ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪

পর্ব-১

গোয়েন্দাদের স্বর্ণ উদ্ধার কাহিনি

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৯:৩৩, ২৭ জানুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ১৯:৩৪, ২৭ জানুয়ারি ২০১৮

ড. মইনুল খান। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। সোনা চোরাচালানকারীদের কাছে মূর্তিমান এক আতঙ্কের নাম। জল, স্থল ও আকাশ পথে সোনা চোরাচালান রোধে অভিযান চালিয়ে বেশ আলোচিত তিনি। সোনা চোরাচালানের অভিযানের পেছনের তেমন একটি কাহিনী তুলে ধরেছেন এই লেখায়।

*ছেড়ে দিলাম ।

*স্যার, সত্যিই বলছেন?

*তোমার সাথে মশকরা করছি?

*স্যার আপনারা অনেক ভালো। আপনাদের মতো কেউ এমন ভালো বিহেভ করে নাই।

*মানে কী?

*স্যার আরেকবার ধরা খাইছিলাম। কিছু পায় নাই। মাইরও দিছে। অনেকদিন ভুগছি। আপনারা মাইর দেন নাই। মনে করছিলাম এবারো মাইর খাইতে হইবো।

সাদেকের সাথে কথা। শরীফকে সন্দেহে ধরেছে। নিশ্চিত নয়। সোর্স বলছে কিছু আছে। পাওয়া যাচ্ছে না। দেহ তল্লাশি। ৩৬০ ডিগ্রি। তল্লাশির কোড। এটি সর্বোচ্চ। বাহির-ভেতর, উপর-নিচ। লজ্জা স্থান। কোন কিছু বাকি নেই। প্রথমে মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে। পরে খালি হাতে। হাত অনেক সময় বেশি কার্যকর। মেটাল ডিটেক্টর ফেইল করে। হাত ফেইল করে না। মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে এখনো বড় কিছু ডিটেক্ট হয়নি। যা হয়েছে হাতে। চোরাচালানকারী জানে মেশিনের ক্যাপাসিট্ সেভাবেই প্রস্তুতি আর্ট। দীর্ঘদিন পর্যবেক্ষণ করে। চর্চা । এরপর মাঠে। দীর্ঘদিন চলে। ধরা পড়লে অন্য পথে। নতুন পদ্ধতি। কৌশল। প্রশিক্ষণ। লেনদেন। নতুন লোক। শরীফ আহমেদ বলছে।

*এতো কিছু তুমি কীভাবে জানো?

*স্যার আমার বন্ধু এই কাজ করতো। আমি ওর কাছে জানছি।

*ওর নাম কী? কোথায় থাকে?

*স্যার এখন মালেশিয়ায়। আগে ঢাকায় ছিলো। তিন মাস হয় মালয়েশিয়ায় গেছে।

*নাম কী?

*কমল  

নামটি লুকাতে চাচ্ছে শরীফ। সাবলীল। জড়তা নেই। তবুও সন্দেহ। কোথাও একটা গরমিল। সাদেক হোসেন নাছোড়। আড়াই ঘন্টা হলো। রাত তিনটা। সাড়ে বারোটায় ধরা হয়েছে। অনেক জিজ্ঞাসাবাদ। কিছু বের হচ্ছে না। ব্যাগে কিছু নেই। শরীরেও না।

কারোর কাছে হস্তান্তর হয়েছে?

তা হবে কেন?

বোর্ডিং বেল্ট থেকে নজরদারি যাত্রীর লাগেজ বেল্টে। গোয়েন্দারা বেল্টে অপেক্ষা করছে । ওয়াকিটকিতে কল,

*স্যার, টার্গেটকে খুজেঁ পাচ্ছি না। কোথায় গেলো?

* টার্গেট সাড়ে ১২ টায় ইমিগ্রেশনের লাইন ছিলো। কোথায় যাবো? টয়লেট দেখো।

*স্যার দেখছি। টয়লেট নেই। টয়লেট খালি। সবগুলো দরজা ফাঁকা। কেউ নেই।

* দ্রুত বাইরে চলে যাও।

শরীফ দ্রুত ইমিগ্রেশনের থেকে কাস্টমস হল পার হতে যাচ্ছে। স্ক্যানিং মেশিন হ্যান্ড লাগেজ চেকিং। কিছু নেই। যেতে দেওয়া হলো গ্রিন চ্যানেল। বেল্টে না পেয়ে দ্রুত বিধান রায় চলে গেছে সিসিটিভি ক্যামেরায়। মনিটরে দেখে নিলো। সময় দিয়ে রিউইন্ড করে নিলো। হলুদ গেঞ্জি। চিনতে সহজ হলো। মনিটরে দেখা যাচ্ছে। এখন গ্রিন চ্যানেল। বিধান যাওয়ার আগেই থামলো ইমামের ইশারায়। গোয়ান্দা ইমাম দাঁড়িয়ে ওয়াচ করছে। ব্রিফিং পেয়েছিলো প্রি-শিফটিং আলোচনায়। বিধান চলে গেলো প্লেনের দরজায়। বোর্ডিং ব্রিজ স্পেস নেই। দূরের বে-তে পার্ক করেছে মালিন্দো এয়ারলাইন্স। ফ্লাইট অডি ১৬২। মালেয়েশিয়া থেকে এসছে। রাত ১২টা ১০ মিনিটে। বাস দিয়ে টার্মিনাল ভবনে এসছে। বাসে চড়েছে বিধান। অনুসরণ করে নিয়ে এসেছে ইমিগ্রেশন হলে। ভিড় কম। আরো তিনটা ফ্লাইটও অবতরণ করেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ভিড় বেড়ে গেলো। একসাথে তিনটি ফ্লাইট। সামাল দেওয়া হিমশিম কাস্টমস কর্মকর্তাদের। এরমধ্যে গোয়ান্দাগিরি। এতো যাত্রী। ২০০ করে ৬০০ যাত্রী। তিনটি ফ্লাইট সমান স্পর্শকাতর। পাঁচজন কর্মকর্তা, দুজন সহযোগীসহ সতজনের টিম। একজন ছুটিতে। অল্প জনবলে বিশাল এয়ারপোর্টের নজরদারির দায়িত্ব। ‘এ’ শিফট চলছে। রাত ৯ টা থেকে সকাল ৯টা। টানা ১২ ঘণ্টার শিফট। ফ্লাইট সর্বদা থাকে না। রাতে বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ পায়।

সাদেক সহকারী পরিচালক। বিধান ও রবিউল গোয়েন্দা কর্মকর্তা। টর্গেটকে নজরদারি দায়িত্ব। সাথে সিপাই ইমাম ও নাসির। বিধানের অনুমান হলুদ গেঞ্জির যুবকই শরীফ। নজরে নিয়ে এসেছে কাস্টমস হলে। টের পায়নি শরীফ। বয়স ৩০ থেকে ৩২ এর মধ্যে। পাশে বসেছিলো বাসে। টেলিফোনে কল শরীফের।

হ্যালো, মামা আমি নামলাম।

ফোনটি ওপার থেকে এসেছে। ছোট করে কথা। আমি গেঞ্জি পরা, হলুদ গেঞ্জি। জিন্স পরা, সাথে কেডস। ইন করা আছি। সাথে কালো কম্পিউটার ব্যাগ। বিধান শুনছে। টের পাচ্ছে না শরীফ। যাত্রী ভেবে আনন্দে কথা বলছে। নিরাপদে বের হবার কথা বলছে। দূরে আরেকজন। হলুদ গেঞ্জি। তবে বয়স ৫০ –এর মতো। বয়স সম্পর্কে গোয়েন্দার আগাম তথ্য ফোনে। এসএমএস মিলালো। হলুদ গেঞ্জি। বয়স৩০ থেকে৩২। বাড়ি কুমিল্লার বুড়িচং। তথ্য এইটুকু। ৬০০ যাত্রী। এর ভেতর বের করতে হবে। অন্য গোয়েন্দারা বাকি দুই ফ্লাইটের দায়িত্বে। বিধান দুজনকে সন্দেহের মধ্যে রেখেছে। একজন হবে ঐ লোক।

*আমার নাম ইমাম। শুল্ক গোয়েন্দা। এই আমার কার্ড। আমি এখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত। আপনি কোথা থেকে এসেছেন প্লিজ?

* মলয়েশিয়া থেকে।

* আপনার চেকড ইন ব্যাগ কোথায়?

* নেই। হ্যান্ড ব্যাগ সাথে আছ।

* কয়দিন পর আসছেন?

* তিনমাস।

* কী করেন?

* ব্যবসা।

* ছোট ব্যাগ কেন? আর লাগেজ নেই?

* না স্যার।

* হাতে খাবার কেন?

* বিমানের ভেতর দিছে। খাই নাই। বাইরে গিয়ে খামু।

* আপনার পাসপোর্টটি দেখতে পারি?

* কেন দেখবেন। ইমিগ্রেশন পুলিশতো দেখছে। আপনি দেখবেন কেন? আপনি জানেন কার সাথে কথা বলেছেন। আপনাকে দেখে নিবো। আপনার নাম কী? পদ কী? কোথায় পোস্টিং? আপনার বসের নাম কী? এরকম অনেক হুমকিমূলক প্রশ্ন।

* আমি আমার দায়িত্ব পালন করছি কেবল। পাসপোর্ট দিতে বলছি, দিয়ে দেন। চেক করবো।

* দেখবেন কাকে কল করবো? আপনি দৌঁড়ে পালাবেন।

* আপনার নাম কী? বাড়ি কোথায়?

* ওমর। বাড়ি ‍বুড়িচং।

*পাসপোর্ট দেখি।

ইমাম পাসপোর্ট দেখলেন। পাতা উল্টালেন। যাত্রী বলেছেন তিনমাস পর এসেছেন। পাসপোর্টের সিল বলছে, দুদিন আগে গেছেন। এখানে কথার অমিল। নাম বললেন, ওমর। পাসপোর্টে আছে শরীফ আহমেদ। বয়স ৩১। বড়ি বুড়িচং, কুমিল্লা। বাড়ির তথ্য সত্যি বলেছে। বাড়ির জবাব পাওয়ায় ইমামের সন্দেহ হয়। টার্গেটের বাড়িও ঐ এলাকায়। বয়স, গেঞ্জির রঙ মিলে যাচ্ছে। বিধান সিসিটিভি মনিটরে দেখছে, হলুদ গেঞ্জি গ্রিন চ্যানেলে দাড়িঁয়ে। কথা বলছে ইমামের সাথে। আশ্বস্ত হলো। বাইরে বের হতে পারেনি। হলেও গোয়েন্দা রবিউলের ব্যারিকেড। বাইরে অপেক্ষা করছে হলুদ গেঞ্জির। বের হবার পথ একটা। সবাইকে চেক করার দরকার নেই। সন্দেহভাজনকে আটকানো প্রথম কাজ। ৬০০ থেকে ৬ জনের বেশি হবে না। সদর দপ্তর থেকে কড়া নির্দেশ। বিকেলে সবাইকে ডেকে আনা হয়েছিলো। এটা আটকাতে হবে। তথ্য দিলাম। কিছু ইঞ্জিত। তবে আর বেশি তথ্য পাওয়া গেলো না। এখান থেকে বের করা ‘এ’ শিফটের জন্য চ্যালেঞ্জ। এখানে গোয়েন্দাদের সফলতা। কম হস্তক্ষেপে বেশি প্রাপ্তি। কাজ কম, ফল বেশি। একজনকে ধরতে গিয়ে সবাইকে কষ্ট দেওয়া যাবে না। গোয়েন্দা তথ্য যাচাই করে নিতে হবে। বড় ক্ষেত্র থেকে জাল ছোট করে আনতে হবে। সন্দেহ সীমিত করে আনতে হবে। মানদণ্ড প্রয়োগ করতে হবে। সদরের স্থায়ী আদেশ। মনে করিয়ে দেওয়া হলো। বিধান যোগ দিলো ইমামের সাথে। একই প্রশ্ন। এবার ভিন্ন উত্তর। পাসপোর্টের সাথে মিল নেই। এলোমেলো। হুমকি একই। দেখে নেবো। এখনই লোক আসবে। চাকরি থাকবে না। বদলিতো হবেই। বসের নাম কী? পদ কী? কোথায় থাকে?

বিধান চুপ। ইমামও। প্রতিক্রিয়া দেখালো না। হাঁকডাকে অভ্যস্ত। ভয় পেলো না। আরো সন্দেহ হলো। এতো রাগ দেখাবে কেন? দুর্বলতা না থাকলে স্বাভাবিক থাকবে। রাগ হওয়ার কারণ নেই। দায়িত্ব পালন করছে গোয়েন্দারা। পরিচয় দিয়ে জিজ্ঞাসা করছে। স্বাভাবিকভাবে নেওয়াটা স্বাভাবিক। ভয় দেখাতে হবে কেন? শেষের প্রশ্নটি কিসের ইঙ্গিত? বিধান বলছে, আমি জানি আপনি বড় মাপের লোক। আপনার আত্মীয় হবে কেন? শেষের প্রশ্নটি কিসের ইঙ্গিত? বিধান বলছে, আমি জানি আপনি বড় মাপের লোক। আপনার আত্মীয় বড় কর্তা। আমরা আপনাকে সম্মান দেখাতে চাই। ভেতরে চলেন। আমাদের স্যারের সাথে সৌজন্য কথা বলেন। এক কাপ চা খাবেন। আপনার পাসপোর্ট ফিরিয়ে দেওয়া হবে। আপনি আমাদের কাছে সম্মানীয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক। মাঝে শরীফ। পেছনে ইমাম। বিধান নিয়ে যাচ্ছে। শিফট ইনচার্জ সহকারী পরিচালক সাদেক অপেক্ষা করছে রুমে। ওয়াকিটকিতে জানিয়েছে শরীফের কথা। সবকিছু জানছে। ক্যামেরায় দেখছে শরীফের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ। বুঝছে, শরীফ বেশি প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। আরো নিশ্চিত হচ্ছে। এটি দেখার জন্য অপেক্ষা করছিলো।

সাদেক চৌকশ। ৩০তম ব্যাচের বিসিএস কর্মকর্তা। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। মৃদুভাষী। তীক্ষ্ন আইকিউ। কমান্ডের প্রতি অকাট্য অনুগত্য। গোয়েন্দা কৌশলে আছে বিশেষ আগ্রহ। বগি ল্যাঙ্গুয়েজ আকর্ষনীয়। কণ্ঠ ভারী। চার বছর হলো চাকরী। বিদেশ প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়েছে। আরো আত্মবিশ্বাসী। বিকাল সাড়ে ৫টায় কাকরাইলের সদর দপ্তরে ডেকে আনা হলো। সাথে শিফটের সকলকে। মিনি করফারেন্স হলে ব্রিফিং। এনিমিশন করে দেখানো হলো। কোথা থেকে আসবে? কী আসবে? শনাক্তের পদ্ধতি? পরিচয়? এরপর কীভাবে কাজটি সম্পন্ন করতে হবে? সকলে বুঝে নিলো। তবে সুনির্দিষ্টভাবে আর তথ্য নেই। বিধান আরো কিছু জানতে চাইলো। বললাম, এখনি পেয়েছি। টার্গেট প্লেনে উঠেনি। আরো পাওয়ার চেষ্ঠা চলছে। নেটওয়ার্ককে অনুরোধ পাঠানো হয়েছে। সময় আছে। প্লিজ কিপ ইট কনফিডেনশিয়াল। ডিভাইস অন রাখতে বললাম। কাকরাইল থেকে সরাসরি শিফটের সদস্যরা এয়ারপোর্ট হাজির। একঘণ্টা আগে থেকে পৌঁছে গেছে আজ। রাত ৮ থেকে ডিউটি করছে ‘এ’ শিফট।

* হাই মি. শরীফ আহমেদ, হাউ আর ইউ? প্লিজ সিট ডাউন।

* আপনি কেন আমাকে ডাকলেন?

* আমি দুটো কথা বলবো। একসাথে চা খাবো।

* আমি চা খাবো না। আপনি জানেন আমার আত্মীয়……

* আপনি কি করেন?

* ব্যবসা। প্রতিবছর ট্যাক্স দেই। আমি একজন সম্মানিত করদাতা।

* গত একবছরে আপনি দশবার বিদেশ গেছেন। এবার ‍আপনি দুদিন আগে গেছেন। কতটাকা খরচ হয়েছে?

* এবার ৮০ হাজার টাকা।

* আপনি কীসের ব্যবসা করেন বললেন নাতো?

* ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। আয় হয় মাসে ৩০ হাজার টাকা।

* বিদেশ যাবার এতো টাকা কোথায় পেলেন? ট্যাক্স কত টাকা দিয়েছেন?

* আপনার জানতে হবে কেন?

* আপনি চা খাচ্ছেন না কেন? পানি খান। সাথে বিস্কুট। পানিটা বোতলের। খেতে পারেন।

*এখন খাবো না।

* আপনার হাতে প্লেনের খাবার কেন? প্লেনে খাননি? নিশ্চিয় ক্ষেদে পেয়েছে? প্লিজ খান।

*পেটে খিদে নেই।

*আপনার চোখে দাগ কেন? দুই চোখে কালো দাগ পড়েছে কেন?

*দু’দিন ঘুমাইনি। এজন্য হয়তো।

 

(বাকি অংশ পড়ুন দ্বিতীয় পর্বে)

টিকে


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি