ক্ষমা করো প্রকৃতি
প্রকাশিত : ১১:৪৭, ২২ মার্চ ২০২০ | আপডেট: ১২:৩৫, ২২ মার্চ ২০২০
দমবন্ধ লাগছে। আম্মা গোবিন্দগঞ্জে। ভাইয়া বগুড়ায়। আমরা ৩ বোন ঢাকায়। তবে কেউ কোথাও যেতে পারছি না। এখন যদি আব্বা আর রাসেলটা থাকতো তাহলে হয়তো এত টেনশন লাগতো না। উল্টো আব্বাই টেনশন করতেন আমাদের নিয়ে। আর আমরা আব্বাকে বলতাম টেনশন করোনা তো, ঠিক আছি। মাথার উপর ছায়া দেয়া সেই মানুষটা চলে যাওয়ায় বড় অসহায় লাগছে। একসাথে বড় হওয়া ভাইবোন গুলো আজ সবাই কত দূরে দূরে।
করোনা কী এই দুরত্ব আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে না কাছে টানছে বুঝতে পারছি না। ঘরে ঘরে আজ করোনা আতংক। কী হবে কী হবে ভাবনা সবার।
সারাবিশ্ব এক আতংকে স্থির। সবাই বাঁচাতে চায় পরিবারের মানুষগুলোকে। ছোট চাচা লন্ডনে। ১৪ তারিখে বাংলাদেশে ফেরার কথা ছিলো। সেদিন ভাইবারে জানান, আসছেন না দেশে। ওখানে ঘোষণা দেয়া হয়েছে ৭০ বছর বয়স যাদের তারা যেন ফ্লাই না করে। কারণ তাদের আক্রান্তের ঝুঁকি বেশি। ম্লান হেসে বলেন, তোমাদের চিন্তায় আছি মা। লন্ডনের অবস্থা ভালো না। মানুষ হুমড়ি খেয়ে জিনিসপত্র কিনছে। বলেন বাঙালি বৃটিশ সব যেন এক হয়ে গেছে।
কানাডার প্রেসিডেন্ট জাষ্টিন ট্রুডো আশ্বাস দিচ্ছেন সবাইকে ঘরে থাকার। বলছেন বাড়ি ভাড়া খাবার সব পৌঁছে দিবে তার সরকার। তাঁর উপর ভরসা করতে বলছেন। কানাডায় থাকা দেবর ননদরা জানায় ওরা সবাই আতংকে আছে। তবে বেশি চিন্তায় আছে দেশ নিয়ে। এত মানুষের দেশ। কী হবে!
মনে মনে বলি আমরা সাহসী জাতি। আমরা কোন কিছুকে পরোয়া করিনা। আমরা বিদেশ ফেরত হয়ে ঘুরে বেড়াই সারাবাংলা। বুক ফুলিয়ে গল্প করি সবদিক ম্যানেজ করার। আমরা স্বেচ্ছা নির্বাসনে যাই না। আমরা গলা জড়িয়ে ধরি প্রিয় বন্ধুর, সন্তানের। আমরা তখন ভুলে যাই আমার কারণে ক্ষতি হতে পারে আমার বন্ধুর, প্রিয় আত্মজার।
ফলাফল বরিশাল বরগুনায় পাওয়া যায় করোনা রোগী। এর মাঝে আসে যেন ছুটির উৎসব। স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমরা ছুটে যাই সমুদ্রের কাছে। গিজগিজ মানুষের মাঝে করোনা যেন দাঁত বের করে হাসে। ভাবে কি বোকা মানুষ সব। এইতো পেয়ে গেছি আশ্রয়। মনের সুখে থাকা যাবে। কত প্রজাতির রঙিন মানুষ এখানে।
হুশ কি হয় আমাদের। করোনা ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশ। ভাবতে বসি রাজধানী থেকে তৃণমূল পর্যায়ে যত রাজনৈতিক দল আর দলের অংগ সংগঠন আছে সবাইকে কাজে লাগাক সরকার, সাথে আমাদেরও। ইভাপ্রিয়, থাকেন লালমাটিয়ায়। শান্ত শিষ্ট একজন সাধারণ নাগরিক। সপ্তাহ খানেক আগে প্রথমে একগজ কাপড় কিনে ৯টা মাস্ক বানান। বিলি করেন রিক্সাওয়ালাদের মাঝে। ওরা প্রথমে নিতে চায়নি, বলে এ রোগ তাদের হবেনা। বড়লোকদের হবে। ইভা তাদের বুঝিয়ে মাস্ক পরান। এরপর বানান ২০টা। এবার আর বুঝাতে হয়নি। আগ্রহ করেই এখন মাস্ক নেয় রিক্সাওয়ালারা। বরকে সাথে নিয়ে এখন রাস্তায় মাস্ক বানিয়ে বিলি করেন তিনি । ইভার কথা, আমি তো বেশী কিছু করতে পারবনা। এই দিয়েই না হয় থাকি মানুষের পাশে। ওর কথায় কান্না পায়। সাহসী হ্ই। আমি/ আমরা যখন ভাবছি তখন ইভা একধাপ এগিয়ে। মানুষের জন্য কল্যাণ কামনায় ধীরে ধীরে জাগছে মানুষ।
কদিন আগে ডেইলী ষ্টার একটা নিউজ করেছিলো ঢাকায় গাছের পাতায় ধুলো নিয়ে। পথ চলতে প্রতিদিনই ধুলোমাখা গাছের পাতা চোখে পরে আমাদের। কিস্তু আমরা বুঝতে পারিনি ওর নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আমরা ওর গায়ে পেরেক ঠুকি, ডাল কাটি, আমরা নদী দখল করি, পাহাড় কাটি। সবুজ পোকাদের তাতে বুঝি অভিমান হয়। অভিযোগ করে হয়তো বিধাতার কাছে। সব কি মানুষের? আমাদের কি কিছুই নেই? আমরা যে হারিয়ে যাচ্ছি। আর যে পারিনা। প্রকৃতির মনে হয় এসব দেখে রাগ হয়। তাই বুঝি গৃহে বাঁধতে চাইলো সে। সুপার পাওয়ারের যুগে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছোটা মানুষকে থামাতে বুঝি সে করোনার ভয় দেখায়।
চায় সে, অনেক হয়েছে এবার থামো মানুষ। আর ধ্বংস করনা ধরনীকে। স্থির হও। নির্ভর করো প্রকৃতির উপর। বুঝাতে চাইলো সময় দাও পরিবারকে। কত মধুর সকাল, মিঠে দুপুর তুমি হারিয়েছ জীবন থেকে। তোমার স্ত্রী/ স্বামী দিনের পর দিন অপেক্ষা করেছে ঘুরবে তোমার সাথে। তুমি আসোনি। একাই হয়তো মনমরা হয়ে বেড়াতে গেছে সে । বাচ্চাটা বাবা অথবা মার হাত ধরে ঘুরতে পারেনি সবুজ মাঠে। বিষন্ন হয়ে বড় হয়েছে সে। তারও তো ইচ্ছে ছিল হলুদ প্রজাপতি ধরার। ধরেনি। ছোট মেয়েটা বায়না করে । মা বলে বাবা নিয়ে আসবে, বাবা বলেন মা। আপনি আনতে পারেন নি। বাবা মার কোলে শুয়ে শিশুর আর গল্প শোনা হয়নি। আপনি আপনারা আমরা সবাই তখন ছুটছি পাওয়ারের খোঁজে। টাকার নেশায়। ঘরকে পর করে দিয়ে আমরা তখন বাহির পানে। ভেঙেছি কত সরল বিশ্বাস।
নাগরিক যন্ত্রনায় মানুষ তখন ভুলতে বসেছিলো কল্পনার নানা রঙ। ভালবাসতে ভুলে গেয়েছিলো প্রকৃতির রুপ রস গন্ধ। তাই প্রকৃতি আজ বড় ক্ষুব্ধ, রুষ্ট। এক নিমিষে থামিয়ে দেয় সে গতিময় জীবন। ছিটকে পরে মানুষ। ছোট্ট জীবানু করোনার ভয়ে আজ সারা বিশ্ব ভীত। ওর প্রলয়ংকারী রাগ কে থামাবে কেউ জানেনা।
বিষন্ন পৃথিবী, আতংকিত পৃথিবী দেখে আর ভালো লাগেনা কবির। আলো ঝলমলে রোদ্দুর চায় সে। ভাবে সে, ক্ষমা চেয়ে সবুজ পোকার কাছে লিখতে হবে চিঠি।
লেখক- সাংবাদিক
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।