ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪

গণস্বাস্থ্যের কিট কাণ্ড

সাব্বির আহমেদ

প্রকাশিত : ১৩:৫০, ২৪ জুন ২০২০ | আপডেট: ১৩:৫৩, ২৪ জুন ২০২০

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে কর্মরত বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. বিজন কুমার শীল করোনা পরীক্ষার জন্য কিট আবিষ্কার করেছেন। তিনি এর আগেও এ রকমের কিট সিঙ্গাপুরে আবিষ্কার করেছিলেন যার পেটন্ট তার নামে রয়েছে। এ রকম খবর যখন মিডিয়ায় আসল তখন সারা দেশবাসীর বুক গর্বে ভরে গিয়েছিল। 

এই বিশ্ব মহামারি দমনে বাংলাদেশের একটা বিরাট ভূমিকা থাকবে এটাই ছিল জনসাধারণের প্রত্যাশা। সরকারও সাধারণের চিন্তার সঙ্গে একত্রিত হয়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে সর্বাত্মক সহায়তা দিয়েছিল কিট বানানোর জন্য কাঁচামাল এবং যন্ত্রপাতি আমদানি করার জন্য। সারাদুনিয়ার বিমান চলাচল বন্ধ থাকার সময় সরকার বিশেষ বিমানের মাধ্যমে ব্যবস্থা করেছিল চীন থেকে কিটের কাঁচামাল এবং যন্ত্রপাতি আনার। অতিদ্রুত সময়ের মধ্যে বিদ্যুৎ সংযোগসহ আরও অনেক সুবিধা করে দিয়েছিল এই কিট তৈরি করে বাজারে ছাড়ার ব্যবস্থা করার জন্য। এ পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। 

সরকারের বাড়িয়ে দেয়া সকল সুবিধা নিয়ে কিট বানানোর পর গণস্বাস্থ্য একটা অনুষ্ঠান করে তাদের প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। সে অনুষ্ঠানে সামাজিক দূরত্বের কারণ দেখিয়ে যোগ দেয়নি সরকারের লোকেরা। বাঁধল বিপত্তি। অনুষ্ঠান করার দরকার ছিল না। দরকার ছিল সরকারের কাছে কয়েক ধাপে কিট পরীক্ষা করার জন্য স্যাম্পল জমা দেয়ার। 

সঙ্গে সঙ্গে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সংবাদ সম্মেলন করে স্বাস্থ্য প্রশাসকদের বিরুদ্ধে ঘুষ চাওয়ার অভিযোগ তুললেন। বিপত্তি আরও ঘোরতর হল। কিটের আবিষ্কারক বিজন কুমার শীল গণমাধ্যমে বললেন, ‘প্রশাসকদের ঘুষ চাওয়ার কথা তিনি জানেন না। জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কান কাঁটা গেল। তবুও তিনি থামলেন না। পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া কিট বাজারজাত করার অনুমতি পাবার জন্য তিনি নানা বক্তব্য, বিবৃতি দিতে থাকলেন।’ 

স্বাস্থ্য প্রকাশকেরা পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করে দেশবাসীকে জানালেন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র সরকারের কাছে কিটের পরীক্ষা করার জন্য কোন স্যাম্পল জমা দেয়নি। স্যাম্পল না পেলে তারা কি করে এই কিট পরীক্ষা করবেন এবং অনুমতি দেবেন। তারা আরও জানালেন যে বিশ্বজুড়ে কোন দেশ এই কিটের মাধ্যমে করোনা পরীক্ষা করার অনুমতি দেয়নি। দুই/একটা দেশ প্রথমে অনুমতি দিয়ে আবার তা বাতিল করেছে। তাছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা র‍্যাপিড কিটের মাধ্যমে করোনা পরীক্ষার অনুমোদন দেয় না। প্রশাসকেরা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে বিধি মোতাবেক কিটের নমুনা জমা দেবার অনুরোধ জানালেন। 

