রাত আসে, তখন আল্লাহ্ তা’য়ালা তাঁর সৃষ্টি জীবের প্রতি দৃকপাত করেন। অতঃপর মুমিনদেরকে মার্জনা করে দেন। আর হিংসা-বিদ্বেষ ও পরশ্রীকাতরতায় লিপ্তদেরকে তাদের অবস্থায় ছেড়ে দেন (আম সুন্নাহ-২২৩-২২৪ পৃ)।

হযরত আয়শা (রা.) বলেন, শবেবরাতে চলতি বছরে জন্মগ্রহণকারী আদম সন্তানদের নাম এবং চলতি বছরে মৃত্যুবরণকারী আদম সন্তানদের নাম লিপিবদ্ধ করা হয়। এ রাতে আদম সন্তানদের আমল উঠিয়ে নেয়া হয় এবং তাদের রিযক অবতীর্ণ হয়। (বায়হাকী) আবূ উমামা (রা.)-এর সূত্রে বর্ণিত আছে যে, পাঁচ রাতের দোয়া বিফল হয় না। শবেকদর, শবেবরাত, জুমার রাত, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার রাত।”

মহানবী (সা.) শবেবরাত অর্থাৎ ১৫ শাবানের দিনে রোজা রাখা এবং রাতে ইবাদত করার জন্য বিশেষভাবে উৎসাহিত করেছেন। মিশকাত শরীফে হযরত আলী (রা.) হতে বর্ণিত, হুজুর (সা.) ইরশাদ করেন : শাবানের ১৫তম রজনী উপনীত হলে তোমরা সে রাতে অধিক হারে আল্লাহ্র ইবাদত করো। অতঃপর দিনের বেলা রোজা পালন করো। সেদিন আল্লাহ্তায়ালা সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে প্রথম আকাশে অবতীর্ণ হন এবং আহ্বান করতে থাকেন- আছে কি কেউ ক্ষমা প্রার্থনাকারী, আমি তাকে ক্ষমা করবো; আছে কি কোনো রিজিক অন্বেষণকারী, আমি তাকে রিজিক দান করবো; আছে কি কেউ বিপদগ্রস্ত, আমি তাকে বিপদমুক্ত করবো। এভাবে সুবহে সাদিক পর্যন্ত আহ্বান করতে থাকেন। (মিশকাত-১/)।

উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত- তিনি বলেন, এক রাতে আমি, রাসূল (সা.)কে পেলাম না। খুঁজতে বের হয়ে দেখি- তিনি মদিনা শরীফের সর্ববৃহৎ গোরস্তান ‘জান্নাতুল বাক্বি’তে আছেন। আমাকে দেখে তিনি বললেন, আয়েশা! তুমি কি জানো আজ কোন্ রজনী? আমি বললাম না। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বললেন, আল্লাহ্তায়ালা বরাত রজনীতে নিকটতম আকাশে অবতীর্ণ হন এবং ‘কল্ব’ গোত্রের মেষপালের পশম-সংখ্যারও অধিক ব্যক্তিকে ক্ষমা করেন। আজ সেই রজনী। (মিশকাত-/পৃঃ)

উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা (রাজি.) থেকে আরো বর্ণিত আছে- একদা নবী করিম (সা.) তাকে জিজ্ঞেস করলেন- ‘আয়েশা’! তুমি কি জানো বরাত রজনীতে কী ঘটে? তিনি বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ্ কী ঘটে? হুজুর (সা.) বললেন, এ রাতে নির্দিষ্ট হয় এ বছরে যতো মানুষ জন্মলাভ করবে, এ বছর যেসব মানুষ মৃত্যুবরণ করবে, এ রাতে উপস্থিত করা হয় মানুষের কর্মসমূহ এবং এ রাতে অবতীর্ণ করা হয় মানুষের রিজিকসমূহ। আল্লাহ্তায়ালা এ রজনীতে আদম সন্তানের ব্যাপারে ঘটিতব্য স্থিরিকৃত সকল ফয়সালা যেমন- জন্ম, মৃত্যু, রিজিক বণ্টন ইত্যাদি বিষয়াবলীর তালিকা পৃথকভাবে লিপিবদ্ধ করে নেন এবং সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল ফেরেশতাগণের কাছে তা’ অর্পণ করেন।

হযরত আতা ইবনে ইয়াছার (রা.) বর্ণনা করেন, শবেবরাত উপস্থিত হলে মালাকুল মাওত নামক ফেরেশতাকে একটি তালিকা অর্পণ করে বলে দেয়া হয় যে, এ তালিকায় যতোগুলো নাম লিপিবদ্ধ আছে, তাদের আত্মাগুলো নিধন করে নেবে। অথচ মানুষ বৃক্ষরোপণ, বিবাহশাদি, গৃহনির্মাণ প্রভৃতি কাজ করে যাচ্ছে। হতে পারে তাদের নামও মৃত্যুবরণকারীদের তালিকাভুক্ত হয়ে আছে।

হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রঃ) ফরমান, দুনিয়ার ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতর নামে মুসলমানদের জন্যে দু’টি ঈদ রয়েছে, তেমনি উর্ধ্বাকাশসমূহে ফেরেশতাগণের জন্যেও দু’টি ঈদ রজনী রয়েছে। এর একটি হচ্ছে শবেকদর, অপরটি শবেবরাত। মুমিন বান্দাদের জন্যে ঈদ-উৎসব দিনে থাকে। আর ফেরেশতাদের ঈদ-উৎসব নির্ধারণ করা হয়েছে রাতে। কেননা মানুষ নিন্দ্রা যায় পক্ষান্তরে ফেরেশতাদের কোনো নিন্দ্রা নেই।

এ রজনীতে আল্লাহতায়ালা কিছুসংখ্যক মানুষ ছাড়া সমস্ত ঈমানদার ব্যক্তির গুনাহ্ ক্ষমা করেন। পরিপূর্ণ তওবা ব্যতীত এ রাতে যাদের গুনাহ মাফ করা হবে না তারা হলো ঃ ১. মুশরিক ২. হিংসুক ৩. পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান ৪. পায়ের নিচের গিরা ঢেকে কাপড় পরিধানকারী ৫. মদ্যপানকারী ৬. আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী ৭. যাদুকর ৮. গণক-ঠাকুর ৯. হস্তরেখা দেখে ভাগ্য নির্ণয়কারী ১০. গায়েবের সংবাদদাতা ১১. অন্যায়ভাবে ট্যাক্স আদায়কারী ১২. জালিম সৈনিক ১৩. ঢোল, তবলা হারমোনিয়াম ইত্যাদি বাদক ১৪. গায়ক-গায়িকা, বিদআতী ১৫. জুয়াখেলায় অভ্যস্ত ব্যক্তি।

শবেবরাতে করণীয় : হাদিস শরীফে শবেবরাতের নিম্নোক্ত পালনীয় আমল উল্লেখ রয়েছে ঃ

১। কোনো বিশেষ ব্যবস্থা বা আয়োজন না করে সাধারণভাবে এ রাতে কবরস্থানে যাওয়া এবং মৃত ব্যক্তিদের জন্যে দোয়া করা, দরুদ-ইস্তেগফার পাঠ করে দোয়া করা।

২। এ রাতে জাগ্রত থেকে আল্লাহর ইবাদত তথা কুরআন তেলাওয়াত করা, অধিকহারে দরুদ শরীফ পাঠ করা এবং নফল নামাজ পড়া। তবে নামাজের জন্য কোনো বাধ্যবাধকতা নেই বরং সামর্থ্যানুসারে জামাত ব্যতীত অনির্দিষ্টভাবে নামাজ পড়া এবং নিজের জন্য ও সকল মুসলমানের জন্য রোজা রাখা।

৩। শবেবরাতের পরদিন অর্থাৎ ১৫ শাবান নফল রোজা রাখা। রাসূলে আকরাম (সা.) ইরশাদ করেছেন ঃ যখন তোমাদের সামনে শাবান মাসের পঞ্চদশ রাত শবেবরাত উপস্থিত হয় তখন তোমরা সেই রাতে নামাজ পড়ো আর দিনের বেলায় রোজা রাখো।

শবেবরাতে বর্জনীয় : বরকতময় এ রজনীতে তওবা-ইস্তেগফার ও ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে মহান আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে নিমগ্ন থাকাই মুমিনের কর্তব্য। অথচ কিছুসংখ্যক লোক এ রাতে এমন কিছু কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে, যেগুলো ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যেমন : বোমা ফাটানো, তারাবাজি, আতশবাজি, অতিরিক্ত আলোকসজ্জা, পোলাও-বিরানি ও হালুয়া-রুটি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়া ইত্যাদি। এগুলো নিছক কুসংস্কার বৈ কিছু নয়।

আতশবাজি একটি সামাজিক কুসংস্কার, অপচয় ও অপরাধের কাজ। ইয়াজুজ-মা’জুজ আল্লাহর দিকে তীর নিক্ষেপ করবে তাকে ঘায়েল করার জন্য। আতশবাজির মাধ্যমে অনেকাংশে সেটারই অনুকরণ হয় বলে এটি শরিয়তে নিষিদ্ধ।

 

 টিআর/আরকে


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি