চাই তাঁর ত্যাগের মূল্যায়ন
প্রকাশিত : ২৩:৩৭, ১৬ মে ২০১৯ | আপডেট: ২৩:৩৯, ১৬ মে ২০১৯
১৯৮১ সালের ১৭ মে। বৃষ্টিস্নাত সেই দিনে বঙ্গবন্ধুর বড় কন্যা যখন ঢাকা বিমানবন্দরে পৌঁছালেন, দুচোখে তাঁর অঝোর ধারায় ঝরছে অশ্রুজল। তা দেখে কোটি জনতা তাঁর সাথে কাঁদলো, কাঁদলো যেন প্রকৃতিও। কিন্তু কেউ যেটা দেখলো না, বিমান যাত্রার শুরুতে যাত্রা পথের অন্য প্রান্তরে ছোট্ট একটি অবোধ শিশু কেঁদেছিল অঝোর ধারায় সেই যাত্রা পথের দিকে তাকিয়ে। তাদের মা যে চলে যাচ্ছেন দূরে, অন্য দেশে। সেই বাচ্চার বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে চলে আসতে যে কি কষ্ট হয়েছিল সে তরুণী মায়ের– আমরা কেউ কি কোনদিন তা চিন্তা করে দেখেছি?
এতো শুধু কিছুদিনের বিদেশ যাত্রা নয়। দেশকে ভালবেসে, দেশের জনতার ডাকে, পিতার অসমাপ্ত কাজ সম্পাদন করার গুরু দায়িত্ব নিয়ে সেই তরুণী মা বুকে পাথর বেঁধে, সন্তানকে দূরদেশে রেখে চলে যাচ্ছেন মাতৃভূমিতে। মাতৃভূমি শত্রুমুক্ত হলে হয়ত দেখা হবে, হয়ত সন্তানরাও আসবে মায়ের কাছে। কবে হবে কে জানে? কতদিনের সে অপেক্ষা কে জানে? আদৌ অপেক্ষার শেষ কখনও হবে কিনা তাও জানা নেই। কারণ, ওপারে অপেক্ষমাণ আততায়ী। সেই খুনীরা যারা হত্যা করেছে তাঁর পিতা, মাতা, ভাই, ভাবী, পরিবারের সকলকে। তারা ওঁত পেতে আছে তাকে হত্যা করার জন্য। বঙ্গবন্ধুর রক্তের ধারার এক বিন্দুও না রাখতে তারা বদ্ধ পরিকর। তাই, এই তরুণী মা আদৌ আর ফিরবেন কিনা তা অজানা। আর কি কখনও দেখা হবে ছেলের ঘুমন্ত মুখ? হয়তো এটাই শেষ দেখা। এই মায়ের বুকের ভিতরের হাহাকার আমরা কি কখনও শুনতে পেয়েছি? অথবা শুনতে চেয়েছি কেউ কোনদিনও?
কোটি মানুষের ভাগ্য বদলের জোয়াল কাঁধে নিয়ে সার্বক্ষণিক মৃত্যু পরোয়ানা মাথায় নিয়ে দেশে ফিরে আসলেন। ‘৮১-র সেই দিনে, ছেলেটিকে খালার কাছে রেখে, মেয়েটির হাত ধরে ফিরলেন স্বদেশে। তার আরও পরে, দুই সন্তানকেই হোস্টেলে দিয়ে দিতে বাধ্য হলেন। ফিরে এলেন সেই স্বদেশে যেখানে আছে শুধু স্বজনদের রক্তের দাগ, এক বুক হাহাকার। থাকার জায়গা নেই, জীবনের নিরাপত্তা নেই, নিজের বাবার বাড়ীতেও ঢোকার অনুমতি নেই। জাতির জনকের কন্যা, একজন প্রয়াত রাষ্ট্রপতির কন্যা স্বজনের জন্য প্রথম মিলাদ পরতে হল বাসার সামনে রাস্তায়।
যখন বত্রিশ নম্বরের সেই বাড়ীটিতে ঢোকার অনুমতি মিললো, তখন রচিত হল মানসিক নির্যাতনের আরেক অধ্যায়। দেয়ালে, মেঝেতে থোকা থোকা রক্তের দাগ, ছাদে মগজের ছিটা, বুলেটে বুলেটে ঝাঁঝরা প্রতিটি দেয়াল, আসবাব সব। সেই সিঁড়ি, যে সিঁড়িতে পরে ছিল পিতার লাশ, সেই সিঁড়ি তাঁর পবিত্র রক্তে রঞ্জিত। যে বাড়ীতে তিনি রেখে গিয়েছিলেন বিয়ে বাড়ীর কোলাহল – তা আজ মৃত্যুপুরী। সেই বিয়ের আল্পনার রঙ ঢেকে গিয়েছে রক্তের দাগে। নববধূর হাতের চুড়ির রিনিঝিনি নেই, নেই ছোট ভায়ের সাইকেলের টুংটাং। আজ শুধু গাঢ় অন্ধকার, মৃত্যুর নীরবতা।