ঘটনাবলী এখানেই শেষ হয়ে যাওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু জামায়াত, বিএনপি, বামাতী আর স্বঘোষিত সুশীলদের রাজনীতির কারণে ব্যাপারটা সে সময়ে শেষ হতে পারেনি। তারা পত্রিকায় বিভ্রান্তিকর সংবাদ ছাপলেন, কলাম লিখলেন, টেলিভিশন টকশোতে যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করলেন যে এটা সরকারের কারসাজি, জাফরুল্লাহ সাহেব সরকার বিরোধী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে সরকার তার প্রতিষ্ঠানের এমন যুগান্তকারী আবিষ্কারকে হেয় করার উদ্দেশ্যে এই কিট ব্যবহার করার অনুমতি দিচ্ছে না। 

তারা আরও বললেন, এই দুর্যোগেরকালে ধাপে ধাপে পরীক্ষা করার কি দরকার, এই টেস্ট কারো শরীরের ভেতর দেয়া হবে না। অতএব মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হবার কোন সুযোগ নেই, ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক যুক্তি তারা গণমাধ্যমে তুলে ধরলেন। গণমাধ্যম ব্যাপকভাবে তা প্রচার করল। সরকারের তুলে ধরা তথ্য এবং যুক্তি কেউ কানে তুলল না। জামায়াত-বিএনপি সমর্থকতো বটেই রাজনীতি থেকে দূরে থাকেন এমন মানুষেরাও সরকারের বিরুদ্ধে খেপে গেলেন। সকলে মিলে ফেসবুক ফাটালেন। দেশবাসীর মধ্যে সরকার বিরোধী একটা মনোভাব গড়ে উঠল।

করোনা ভাইরাস চীনে যখন ছড়ায় তখন থেকে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন খবরাখবর থেকে একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে জেনেছিলাম, করোনা একজন মানুষের শরীরে ঢুকেই রক্তের সঙ্গে মিশে যায় না, প্রথমে গলায় জড়ো হয়, তারপর বেশ কয়েকদিন ধরে শ্বাসযন্ত্রের মধ্যে গিয়ে বাসা বাঁধে, বংশবৃদ্ধি করে তারপর শ্বাসযন্ত্রের কোষের ভেতরে ঢুকে পড়ে। আর যখনি এ পর্যায়ে পৌঁছে তখনই তা রক্তের সংস্পর্শে আসে এবং রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত করা সম্ভব হয়। 

গণস্বাস্থ্যের এই র‍্যাপিড টেস্ট রক্ত পরীক্ষার উপর নির্ভরর্শীল। এ কথা জানার পর বুঝেছিলাম যে এই টেস্ট দিয়ে হবে না। কারণ এর মাধ্যমে যখন করোনা ধরা পড়ে তখন রোগীর অবস্থা অনেক কাহিল। রোগী সবল থাকতে থাকতে চিকিৎসা দিতে না পারলে জীবন বাঁচানো কঠিন।

প্রথম পর্যায়ে যেহেতু করোনা রক্তে যায় না, তাই এই টেস্টের মাধ্যমে করোনা শনাক্ত করে লাভ নেই। বেশিরভাগ মানুষ নিজের মাথাটা খাটাল না, বোঝার চেষ্টা করল না, বুঝল না। একটা অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করে এই দুর্যোগের সময়ে যখন সকলের ঐক্যবদ্ধ থাকা দরকার তখন মানুষের স্বাস্থ্য, জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে জনগণকে বিভক্ত করে দিল জামায়াত-বিএনপি-বামাতী-সুশীল চক্র। 

হুজুগে বাঙালি চিলে কান নিয়েছে শুনে চিলের পেছনে দৌঁড়াতে থাকে, নিজের কানে হাত দিয়ে দেখে না যে কানটা জায়গা মতো আছে কী-না। 

এ অনেক কালের পুরনো প্রবাদ। প্রবাদ এমনি এমনি তৈরি হয়নি। আমাদের চরিত্র এমন বলেই আমাদের সমাজে এমন প্রবাদ তৈরি হয়। এই করোনাকালেও পুরনো প্রবাদের পুনরাবৃত্তি দেখলাম। বেশিরভাগ মানুষ সমাজে সহজলভ্য সাধারণ জ্ঞানের সঙ্গে তুলনা না করে গণস্বাস্থ্য এণ্ড গংদের প্রপাগাণ্ডায় মাতোয়ারা হয়েছে। এ মাতোয়ারা জনগণ নিজের জ্ঞান-বুদ্ধি খাটালে মিথ্যার উপর ভিত্তি করা রাজনীতি বন্ধ হত। এ সমস্যা শুধু আমাদের দেশেই নয় রয়েছে সকল দেশেই। এমনকি ইউরোপ আমেরিকার মতো উন্নত দেশেও। 

এখানে যেমন সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে এ কথা মসজিদের মাইকে প্রচার করে দিয়ে শত মানুষের প্রাণ সংহার করা যায় তেমনি মিথ্যে কথা বলে, বাইবেল ছুঁয়ে ট্রাম্প মিয়াও জনগণের ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। ফেসবুক, টুইটার, ইউটুবের এখন সবচেয়ে বড় যুদ্ধ হচ্ছে মিথ্যা থেকে ব্যবহারকারীদের সুরক্ষা দেয়া। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় মিথ্যা প্রচার বিরাট অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান সময়ের উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে মিথ্যা প্রচার সমস্যা অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। 

২৩ জুন দ্যা ডেইলি স্টারের রিপোর্ট অনুসারে, বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় যে রিপোর্ট দিয়েছে তাতে বলা হয়েছে করোনা আক্রান্ত হওয়ার ১–৭ দিনের মধ্যে পরীক্ষা করলে গণস্বাস্থ্যের কিট মাত্র ১১ শতাংশ সফলভাবে শনাক্ত করতে পারে। তবে এই কিট এন্টিবডি টেস্টের ক্ষেত্রে কিছুটা বেশি সফল। আক্রান্তের ৮ –১৪ দিনের মধ্যে পরীক্ষা করা হলে এই কিট ৪১ শতাংশ এন্টিবডি শনাক্ত করতে পারে, ৫৯ শতাংশ ক্ষেত্রে পারে না। সুস্থ হওয়ার ১৪ দিনের পর টেস্ট করা হলে গণস্বাস্থ্যের কিট ৭৬ শতাংশ সঠিকভাবে এন্টিবডি শনাক্ত করতে পারে, ২৪ শতাংশ ক্ষেত্রে পারে না। একই রিপোর্টে ডেইলি স্টার এ কথাও লিখেছে যে, গণস্বাস্থ্যের কিটের তুলনায় বিদেশ থেকে আমদানি করা র‍্যাপিড টেস্ট কিট অনেক বেশি সাফল্যের সঙ্গে করোনা এন্টিবডি শনাক্ত করতে পারে। 

গণস্বাস্থ্যের কিট শেষ পর্যন্ত ১১ শতাংশ টেস্ট সঠিকভাবে করতে পারে বলে প্রমাণিত হয়েছে। এন্টিবডি শনাক্তের ক্ষেত্রে এই কিট কিছুটা কার্যকর বলে সরকার করোনা শনাক্ত নয়, এন্টিবডি শনাক্ত করার জন্য তাদের উদ্ভাবিত কিটকে অনুমতি দিচ্ছে। যে টেস্ট মাত্র ১১ শতাংশ সফল আর ৮৯ শতাংশই ভুল তথ্য দেয় সে টেস্ট দিয়ে কি করবেন? গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র কি এই কিটের কার্যকারিতা সম্পর্কে জানতো না? তা কি হয়? নিজেদের বানানো জিনিষের কার্যকারিতা সম্পর্কে কে না জানে? তবে কেন তারা এই কিট তড়িঘড়ি করে বাজারে ছাড়তে চেয়েছিল? বিষয়গুলো গভীরভাবে ভেবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে।

সরকার যদি তাদের কথামত কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া গণস্বাস্থ্যের র‍্যাপিড কিট বাজারজাত করার অনুমতি দিত তবে তা দিয়ে পরীক্ষা করে ৮৯ শতাংশ আক্রান্ত মানুষ জানত যে তিনি করোনায় আক্রান্ত হননি। বুঝুন ব্যাপারটা তাহলে কি দাঁড়াত। তারা সাধারণ জ্বর-কাশিতে আক্রান্ত হয়েছেন মনে করে স্বাভাবিকভাবে ঘুরে বেড়াত। অন্যদের মধ্যে দেধারসে করোনা ছড়িয়ে চলত। 

