গণস্বাস্থ্যের কিট ও আব্রাহাম-এডিসনদের ডিমে তা দেয়া!
প্রকাশিত : ১৭:৩৫, ১৭ জুন ২০২০ | আপডেট: ১৮:৫৪, ১৭ জুন ২০২০
মানিক মুনতাসির
‘মুরগির ডিমে মানুষ তা দিলে বাচ্চা ফুটবে’ -নিজের এমন অকাট্য যুক্তি প্রমাণ করতে গিয়ে ফরাসী শিল্পী আব্রাহাম পোয়েশেভাল প্যারিসের একটি জাদুঘরের কাঁচের ঘরে বসে মুরগীর ডিমে তা দিচ্ছিলেন। ঘটনা ২০১৭ সালের। বিবিসি তখন রিপোর্টও করেছিল এ নিয়ে। ঘটনাটা গোটা ইউরোপে বেশ হৈচৈ ফেলে দেয়। 'শরীরের তাপমাত্রায় মুরগীর ডিম ফোটানো'র এই পরীক্ষাটি করে সবাইকে চমকে দিতে চেয়েছিলেন ফরাসী শিল্পী আব্রাহাম পোয়েশেভাল।
প্যারিসের 'দ্য প্যালাইস দে টোকিও' জাদুঘরের একটি কাঁচের ঘরে বসে কাজটি করেন তিনি। মি: পোয়েশেভাল মনে করেছেন, তা দেয়া শুরুর ২১ থেকে ২৬ দিনের মধ্যেই তার শরীরের নিচে রাখা ১০টি ডিম ফুটে মুরগীর ছানা বের হবে। সে সময় তাঁকে দেখতে আসা কৌতুহলী মানুষদের হাসতে হাসতে মি: পোয়েশেভাল বলেন, ‘ডিম ফোটার পর সম্ভবত আমি মুরগী হয়ে যাবো।’ তিনি সেখানে টানা দুই সপ্তাহ বসেও ছিলেন।
আরেকটা ঘটনা সবারই জানা আছে নিশ্চয়ই, আমেরিকার বিখ্যাত বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসনের কথা। তিনি বৈদ্যুতিক বাতি আবিস্কার করে গোটা বিশ্বকে আলোকিত করেন। কিশোর বয়সে একদিন তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। হঠাৎ তাঁকে পাওয়া গেল তিনি হাঁসের ঘরে বসে হাঁসের ডিমে তা দিচ্ছেন। তারও ধারণা ছিল, হাঁস-মুরগি ডিমে তা দিলে বাচ্চা হয়। তাহলে সে ডিমে মানুষ তা দিলে বাচ্চা হবে না কেন? তিনি অবশ্য সেটা প্রমাণ করতে ব্যর্থই হয়েছিলেন। খুব সম্ভবত ২৭ বা ২৯ দিনের মাথায়। কেননা ওই কাজটা হাঁসেরই বা মুরগিরই। মানুষের কাজটা ঠিক ও রকম নয়।
এবার আসুন গণস্বাস্থ্যের কিটের কথা বলা যাক। মহামারী রুপ নেয়া করোনা ভাইরাস চিহ্নিতকরণে র্যাপিড টেস্ট কিট আবিস্কার করে গণস্বাস্থ্য। সেটা মার্চের মাঝামাঝিতে। ওই কিট দিয়ে করোনা পজিটিভ শনাক্তও হন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী। এর আগেই শুরু হয় টানা-হেঁচড়া। কাঁচামাল আমদানির দ্রুত অনুমোদনও দেয়া হয়। কিন্তু কিট উৎপাদনের পর তার কার্যকারিতা যাচাই নিয়ে চলে আলোচনা-সমালোচনা। অবশেষে হস্তান্তর করা হয় সরকারের সংশ্লিষ্টদের কাছে। এতেই কেটে গেছে প্রায় তিন মাস। বলা হয়, ডব্লিউএইচও র্যাপিড টেস্ট কিটের অনুমোদন দেয়নি। ফলে এটার ব্যবহার হবে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। এরই মধ্যে আমেরিকার সিডিসি-এর কাছেও পরীক্ষার জন্য কিট হস্তান্তর করা হয়। যদিও ফলাফল এখনো জানা যায়নি।
ভালো কথা, তাহলে প্রথমেই তো বলা উচিত ছিল র্যাপিড কিট গ্রহণযোগ্য নয়। সোয়াবই একমাত্র ভরসা। অবশ্য সারাবিশ্বে এখন সোয়াব কিটই কার্যকর বলে বিবেচিত। তবে এটাও সত্য আমাদের ল্যাব এবং কিটের সংকটে পরীক্ষাও বিঘ্নিত হচ্ছে। কেননা আমাদের সীমাবদ্ধতাও আছে। এখনো প্রতিদিন আমরা সর্বোচ্চ ১৭ হাজার নমুনা পরীক্ষা করতে পারছি। আর সংক্রমণের হারে ইতিমধ্যেই আমরা চীনকে ছাড়িয়েছি। এটা অবশ্য একটা স্বপ্নই ছিল৷ কেননা উন্নত দেশ চীন, জার্মানি, ইতালিকে ছোঁয়ার স্বপ্ন তো আমরা প্রতিদিনই দেখতাম। যদিও সেটা ভিন্ন প্রেক্ষাপটের। অর্থাৎ উন্নয়নে এসব দেশকে ছাড়িয়ে যাবার দিবা-স্বপ্নে বিভোর থেকেছি।
অথচ ট্রাফিক সিগনালের রংটা পর্যন্ত এখনো চিনি না। চিনলেও তা মানি না। আবার সেই লাল, হলুদ আর সবুজ জোন নিয়ে মাতামাতি করছি। হয়তো সে জোনভিত্তিক লকডাউনেও যাবো কিন্তু তার আগে নিজেকে সতর্ক করা জরুরী বৈকি। ওহে বাঙালী, আগে তো নিজে বাচুন। ঘরে বাইরে থুথু ফেলা বন্ধ করুন। মাস্কটা থুতনিতে নয়, নাকে আর মুখে পরুন। প্রস্রাবের পর টয়লেটে ফ্লাশ না করলেও হাতটা ধৌত করুন। এখনো যারা একটা কনডমের ব্যবহার-বিধি শেখেনি। শিখলেও কনডমের খোসাটা পর্যন্ত নির্দিষ্ট স্থানে ফেলে না। সে জাতি আর যাই পারুক জন্ম নিয়ন্ত্রণ করতে হয়তো পারবে না। যার ফলে এত আধুনিক পদ্ধতি থাকা সত্ত্বেও এখনো পাপের ফসল নিস্পাপ নবজাতকের লাশ মেলে ডাস্টবিনে।
আর এই মহামারীতে পাড়া মহল্লার রাস্তার মোড়ের আড্ডাটাও থামানো যায় নি। করোনা রোগী জেনেও খোদ হাসপাতালে থামেনি যৌন হয়রানি। নিজ ঘরে এখনো পাওয়া যায় ধর্ষিত কিশোরীর অর্ধনগ্ন লাশ। আর লাল, সবুজ, হলুদ রঙা জোনভিত্তিক লকডাউন কতটা সফল হবে, তা হয়তো ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থার দিকে তাকালে খুব সহজেই অনুমেয়।
তিন মাস কেটেছে টেস্ট কিটের টেস্ট করতে। এরপর আমাদের স্বনামধন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা দিয়েছে, এই কিট কার্যকর নয়। এ তো সেই এডিসন আর আব্রাহামদের ডিমে তা দেয়ার মতই বৈকি। আরেকটা কথা না বললেই নয়- বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর গবেষকদের চরিত্র জানতে হলে ১৯৯৫ সালে আহমদ ছফার লেখা "গাভী বিত্তান্ত" উপন্যাসটি পড়তে পারেন। তাতে রেড জোনে বসবাসকারীদের সম্ভাব্য লকডাউনের সময়গুলো কেটে যাবে অতি আনন্দে। পাশাপাশি কোভিড-১৯ পজিটিভ হয়ে যারা সেলফ আইসোলেশনে আছেন তারা পড়তে হুমায়ুন আজাদের লেখা "আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম" বইটি। তাহলে বুঝতে পারবেন করোনাভাইরাস আসলেই কী শক্তিশালী, নাকি আমাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী!
লেখক- সাংবাদিক।
এনএস/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।