চাকরিজীবী মা ও আমার শৈশব
প্রকাশিত : ১৮:৪৪, ১৩ মে ২০১৮
`মা` শব্দটা পৃথিবীর সবচেয়ে আপন শব্দ একজন সন্তানের কাছে। মাকে নিয়ে ঘিরে থাকে সন্তানদের অনেক গল্প, অনেক স্মৃতি। শৈশব যেন মা ছাড়া চলেই না। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্নতা ছিল। হ্যাঁ, আমি একজন চাকরিজীবী মায়ের সন্তান। আমার শৈশব মায়ের স্মৃতিতে কিছুটা অস্পষ্ট বই কি !!
এখনও মনে আছে, ছোট বেলায় আমরা ৫ বন্ধু একসঙ্গে স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম। আমার বাকি ৪ বন্ধুর মা স্কুলে নিয়ে যেত তাদেরকে। আমার বন্ধুদের স্কুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটা রিক্সা ঠিক করা হয়েছিল। মাঝে মধ্যে আমারও জায়গা হয়ে যেত সেই রিক্সায়। না হয়, বেশীর ভাগ সময় আমি, আমার ভাইয়ার সঙ্গে রিক্সার পিছনে হেঁটে হেঁটে, দৌঁড়ে দৌঁড়ে স্কুলে যেতাম। বুঝতাম, আমার মা চাকরিজীবী, রিক্সা ঠিক করার সময় পান না।
বেশি খারাপ লাগতো পরীক্ষার সময়। তখন কেজি, ওয়ান, টু তে পড়ি। প্রথম পরীক্ষার দিন আম্মু সঙ্গে করে স্কুলে নিয়ে যেতেন। হলে নির্ধারিত সীটে বসিয়ে দিয়ে একটু আদর করে আম্মু বলতন, ‘ভালো করে পরীক্ষা দিও মা। আম্মু রাতে এসে প্রশ্ন দেখবো। আম্মুর অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। আম্মু এখন যাই?’
চুপচাপ ছোট্ট মেয়েটি, শুধু মাথা নিচু করে হ্যাঁ বলতাম। আম্মু স্কুলের পেছনের ফটক দিয়ে চলে যেতেন। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম। আমার মা যখন অফিসের উদ্দেশে হেঁটে চলেছেন চরম ব্যস্ততায়, তখন আমার বন্ধুদের মা একবার পেন্সিল বক্স ঠিক করে দিচ্ছে, একবার পানি খাওয়াচ্ছে, একবার বই খুলে কী কী যেন পড়াচ্ছে। কত আয়োজন!!
অংকন পরীক্ষার দিন আমার বন্ধুদের মায়েরা জানালা দিয়ে দেখতো আর বলতো, ‘কীভাবে এঁকেছ দেখি। এটা এই রঙ করো, ওইটা ওই রঙ করো।’ আমি শুধু একবার আন্টিদের দিকে ,একবার আমার বন্ধুদের দিকে তাকাতাম। অথচ তখন আমার মা হয়তো ব্যস্ত থাকতেন অন্যের চেকের লিখা ঠিক আছে কিনা, টাকা ঠিক মত গোনা হয়েছে কি না এসব নিয়ে।
টিভি, সিনেমায় দেখেছি, বাস্তবে বন্ধুদের মাকে দেখেছি, স্কুল থেকে ফেরার পর তাদের আম্মু খাইয়ে দিতেন, জামা কাপড় গুছিয়ে দিতন। আমার স্মৃতিতে মায়ের সঙ্গে তেমন কোন দৃশ্য নেই। শুনেছি আমি যখন খুব ছোট ৫/৬ মাস। একটু একটু বসতে শিখেছি তখন বাসায় কাজের মেয়ে না থাকায় আমাকে গ্রামে নানু বাড়িতে রেখে আসা হয়েছিল। মাঝে মধ্যে আব্বু-আম্মু গিয়ে দেখে আসতেন।
একবার আব্বু গিয়ে নাকি দেখেন আমি মাটিতে বসে আছি। আর মাটি থেকে ময়লা নাকি কী যেন কুড়িয়ে কুড়িয়ে মুখে দিচ্ছি। ওই বয়সের স্মৃতি মনে থাকার কথা না। আমারও মনে নেই। কিন্তু ভাবতে পারেন, যেই বয়সে সন্তানেরা মায়ের দুধ খায়, মা–বাবার কোলে কোলে থাকে আমি মাটিতে বসে বসে মাটি খাচ্ছি।
তারপর আবার আমার বয়স যখন ১৩-১৪ মাস, তখন আমাকে আমার বড় জেঠির কাছে রেখে আসা হয়েছিল। উনারাই গল্প করতন, আমি নাকি কিচ্ছু খেতাম না। মুরগির সঙ্গে খেতাম। মজার না বিষয়টা!! চাকরিজীবী মায়ের সন্তান আমি, আমাকে আর আমার মাকে ওই বাস্তবতাই মেনে নিতে হয়েছিল।
বুদ্ধি হবার পর থেকে প্রায়-ই অসুস্থ থাকতাম। আম্মুকে অভিমান করে বলতাম, আমাকে অন্যদের কাছে ফেলে রেখেছিলা। উনারা যত্ন নেয় নাই। তাই আমি অসুস্থ থাকি। উনারা শুনলে বলতেন, তোর মা চাকরিজীবী। তোর মায়ের থেকে বেশি যত্ন আমরা নিয়েছি। কিন্তু মা-তো মা-ই হয়।
চাকরিজীবী মায়েদের সন্তানেরা নাকি তাড়াতাড়ি `ম্যাচিউর` হয়ে যায়। ছোটবেলা থেকে এই `ম্যাচিউর` শব্দটাকে আমি অনেক ভয় পেতাম। আমার কাছে ম্যাচিউরিটি মানে হচ্ছে মায়ের সান্নিধ্য কম পেয়েই ধীরে ধীরে বড় হওয়া। তাই আমি আজো `ম্যাচিউর` হতে চাই না।
আমার মতো প্রতিটি চাকরিজীবী মায়েদের সন্তানদের গল্প কিছুটা একই ধরনের। আমরা মাকে খুব কাছে পেয়েও দূরে দূরে থেকেই বড় হয়ে যাই। তাই তো, আমার বন্ধুরা যখন বাসার গল্প বলত বেশিরভাগ সময়জুড়ে থাকতেন তাদের আম্মু। আর আমাদের গল্প থাকতো কাজের মেয়ে অথবা অন্য কিছু নিয়ে।
কথায় আছে, মা–মেয়ের উচ্চতা এক হয়ে গেলে মা-মেয়ে বন্ধু হয়ে যায়। আমার বেলায়ও এর ব্যতিক্রম হয় নি। এখন আমি আর আমার মা সবচেয়ে ভালো বন্ধু। এখনও আমার মা চাকরিজীবী, আমিও চাকরিজীবী। এখনও সমান ব্যস্ততায় ব্যস্ত হয়ে সংসার করে যাচ্ছেন। এখনও কোনো কারণে আম্মু বাসায় থাকলে মনে হয় আজ শুক্রবার।
বড় হতে হতে আম্মুর যতটা কাছাকাছি এসেছি ততই বুঝতে পেরেছি, আমরা আম্মুকে যতটা না মিস করেছি, আম্মু তার চেয়ে অনেক বেশি মিস করেছে আমাদের ছোটবেলাকে। আম্মুর কাছে থেকেও উনার সান্নিধ্য না পাওয়ায় যতটা অভিমান আমাদের ভেতর আছে, তার চেয়ে অনেক বেশি অভিমান আম্মুর নিজের প্রতি আছে ছেলে-মেয়েকে সান্নিধ্য দিতে না পারার কারণে।
আর সেজন্যই আম্মু ছোটবেলা থেকে আমাদেরকে কোনোদিন কিছুর জন্য না করতেন না। যখন যেটা চেয়েছি দিয়েছে। যখন যেটা করতে চেয়েছি, সেটাই করতে দিয়েছেন। এটাই মায়ের ভালোবাসা। কোনো দিক দিয়ে একটু কমতি পড়লে, আরেক দিক দিয়ে পুষিয়ে দিতেন। তাই তো মায়ের প্রতি ভালোবাসাটাও অন্য রকম থাকে।
আজ বিশ্ব `মা দিবস`। সব চাকরিজীবী ও গৃহিণী মায়েরদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। ভালো থাকুক পৃথিবীর সব মা। আল্লাহ প্রতিটি সন্তানের ভাগ্যে মাকে দীর্ঘজীবী করুক এই কামনা। আর ভালোবাসা সেই সব সন্তাদের প্রতিও যারা বাস্তবতার খাতিরে মায়ের কাছে থেকেও মায়ের সান্নিধ্য কম পেয়ে ধীরে ধীরে বড় হয়ে যায়। অথচ কোনো অভিযোগ রাখে না।
/ এআর /
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।