যখন করোনা লক্ষণগুলো প্রকট হয়ে উঠত তখন আবার পিসিআর টেস্ট করে দেখত যে তিনি আসলে করোনায় আক্রান্ত। তখন চিকিৎসার সুযোগ একেবারে কমে আসত। হয়রানি, পয়সা খরচ, করোনা ছড়ান এবং জীবনহানী হত অনেক বেশি। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এবং তার রাজনৈতিক সঙ্গীসাথীরা জেনেশুনে শুধু পয়সা কামানোর জন্য এবং সরকারকে রাজনৈতিক চাপে ফেলার উদ্দেশ্যে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য এবং জীবন নিয়ে এমন হীন চক্রান্ত করেছিলেন –এমন কথা কারো ভাবনায় আসলে তাকে অমূলক বলা যাবে না। 

যে কিট মানুষের রক্ত পরীক্ষা করে ৭৬ শতাংশ ক্ষেত্রে সঠিকভাবে এন্টিবডি নির্ণয় করতে পারে সে কিটকে বাজারজাত করার অনুমতি কিভাবে সরকার দেয় বুঝতে পারছি না। স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এমন নিয়ম আছে কী-না জানা নেই। সরকার যেহেতু অনুমতি দিচ্ছে তা থেকে ধরে নিচ্ছি যে স্বাস্থ্য বিজ্ঞানে এমন অনুমতি দেবার বিধান আছে। তবে এই লেখক ব্যক্তিগতভাবে প্রয়োজন হলেও এই কিটের সাহায্যে এন্টিবডি পরীক্ষা করাবে না। 

যেখানে ২৪ শতাংশ ভুল হবার সম্ভাবনা থাকে সে বিষয়ে পরীক্ষা করা আর না করা একই কথা। নিজের বা পরিজনের ক্ষেত্রে পরীক্ষার ফলাফল সঠিক হলেও মনের মধ্যে খচখচ করবে। এই খচখচ নিয়ে টেস্টের ফলাফল বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে না। নিশ্চিত না হতে পারলে পরীক্ষা করে লাভ কি? এন্টিবডি টেস্টের ফলাফলের উপর প্লাজমা থেরাপি নির্ভর করছে। পরীক্ষার ফলে নিশ্চিত হতে না পারলে প্লাজমা থেরাপি দেয়া যাবে কি করে? 

স্বাস্থ্য, জীবন স্পর্শকাতর বিষয়। ভুল চিকিৎসায় স্বাস্থ্য একবার ক্ষতি হলে হারানো সুস্বাস্থ্য ফিরে পাওয়া যায় না। ডাক্তারদের অবহেলার কারণে হরহামেশাই এখানে ভুল চিকিৎসা হচ্ছে। সারাজীবন ভুল চিকিৎসার খেসারত দিতে হয়। ভুল চিকিৎসায় মানুষের মৃত্যুও হয়। এরকম উদাহরণ ভুরিভুরি। ভুল চিকিৎসার দায় নেয় না হাসপাতাল বা চিকিৎসক। জীবন একবার গেলে আর ফিরে আসে না। 

আর যা-ই হোক না কেন, মানুষের জীবন নিয়ে, মহামারি নিয়ে দুর্নীতি, রাজনীতি মেনে নেয়া যায় না। এই করোনাকালে মানুষের অমূল্য জীবন নিয়ে দুর্নীতি, রাজনীতি অনেক হয়েছে, আর না। সাধারণ মানুষ নিজের মাথাটা খাটাক, মিথ্যা প্রচার থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখুক! তাতে অসৎ রাজনীতিকদের কার্যকারিতা কমে যাবে। রাজনীতিকদের বোধোদয় হোক! লকডাউন করাকড়ি করে করোনা দূর করা হোক। সাধারণ মানুষ স্বস্তি পাক।

 

লেখকঃ চার্টার্ড একাউন্টেন্ট (এফসিএ) এবং লিড কনসালট্যান্ট ও চেয়ারম্যান, ঢাকা কনসাল্টিং লিমিটেড।

এমবি//


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি