খামখেয়ালী সভার ধ্যানে-কর্মে রবীন্দ্র চর্চা
প্রকাশিত : ২২:৪৬, ১৯ জানুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ২১:২৮, ২৪ জানুয়ারি ২০১৮
বাঙালি জাতির মহত্তম মনীষা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কেন্দ্র করে সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার একটি মননধর্মী সংগঠন হচ্ছে খামখেয়ালী সভা। এ সভায় ধ্যানে ও কর্মে রয়েছে রবীন্দ্র চার্চা। নিজেদের সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের বুদ্ধিবৃত্তিক ও মানবিক চেতনা এবং তার অনিন্দ্য শিল্প ও সৌন্দর্যবোধের প্রসারে কাজ করছে খামখেয়ালী সভা।
সংগঠনটির সম্পর্কে খামখেয়ালী সভার সভাপতি মাহমুদ হাশিম বলেন, ১৮৯৭ সালে কলকাতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘খামখেয়ালী সভা’ নামে একটি আড্ডা শুরু করেছিলেন। সেই আড্ডায় যোগ দিতেন জগদীশচন্দ্র বসু, চিত্তরঞ্জন দাস, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ, প্রমথ চৌধুরী, শরৎচন্দ্রসহ অনেক গুণীজন। কিন্তু দুই বছর পরই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আড্ডাটি। ১১৫ বছর পর ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি কিছু তরুণ রবীন্দ্র-অনুরাগীর উদ্যোগে শুরু হয় ঢাকায় ‘খামখেয়ালী সভা’। বর্তমানে খামখেয়ালী সভার ৯টি কর্মসূচি রয়েছে বলেও জানান তিনি। কর্যক্রমগুলো হলো-
মাসিক রবীন্দ্র-আড্ডা
খামখেয়ালী সভার প্রথম ও অন্যতম প্রধান কর্মসূচি মাসিক রবীন্দ্র-আড্ডা। মাহমুদ হাশিম বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য ও কর্মের পূর্বনির্ধারিত কোনো বিষয়ের ওপর প্রবন্ধ পাঠ ও মুক্ত আলোচনা হলো এ আড্ডার মূলপর্ব। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন খামখেয়ালী সভার সভ্যরা, থাকেন আমন্ত্রিত আলোচকও।
রবীন্দ্র অধ্যয়ন সভা
নতুন সদস্যদের রবীন্দ্র সাহিত্যের সঙ্গে তাদের প্রাথমিক পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য ২০১৬ সাল থেকে রবীন্দ্র অধ্যয়নসভা নামে একটি নতুন কোর্স চালু করেছে খামখেয়ালী সভা। এই কোর্সটিতে রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বই পড়ানো হয়। এই কোর্সে উত্তীর্ণ হলেই কেবল খামখেয়ালী সভার স্থায়ী সদস্যপদ লাভ করা যায়।
বিশ্বসাহিত্য অধ্যয়ন সভা
এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, উত্তর আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার সাহিত্য নিয়ে লেকচার ভিত্তিক ক্লাস। মহাদেশ অনুসারে কোর্সটিকে ৬ পর্বে বিন্যস্ত করা হয়েছে। প্রতিটি পর্ব ৬ মাসের। আগ্রহীরা সবকটি বা পছন্দের যে কোনো একটি পর্বে যোগ দিতে পারবেন।
খালখেয়ালী আড্ডায়
বিভিন্ন অঙ্গনের গুণীজনদের নিয়ে প্রাণবন্ত এক আয়োজন হয় খামখেয়ালী আড্ডায়। মাহমুদ হাশিম বলেন, খামখেয়ালী সভার সদস্যরা এবং দেশ-বিদেশের আমন্ত্রিত অতিথিরা নিজেদের পছন্দের বিষয়ে ভাববিনিময়ের অবারিত বা সুযোগ পান অনন্দময় এ আড্ডায়।
আন্তর্জাতিক সেমিনার
প্রতিবছর বর্ষপূর্তিতে আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজন করছে খামখেয়ালী সভা। বাংলাদেশ ও ভারতের রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞরা যোগ দেন সেমিনারে।
বিদেশি রবীন্দ্র-গবেষকদের সহায়তা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে গবেষণায় বিদেশি গবেষকের সহায়তা দিচ্ছে খামখেয়ালী সভা। এ বিষয়ে সংগঠনটির সভাপতি মাহমুদ হাশিম বলেন, বর্তমানে চীনের পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্র-গবেষক ইয়াং ওয়েই মিংকে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক গবেষণা বৃত্তি
রবীন্দ্র সাহিত্যকে অগ্রাধিকার দিয়ে বাংলা ও বিশ্ব সাহিত্যের যে কোনো বিষয়ে গবেষণার জন্য ‘ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক গবেষণা বৃত্তি’ ঘোষণা করেছে খামখেয়ালী সভা। প্রতি বছর এক বা একাধিক গবেষককে দেওয়া হবে এ বৃত্তি।
রবীন্দ্রগুণী সম্মাননা
মাহমুদ হাশিম জানান, রবীন্দ্রসাহিত্য নিয়ে গবেষণা, চর্চা ও প্রসারে জীবনব্যাপী অবদানের জন্য ‘রবীন্দ্রগুণী’ সম্মাননা দিচ্ছে খামখেয়ালী সভা। ২০১৬ সালে প্রথম সম্মাননা দেওয়া হয় ভাষাসংগ্রামী ও রবীন্দ্রগবেষক আহমদ রফিককে। ২০১৭ সালে বরেণ্য রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও সাদি মহম্মদকে এ সম্মাননা দেওয়া হয়।
রবীন্দ্র লাইব্রেরি ও আর্কাইভ
২০১৫ সাল থেকে রবীন্দ্র লাইব্রেরি ও আর্কাইভের কার্যক্রম শুরু করেছে খামখেয়ালী সভা। রবীন্দ্রনাথের লেখা ও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা বেশ কিছু বই দিয়ে সাজানো হয়েছে লাইব্রেরিটি। দেশ-বিদেশের রবীন্দ্র-গবেষকরা এটি ব্যবহারের সুযোগ পাবেন। ভবিষ্যতে লাইব্রেরিটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে সংগঠনটির সভাপতি মাহমুদ হাশিম বলেন, ‘বাঙালির মহত্তম মনীষা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ঘিরে আমাদের এ আয়োজন। আনন্দ-বেদনা, সংকটে-সংগ্রামে রবীন্দ্রনাথ আজও আমাদের অনিঃশেষ প্রেরণার উৎস। খামখেয়ালী সভা মনে করে, বাঙালির সুন্দর ও পরিণত জাতি হয়ে ওঠবার পথে রবীন্দ্রনাথ অপরিহার্য। রবীন্দ্রনাথের শিখরস্পর্শী প্রতিভার সব দিক এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। খামখেয়ালী সভার মধ্য দিয়ে আমরা তাঁকে গভীরভাবে পাঠ ও নতুন নতুন রূপে আবিষ্কারের চেষ্টা করছি। কবি যে আনন্দলোক ও স্বপ্নলোক রেখে গেছেন তাঁর সাহিত্যকৃতির মধ্যে; তাঁর কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে যে পথ দেখিয়ে গেছেন, আমরা সে আলোর পথযাত্রী।’
খামখেয়ালী সভার ভবিষ্যৎ কর্মসূচি সম্পর্কে জানতে চাইলে মাহমুদ হাশিম জানান, ‘আমরা খামখেয়ালী সভার মাধ্যমে নতুন লেখক তৈরি করার পাশাপাশি এ সভাকে একটি গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠানে রূপ দেওয়া এবং নির্বাচিত বাংলা ও বিদেশি সাহিত্য পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভূক্ত করার কাজ করছি।’ এছাড়াও যারা খামখেয়ালী সভার আদলে সভা করতে চায় তাদের সম্ভাব্য সব সহযোগিতা দেওয়ার কথাও জানান তিনি।
আগামীতে ‘খাপছাড়া’ নামে ছোটদের আড্ডা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনাও রয়েছে বলে জানিয়েছেন খামখেয়ালী সভার সভাপতি মাহমুদ হাশিম।
খামখেয়ালীর সভা সম্পর্কে জানতে চাইলে পশ্চিমবঙ্গ বিশ্বভারতী শান্তিনিকেতন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক অভ্র বসু বলেন, রবীন্দ্রচর্চায় খামখেয়ালী সভা অসামান্য অবদান রাখছে। মাত্র ৪ বছরে বাংলাদেশ ছাড়া খামখেয়ালী সভা পশ্চিমবেঙ্গও পরিচিতি লাভ করেছে।
এম/টিকে