চলমান চক্রান্ত, সীমাহীন নিষ্ঠুরতা
প্রকাশিত : ১৮:০৩, ২১ আগস্ট ২০১৯ | আপডেট: ২১:০৪, ২১ আগস্ট ২০১৯
২১শে আগস্টের কিছু ছবি হৃদয়ে গেঁথে আছে এক ভয়াবহ স্মৃতি হিসেবে। আহত আইভী রহমানের চোখের সেই শূন্য দৃষ্টি, রাস্তায় পরে থাকা আহত–নিহত মানুষের গায়ের ছোপ ছোপ রক্ত, বঙ্গবন্ধু কন্যার সেই কান্নাজড়িত মুখ, রাজপথে লাশের পাশে ফেলে যাওয়া ছেঁড়া স্যান্ডেল, টুকরো টুকরো মর্মান্তিক কত ছবি। আমরা যারা শুধু ছবি হিসেবে দেখেছি, তাদের কাছেই এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের নাম ২১শে আগস্ট। যারা এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগী তাদের মানসিক নির্যাতন পরিমানে অনুধাবন করা অসম্ভব। কোন যুদ্ধাবস্থা নয়, একটি সন্ত্রাস বিরোধী শান্তিপূর্ণ সমাবেশে এ হেন আক্রমণ কোন সভ্য সমাজে ঘটতে পারে তা চিন্তার অতীত। কিন্তু সেটাই এ দেশের মাটিতে ঘটেছে এবং তা ঘটেছে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহলের যোগসাজশে। ভাবা যায়? শুধু তাই নয়, ঘটনাকে ধামাচাপা দেবার যে ঘৃণ্য প্রচেষ্টা, তা এখনও বিস্ময়ের উদ্রেক করে।
২১শে আগস্টে বঙ্গবন্ধু কন্যাকে হত্যা চেষ্টা, ১৫ই আগস্টে জাতির পিতার সপরিবারে হত্যা অথবা '৭১-এর বুদ্ধিজীবি হত্যাকাণ্ড এগুলো কোনটাই বিচ্ছিন্ন ঘটনাপঞ্জি নয়। এরা একই সূতায় বাঁধা একই গোষ্ঠীর দ্বারা সংঘটিত এক বৃহত্তর চক্রান্তের অংশ। সেই চক্রান্ত এখনও চলমান এবং আমরা যদি দেশবিরোধী এ চক্রকে সমূলে উৎপাটিত করতে না পারি তবে নিশ্চিত ভাবেই আমরা নিজেদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উপর একই নিষ্ঠুরতার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা রেখে যাবো। বিশেষত বঙ্গবন্ধুর রক্তের ধারা যেখানে যতটুকু আছে তাদের প্রত্যেকের জন্য সার্বক্ষণিক এক হুমকি রেখে যাবো বলে মনে করি।
তাই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে, এই শত্রুদের পরিচয় উদ্ঘাটন করা প্রয়োজন। শুধুমাত্র যারা দৃশ্যমান তাদের কথা বলছি না। বরং,পর্দার অন্তরালে যে পরিকল্পকরা রয়ে যায় তাদের পরিচয় স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হওয়া প্রয়োজন। না হলে নতুন প্রজন্ম তাদের চিনতে পারবে না। ’৭১, ’৭৫ অথবা ২০০৪ সব ঘটনার পিছনের দেশী-বিদেশী চক্রান্তের যে হিসাব চলুন পড়াই আমাদের সন্তানদের। যুক্তি দিয়ে,প্রমাণ দিয়ে তাদের জানাই কারা তাদের পিতৃহন্তারক, কারা তাদের নিজেদের ভবিষ্যতের ভীত নষ্ট করে দিতে সতত সচেষ্ট। না হলে, ভুল ক্রমে তারা সমর্থন দিয়ে বসবে পিতার হত্যাকারীদের। জানবে না কত বড় দেশবিরোধী চক্রান্তের অংশ হয়ে উঠছে তারা। এমন বিভ্রান্ত প্রজন্ম আমরা তো দেখেছি আগে, এমন ভুল পথে হেঁটে যাওয়া তরুণদের এক অংশ আজও চক্রান্তের দাবার গুঁটি হয়ে ভ্রাতৃঘাতী খুনী হয়ে উঠছে।
শত্রুদের মুখোশ উন্মোচন করার জন্য এবং দেশী-বিদেশী চক্রকে স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করার জন্য কমিশন গঠনের প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। পুলিশের তদন্ত বা আদালতের আইনের মার প্যাঁচের প্রমাণ নয়, শুধু সরাসরি জড়িত চেনা কিছু নাম নয়, কমিশন চিহ্নিত করবে সবাইকে। প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য শত্রু, তাদের উদ্দেশ্য, তাদের পিছনের দেশী-বিদেশী চক্র, তাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, আন্তর্জাতিক শক্তির উৎস, সব উদ্ঘাটন করতে হবে এই কমিশনের মধ্যে দিয়ে।
আইভী রহমানের অভিব্যাক্তিহীন শেষ দৃষ্টি, শেখ রাসেলের মর্মান্তিক শেষ সময়, নাম না জানা লাখো শহীদের শহীদান, বীরঙ্গনাদের বিস্মৃত অশ্রুজল অথবা বঙ্গবন্ধুর রক্তাক্ত তর্জনী, যুগে যুগে সঞ্চিত আমাদের রক্তের ঋণ। যে আদর্শের পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরার জন্য তাদের আত্মত্যাগ তা জানতে হবে। শুধু কথার কথা নয়, শুধু ফাঁকা শ্লোগান নয় পড়তে হবে, বুঝতে হবে, আত্মস্থ করতে হবে আদর্শের ব্যাখ্যা। জানতে হবে ইতিহাস ও সংস্কৃতি এবং একই সাথে জানতে হবে, চিহ্নিত করতে হবে শত্রুদের, জানতে হবে তাদের অপরাজনীতিটা কি, চিনতে হবে তাদের সহযোগীদের, বুঝতে পারতে হবে বহির্বিশ্বের ভূ –রাজনৈতিক চক্রান্ত।
বাংলাদেশ ও আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তার জন্য আজ আমাদের দৃঢ় হতে হবে, স্পষ্ট করতে হবে 'দেশ বিরোধী' বলতে কাকে বোঝাচ্ছি। তারপর কোন অনুকম্পা না দেখিয়ে সেই অপশক্তিকে ও তাদের রাজনীতিকে সমূলে উৎপাটিত করতে হবে। এটাই এখন সময়ের দাবী।
ভয় হয়, হয়তো এখন বেশ দেরী হয়ে গেছে। সাদা-কালো মিশে গিয়ে সব ধূসর হয়ে যাচ্ছে। আমাদের দুর্ভাগ্য, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসই এমন যে, ঘরের ভিতর থেকেই বের হয়েছে বিভীষণ। বের হয়েছে পিতার হত্যাকারী, ভাইয়ের হত্যাকারী। পরিয়ে দিয়েছে আমাদের কপালে কলঙ্কের তিলক। এই জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর পরিচয়ের সূত্র ধরে তারা পার পেয়ে যাচ্ছে বারংবার। শুধু তাই নয় পুনর্বাসিত হয়ে আজ আমাদের দলে,ঘরে প্রবেশ করেছে। এই অনুপ্রবেশ তারা আদর্শিক পরিবর্তনের কারণে করছে না, করছে সুবিধাবাদীতার জন্য। বরং ভয় হয়, তারা ঢুকিয়ে দিতে সচেষ্ট হচ্ছে আমাদের মনোজগতে তাদের অপরাজনীতি। তাই এখন প্রায়শই নিজেদের মানুষদের কথা শুনলে বুঝি না কারা কথা বলেছে, বন্ধু না শত্রু?
আর অনুকম্পা নয়, আর স্বজনপ্রীতি নয়। এখন শেষ সময় এই জঞ্জাল পরিষ্কার করার। সাহসের সাথে, আপোষহীনভাবে, দৃঢ় হস্তে এবার ঘর পরিষ্কারে হাত দেয়া এখন অতীব জরুরী। এই সুসময়ে করবো না তো আর করবো কবে? ঘর পরিষ্কারে আমাদের কিসের ভয়? কিসের দ্বিধা? মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশবিরোধীরা রঙ পালটালেও তাদের বিষ নিষ্ক্রিয় হয় নাই। বিজয় উল্লাস ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু পরাজয়ের গ্লানি চিরস্থায়ী। আর সেই পরাজয়ের প্রতিশোধের স্পৃহাও হয় তীব্র। আমরা হয়তো এদের নিষ্ঠুরতার প্রকৃত স্বরূপ বিস্মৃত হয়েছি। অথবা আমরা ভুলে না গেলেও হয়তো অসাবধান হয়ে গেছি। কিন্তু ওরা পরাজয়ের গ্লানি ভুলে নাই। আমাদের মনে রাখতে হবে ’৭১, '৭৫, ২০০৪। মনে রাখতে হবে পিতার প্রতি আমাদের ঋণ। সর্বদা স্মরণে রাখতে হবে ২১শে আগস্টের শহীদদের প্রতি ঋণ, ছোট্ট রাসেলের নিষ্পাপ হাসির স্মৃতির প্রতি দায়, বঙ্গবন্ধু কন্যার উপর ১৯ বার আক্রমণের সদাবিদ্যমান ঝুঁকির বাস্তবতা। আমাদের বার বার এই ঘটনাগুলো স্মরণ করতে হবে যেন আমাদের মনে থাকে যে আমাদের বিরোধীদের চক্রান্ত সর্বদা চলমান, নিষ্ঠুরতা তাদের সীমাহীন। আমরা এই অপশক্তিকে নির্মূল না করতে পারলে ওরা বার বার আঘাত হানবে। তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য, জাতির পিতার রক্তের প্রতি আনুগত্যের জন্য, বঙ্গবন্ধু কন্যার নিরাপত্তার জন্য চলুন আজ আমাদের ছোট-বড় সব আপোষের বেড়াজাল ভেঙ্গে ফেলি এবং ঘরের ভিতর ও বাইরের সকল শত্রুকে চিহ্নিত করে নির্মূল করি।
লেখক পরিচিতি-ডাঃ নুজহাত চৌধুরী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চক্ষু বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।