আমরা কি সবাই জানি যে, সেই রক্তমাখা ঘরবাড়ী বঙ্গবন্ধুর আদরের বড় মেয়েটি নিজ হাতে ঝেড়ে ঝেড়ে পরিষ্কার করেছেন? চিন্তা করা যায়? বাবার রক্ত, মায়ের রক্ত, ভাইয়ের রক্ত, ছোট রাসেলের রক্ত – নিজ হাতে ধূলিকণার সাথে ঝেড়েছেন। কিন্তু প্রাণে ধরে ফেলতে পারেননি। ঘরের কোণায় কোণায় জমিয়ে রেখেছিলেন। কি মানসিক নির্যাতন – একটু কি হৃদয় দিয়ে ভেবে দেখবেন সকলে? কিভাবে সম্ভব এ মানসিক আঘাত সহ্য করা? আর ভেঙ্গে না গিয়ে, তারপরও এগিয়ে যাওয়া – কি পরিমাণ শক্তি লাগে, চিন্তা করা যায়?
কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যা যথার্থ বাপের বেটিই বটে। এগিয়ে চললেন, শুরু করলেন দল পুনর্গঠনের কাজ। জেলায় জেলায়, থানায় থানায়, ইউনিয়ন থেকে ইউনিয়নে গেছেন। আজ সবাই প্রধানমন্ত্রী দেখেন, প্রোটোকল দেখেন। অথচ সেদিনের অনুন্নত বাংলাদেশে পায়ে হেঁটে, রিকশায় চড়ে, নৌকায় চড়ে কত ভাবে যাত্রা করেছেন পথে পথে। যারা গাড়ীতে চড়ে চলেন আর বাসায় বসে টেলিভিশন দেখে বিচার করেন, তারা এই পরিশ্রমের স্বরূপ অনুধাবন করতে পারবেন না। হ্যাজাক জ্বালিয়ে সভা করেছেন। ভাবি, মানুষটার কথা। কোথায় খেয়েছেন, কোথায় বিশ্রাম নিয়েছেন – জানি না। কোন দিন তা জানবার প্রয়োজনও আমরা কেউ বোধ করিনি।
আমরা সবাই দেখেছি তাঁর ফিরে আসা। সে ফিরে আসায় পুনর্জন্ম লাভ করেছি আমরা নিজেরা। স্বাধীনতা বিরোধী, দেশ বিরোধী কুচক্রী আততায়ীরাই তখন দেশের মসনদে। তাদের নিষ্পেষণে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কোটি জনতার তখন মৃতপ্রায় অবস্থা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তখন ভূলুণ্ঠিত। তাঁর ফিরে আশায় জীবন্মৃত সেই মানুষগুলো জেগে উঠলো, নিভু নিভু সেই আদর্শের মশাল আবার জ্বলে উঠলো। এক প্রবাদপ্রতিম বাবার বিশাল পদচিহ্নের পাশে পাশে তাকে হাঁটতে হল। আমাদের বাঁচার তাগিদে নিষপলক তাকিয়ে থেকেছি সেই পথের পানে। উনিশ থেকে বিশ হলে, পান থেকে এতটুকু চুন খসলে রেহাই দেই নি কেউ তাকে। একবার ভাবিনি, কত বড় মহামানবের মত হতে তাকে বলছি এক দিনেই। একবার ভাবিনি, দুই দশকের জঞ্জাল তিনি একাই পরিষ্কার করছেন, এত সহজেই কি তা হয়ে যাবে?
এই কঠিন কাজে কেউ কি তাঁকে খুব একটা সাহায্য করেছি? সাহায্য তো নয়ই, বরং সমালোচনার ঝড়, প্রতিপদে বাধা, শত্রুতা, বিশ্বাসঘাতকতা তাঁকে বিদ্ধ করেছে সারাজীবন। ঘরে-বাইরে বিরোধীতার ঝড়ে বিপর্যস্ত করে তুলেছি তাঁকে, তাঁর হৃদয়ের ঝড় বোঝার সুকোমল অনুভুতি অনুভবের মত সময় তখন কোথায় আমাদের? আমরা তখন ডুবন্ত জাতি, তাঁকে আঁকড়ে ধরেছি বাঁচার জন্য, তাঁর শ্বাসের খবর রাখার উপায় ছিল না। মায়ের ভালবাসায় তিনি আমাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন নিশ্চয়। কিন্তু আমরা কি তাঁর কষ্টের, ত্যাগের মূল্যায়ন আজও করেছি? সেই ত্যাগের পরিমান পরিমাপ করার মত ভালবাসা দিয়ে, আজও কি তাঁকে আমরা মূল্যায়ন করেছি?
আজ শুধু আমরা কেন, দেশের জন্য তাঁর অর্জনের প্রশংসা করে, স্বীকার করতে বাধ্য হয়। দেশের জন্য তাঁর অর্জন শত-কোটি। এ উন্নয়নের প্রতীক্ষ্যদর্শী সারা বিশ্ব। বিনা যুদ্ধে তিনি ভুমি আদায় করে এবং সমুদ্র বিজয় করে দেশের মানচিত্র বদল করেছেন, মহাকাশে আমরা রেখেছি দৃপ্ত পদচিহ্ন। শুধু ২০৪১ নয়, তিনি আগামী একশত বছরের উন্নয়নের রূপরেখা তৈরি করে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের একটি উন্নত জীবন পাবার সংকল্প করেছেন। তিনি আমাদের বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে মুক্তি দিয়েছেন। আমাদের ললাট থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যার কলঙ্ক মুছে দেবার প্রয়াসে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের হত্যার বিচার করেছেন। করছেন ‘৭১-এ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এ দেশের মানুষের বিরুদ্ধে সংগঠিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার। এসবই দেশ ও বিদেশে প্রশংসিত, এসবই দৃশ্যমান।
কিন্তু এই বিশাল অর্জনের পিছনে যে কঠিন পরিশ্রম রয়েছে তা কি দৃশ্যমান? এই অর্জনের পিছনে যে মেধা, দূরদৃষ্টি রয়েছে তা কি এত সহজে চোখে পরে? তাঁর চেয়েও বড় কথা, প্রতিপলে শত বিরোধিতা, হত্যা চেষ্টার মাঝেও এই জাতির জন্য সার্বক্ষণিক যে শুভ কামনা তাঁর মাঝে আছে, যে গভীর ভালবাসা দিয়ে তিনি এ জাতির উন্নয়নের স্বপ্ন দেখে কাজ করছেন – সেই ভালবাসা, সেই শুভকামনার গভীরতা কি আমরা অনুধাবন করি? বঙ্গবন্ধু কন্যা এই দীর্ঘ পথ পেরিয়ে, ত্যাগ দিয়ে, পরিশ্রম দিয়ে, ক্ষুরধার মেধা দিয়ে, ইস্পাত-কঠিন সাহস দিয়ে, সন্তানের জন্য মায়ের বুকের সবটুকু ভালবাসা দিয়ে - আজ আমাদের পুরো জাতির মাতৃস্থানে নিজেকে আসীন করতে পেরেছেন। কিন্তু সেই মায়ের ভালবাসার গভীরতা আজও আমরা কি অনুধাবন করতে পেরেছি? জাতি হিসেবে তাঁকে কি বিনিময়ে ততটা ভালবাসা আমরা দিতে পেরেছি?
সবচেয়ে আড়ালে রয়ে যায়, ব্যক্তি মানুষটির কষ্ট ও আত্মত্যাগ। তাঁর দেহের পরিশ্রম, মানসিক চাপ আর হৃদয়ের রক্তক্ষরণ। আমি আজ তাঁর এই পরিণত বয়সে সকল সাফল্যে ঘেরা ইস্পাত কঠিন প্রধানমন্ত্রীর আড়ালে সেই শীর্ণ দেহের তরুণী মাকে শ্রদ্ধা জানাতে চাই। আমার সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখার কালে আমি সেই মায়ের সেই অবোধ শিশু দুটির কান্নার কষ্টকে মর্যাদা দিতে চাই। আমি আজ এই পরিবারের প্রতিটি মানুষের ত্যাগের মূল্যায়ন দেখতে চাই। যদি কৃতজ্ঞ জাতি হই, বাংলাদেশের জন্য বঙ্গবন্ধু বড় মেয়েটির সারাজীবনের ত্যাগের গভীরতা অনুধাবন করতে হবে। সকল অর্জনের পাশাপাশি জননেত্রী শেখ হাসিনার ত্যাগেরও মূল্যায়ন হওয়া আজ একান্ত প্রয়োজন। তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের এই ঐতিহাসিক দিনে অন্তত এটুকু যেন আমরা করতে পারি সেই কামনা করি।
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।