ঢাকা, সোমবার   ০৩ মার্চ ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

চাবিকাঠি : বিশ্বাস

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১২:৫১, ১১ এপ্রিল ২০২১ | আপডেট: ১০:২৫, ৩ জুলাই ২০২১

Ekushey Television Ltd.

সন্দেহ নেই, মনের শক্তি অসীম। তবে এ শক্তিকে কাজে লাগাতে হলে প্রথমত প্রয়োজন এ শক্তির ওপর বিশ্বাস, অর্থাৎ আত্মবিশ্বাস। ‘আমি পারি, আমি পারব’ এ বিশ্বাস যে সাফল্যের জন্যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ যুগে যুগে নিজের শক্তির ওপর বিশ্বাসই ইতিহাস সৃষ্টি করেছে, ইতিহাসকে পাল্টে দিয়েছে। বিজ্ঞানীরা বলেন, আমি পারব, এই দৃঢ় বিশ্বাসই সকল সাফল্যের ভিত্তি। তারা মনে করেন, ‘পারব বলে বিশ্বাস করলে আপনি অবশ্যই পারবেন।’ এ ধারণা যে কত বাস্তব ভিত্তিক তা প্রমাণের জন্যে দুয়েকটি উদাহরণই যথেষ্ট।

হাজার বছর ধরে দৌড়বিদরা চার মিনিটে এক মাইল দৌড়ানোর প্রচেষ্টা চালিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, এটা অসম্ভব। দৈহিক গঠনের কারণেই তা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। মানুষের হাড়ের কাঠামো ও ফুসফুসের গঠন দুটোই এ সাফল্যের পথে অন্তরায় বলে বিশেষজ্ঞরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। দুহাজার বছর পার হয়ে গেল এভাবেই। তারপরই এল এক শুভদিন। একজন মানুষ প্রমাণ করলেন যে, বিশেষজ্ঞদের এ ধারণা ভুল। তারপর ঘটল আরো অলৌকিক ঘটনা। রজার ব্যানিস্টার প্রথম চার মিনিটে এক মাইল দৌড়ের রেকর্ড স্থাপন করার ছয় সপ্তাহের মধ্যেই জন ল্যান্ডি পুরো দুই সেকেন্ডের ব্যবধানে ব্যানিস্টারের রেকর্ড ভঙ্গ করে নতুন রেকর্ড স্থাপন করেন। আর তারপর এ পর্যন্ত হাজারেরও বেশি দৌড়বিদ চার মিনিটের রেকর্ড ভঙ্গ করেছেন। যখন অসম্ভব মনে করা হতো, তখন কেউই পারেন নি। আর একবার করা সম্ভব বিশ্বাস করার পর রেকর্ড ভাঙার হিড়িক পড়ে যায়।

শুধু দৌড় বা কোনো প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রেই নয়, জীবনের যে-কোনো ক্ষেত্রে 'বিশ্বাস' শব্দটি মনের এমন এক শক্তির প্রতীক, যার কোনো যৌক্তিক সীমানা নেই। যেখানে সফলতা সেখানেই নিহিত রয়েছে গভীর বিশ্বাস। বিজ্ঞানী টমাস এডিসন বিশ্বাস করতেন যে, তিনি একটি সঠিক বৈদ্যুতিক বাতি তৈরি করতে পারবেন। এই বিশ্বাসই তাকে গবেষণার ক্ষেত্রে দশ হাজার বার ব্যর্থতার পরও এগিয়ে নিয়ে গেছে। তিনি সক্ষম হয়েছিলেন সঠিক ধাতু প্রয়োগ করে যথার্থ বৈদ্যুতিক বাতি নির্মাণ করতে। বিমান আবিষ্কারক রাইট ভ্রাতৃদ্বয়, বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুসহ অসংখ্য বিজ্ঞানীর সাফল্য তাদের আত্মবিশ্বাস ও অধ্যবসায়ের ফলেই অর্জিত হয়েছে।

নোবেল পুরস্কার বিজয়ী আইরিশ নাট্যকার জর্জ বার্নার্ড শ' মাত্র পাঁচ বছর স্কুলে লেখাপড়া করেছেন। দারিদ্র্যের কারণে মাত্র ১৫ বছর বয়সে মাসে আমাদের টাকায় ৪০ টাকা বেতনে কেরানির কাজ নেন। কিন্তু তিনি লেখক হতে চেয়েছিলেন এবং বিশ্বাস করতেন একদিন তিনি একজন বড় লেখক হবেন। তাই তিনি প্রতিদিন নিয়মিত লেখা শুরু করেন। লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে তার নয় বছর লেগেছিল। লেখক জীবনের প্রথম নয় বছরে তার লেখা থেকে আয় হয়েছিল আমাদের টাকার হিসেবে মাত্র ৩০০ টাকা। কিন্তু তার বিশ্বাসই তাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। লেখক হিসেবেই পরবর্তী সময়ে উপার্জন করেছেন লাখ লাখ টাকা।

জাতীয় কবি নজরুলের সাফল্যও তার মনের প্রচণ্ড শক্তির বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছু নয়। এত দরিদ্র পরিবারে তার জন্ম হয়েছিল যে, ছেলেবেলায় পড়াশোনার পাট চুকিয়ে জীবনধারণের জন্যে রুটির দোকানে কাজ করতে হতো। পরে কিছু পড়াশোনার সুযোগ পেলেও এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিতে পারেন নি। চলে গেলেন যুদ্ধে। সেখান থেকে ফিরে কলকাতায় এসে পুরোদমে লেখা শুরু করলেন কবিতা। বেরুলো অগ্নিবীণা ও বিষের বাঁশি। রবীন্দ্র প্রতিভা তখন মধ্য গগনে। আর কলকাতার শিল্প-সাহিত্য সংবাদপত্র তখন উচ্চবর্ণের দখলে। কোনো বৈরী পরিবেশই নজরুলের আবির্ভাব ও প্রতিষ্ঠা আটকে রাখতে পারে নি।

শুধু কি সাহিত্য? যারা বিত্তবান হয়েছেন তাদের ক’জন সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন? এক এক করে আমাদের দেশের বিত্তবানদের দিকে তাকালে দেখব তাদের অধিকাংশই এসেছেন সাধারণ অবস্থা থেকে। মনের শক্তির ওপরে বিশ্বাস ও সেই শক্তির উদ্ভাবনী প্রয়োগই তাদের সফল করেছে। 

এ প্রসঙ্গে ভারতেশ্বরী হোমসের প্রতিষ্ঠাতা আর পি সাহার নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। নিতান্ত দীনহীন অবস্থা থেকে তিনি ধনকুবেরে পরিণত হয়েছিলেন। আর অতি উন্নতমানের সিরামিকস সামগ্রী উৎপাদনের জন্যে আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত মুন্নু সিরামিকসের প্রতিষ্ঠাতা হারুনুর রশীদ খান মুন্নু মাত্র ৭৫ টাকা নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। ধৈর্য, অধ্যবসায় ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা প্রয়োগ করে তিনিও পরিণত হয়েছেন ধনকুবেরে। বর্তমানে তার অ্যাসেটের পরিমাণ শত কোটি টাকা। তাছাড়া অভিজাত আবাসিক এলাকায় যারা এখন বাস করছেন খোঁজ নিয়ে দেখুন তাদের ৯০%-ই প্রথম প্রজন্মের বাসিন্দা।

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও যারা ধনকুবের হিসেবে পরিচিত তাদের শতকরা ৯০ জনই খুবই সাধারণ অবস্থা থেকে এসেছেন। মার্কিন ধনকুবের এন্ড্রু কার্নেগির কথা ধরুন। তিনি তার সময়ের সবচেয়ে বড় ধনকুবের ছিলেন। তিনি ছিলেন বস্তির ছেলে। ১২ বছর যখন তার বয়স তখন তার পোশাক এত মলিন ও নোংরা ছিল যে, দারোয়ান তাকে পাবলিক পার্কে প্রবেশ করতে দেয় নি। তখন তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, যেদিন তার টাকা হবে সেদিন তিনি এই পার্কটি কিনে ফেলবেন। ৩০ বছর পর তিনি তার প্রতিজ্ঞা পূরণ করেছিলেন। তিনি সেই পার্কটি কিনেছিলেন। পার্কে নতুন একটি সাইনবোর্ড লাগিয়েছিলেন। তাতে লেখা ছিল, 'আজ থেকে দিনে বা রাতে যে-কোনো সময়ে যে-কোনো মানুষ যে-কোনো পোশাকে এই পার্কে প্রবেশ করতে পারবে।' মৃত্যুর আগে তিনি তার সকল সম্পদ জনহিতকর কাজে দান করে যান।

দক্ষিণ কোরিয়ার এখনকার সবচেয়ে বড় ধনকুবের হুন্দাই কর্পোরেশনের প্রতিষ্ঠাতা চুং জু জুং কৃষি শ্রমিক ছিলেন। অন্যের জমিতে দিনমজুরের কাজ করতেন। দীর্ঘ শ্রম, অধ্যবসায় ও উদ্ভাবনী ক্ষমতার প্রয়োগ করে তিনি পরিণত হয়েছেন দক্ষিণ কোরিয়ার সবচেয়ে বড় ধনকুবেরে। দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতি নির্মাণে এই দিনমজুরের ভূমিকা যে কত ব্যাপক তা বোঝা যায় একটি ঘটনা থেকে। ১৯৯৫ সালে চুং জু জুং কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। প্রতিদ্বন্দ্বিতাকালে তিনি কোম্পানির ৫০ মিলিয়ন ডলার অপব্যয় করে ফেলেন। চুং জুং-এর বিরুদ্ধে মামলা হয়। মামলায় বিচারক তাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড প্রদান করেন। পরে দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতি নির্মাণে তার অবদানের প্রতি জাতির কৃতজ্ঞতাস্বরূপ বিচারক এই কারাদণ্ড মওকুফ করে দেন।

বিশ্বাসের অসীম ক্ষমতা সম্পর্কে কোনো সন্দেহ থাকলে জোয়ান অব আর্কের জীবন এ সন্দেহ দূর করার জন্যে যথেষ্ট। জোয়ান অব আর্ক ছিলেন এক দরিদ্র মেষপালক পরিবারের কন্যা। বারো বছর বয়স পর্যন্ত তার মধ্যে অসাধারণ কোনোকিছুই দেখা যায় নি। এ সময় হঠাৎ তার মনে হলো ইংল্যান্ডের সাথে শতবর্ষের যুদ্ধে ফ্রান্সের বিজয়ের জন্যে সেনাপতিত্ব করার জন্যে তিনি স্রষ্টার দ্বারা মনোনীত হয়েছেন। এই বিশ্বাস তাকে ভূতে পাওয়ার মতোই পেয়ে বসল। ১৭ বছর বয়সে তিনি শুধুমাত্র বিশ্বাসের বলে বলীয়ান হয়ে হতবল ফরাসিদের সঙ্ঘবদ্ধ করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে দুঃসাহসিক আক্রমণ পরিচালনা করেন এবং অত্যন্ত সুরক্ষিত অরলিন্স দুর্গ জয় করেন। জোয়ান অব আর্ক যেমন গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন, আমরা যদি সেভাবে সাফল্য লাভে আমাদের যোগ্যতা সম্পর্কে বিশ্বাস করতে পারি, তাহলে আমরা যা করতে চাই না কেন তাতেই সফল হবো । কোনোকিছুই আমাদের থামাতে পারবে না, যেমন দুর্গের ৩০ ফুট উঁচু দেয়াল থামাতে পারে নি জোয়ান অব আর্ককে।

শুধু সাফল্য নয়, দেহের ওপরও বিশ্বাসের শক্তি অপরিসীম। বিশ্বাস আপাতদৃষ্টিতে দুরারোগ্য ব্যাধিকেও নিরাময় করে দিতে পারে। হেলেন কেলার বিশ্বাস করতেন যে, তিনি কথা বলতে শিখতে পারবেন। যদিও তার দৃষ্টি, শ্রবণ ও বাকশক্তি বিনষ্ট হয়েছিল। তার বিশ্বাস ও প্রচেষ্টাই তার বাকশক্তি পুনরুদ্ধার করে। তিনি কথা বলতে শেখেন। কলেজ থেকে ডিগ্রি লাভ করেন। লেখক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। সফল বক্তা হিসেবে সারা দুনিয়ায় ঘুরে বেড়ান। শ্রবণ ও দৃষ্টিক্ষমতাহীনতা তার সাফল্যের পথে অন্তরায় হয় নি। দৈহিক ত্রুটির কারণে যারা হতাশ হয়ে পড়েন, তাদের সামনে হেলেন কেলার আজও প্রেরণার আলোকবর্তিকা। 

শুধু হেলেন কেলার কেন অসংখ্য মানুষ একমাত্র বিশ্বাসের বলে দৈহিক ত্রুটি থেকে মুক্ত হয়ে স্বাভাবিক সাফল্যের অধিকারী হয়েছেন। বিশিষ্ট ব্যালে নর্তকী আলেকজান্দ্রা আট বছর বয়সে মারাত্মক পোলিওতে আক্রান্ত হয়ে প্রাণে বেঁচে গেলেও পঙ্গু হয়ে যান। ডাক্তাররা বলে দিয়েছিলেন, এ মেয়ে কোনোদিন হাঁটা-বসা তো দূরের কথা ঘাড় সোজা করতে পারবে না। কিন্তু তার বাবা বিশ্বাস করতেন যে, মেয়ে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবে। বাবা মেয়ের মনে সে বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন বলেই যে মেয়ে ঘাড় তুলতে পারত না, সে মেয়েই ক্রমাগত ব্যায়াম ও চর্চার মাধ্যমে ব্যালে নাচে খ্যাতি লাভ করেন।

বিখ্যাত লেখক ও মনস্তাত্ত্বিক নেপোলিয়ন হিল মনের বলের আরো চমৎকার উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। তার ছেলে জন্মগ্রহণ করে কানের পর্দা ছাড়া। ছেলে ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় ডাক্তাররা তাকে জানায়, সারাজীবন সে বধির থাকবে। হিল লিখেছেন, আমি বিশ্বাস করতাম তার শোনার একটা বিকল্প ব্যবস্থা সৃষ্টি করার জন্যে প্রকৃতিকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা আমার রয়েছে। আমি তার অবচেতন মনের মাধ্যমে কাজ শুরু করি। ক্রমাগত চেষ্টার ফলে স্বাভাবিক শ্রবণক্ষমতার ৬৫ ভাগই পুনরুদ্ধারে সক্ষম হই। অবচেতন মন ইন্দ্রিয়ের অভাবও পূরণ করতে পারে বিকল্প মাধ্যমে। 

মনের শক্তি দিয়ে মানুষ যে রোগ ও দৈহিক পঙ্গুত্বকেও উপহাস করতে পারে তার প্রমাণ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং। লিখতে পারেন না, কথা বলতে পারেন না, দুরারোগ্য মোটর নিউরোন ব্যাধিতে ক্রমান্বয়ে নিঃশেষ হওয়ার পথে এগিয়ে যেতে যেতেও তিনি বিশেষভাবে তৈরি কম্পিউটারের সহযোগিতায় রচনা করেছেন বর্তমান যুগের বিজ্ঞান জগতের সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী গ্রন্থ 'এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম'। হুইল চেয়ার থেকে তুলে যাকে বিছানায় নিতে হয়, তিনি অবলীলায় মহাবিশ্ব পরিভ্রমণ করে উপহার দিয়েছেন বিশ্ব সৃষ্টির নতুন তত্ত্ব। আইনস্টাইনের পর তাকেই মনে করা হচ্ছে বিশ্বের প্রধান বিজ্ঞানী।

শুধু পঙ্গুত্ব নয়, শুধু রোগ থেকে মুক্তি নয়, মনের শক্তি ও বিশ্বাস মানুষকে ক্লিনিক্যালি ডেড বা মৃত অবস্থা থেকেও জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারে। এজন্যে প্রয়োজন শুধু নিজের ওপর বিশ্বাস। এর জ্বলন্ত প্রমাণ বাংলাদেশে ফলিত মনোবিজ্ঞানের পথিকৃৎ এবং আত্মউন্নয়নে ধ্যানপদ্ধতি প্রয়োগের প্রবর্তক প্রফেসর এম ইউ আহমেদ। তিনি 'ক্লিনিক্যালি মৃত্যুবরণ' করার পরও পুনরায় জীবন লাভ করেছিলেন ১৯৭৩ সালের ২৬ মার্চ ৬৪ বছর বয়সে। তিনি আগের দিন ১০৫ ডিগ্রি জ্বরে আক্রান্ত হন। সারারাত অচেতন থাকার পর ডাক্তারের পরামর্শে শেষ রাতে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়।

সকাল আটটায় জ্ঞান ফিরে আসার পর হাসপাতালে নিজেকে দেখে তার মনে পড়ল দুদিন আগে এ ওয়ার্ডেই তার বড় শ্যালক মারা গেছেন। আর মৃত্যুর আগে তার খুব শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। হঠাৎ তিনি নিজের নাড়ি পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখলেন কোনো সাড়া নেই। তার বড় মেয়ে মেরীও তাই দেখল। এর পরবর্তী ঘটনা প্রফেসর এম ইউ আহমেদের ভাষাতেই শুনুন- 

'একটু পরেই ডাক্তার সাহেব এলেন এবং ঠিক তখন ভীত অবস্থায় আমার শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। সাথে সাথে আমার শরীরটাও যেন ক্রমেই নিস্তেজ হয়ে যেতে লাগল। হঠাৎ মনে হলো এটাই আমার মৃত্যুর সময়। আমি তাই কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে তখন মৃত্যু কামনা করলাম।

আর আমিও যেন ক্রমান্বয়ে মৃত্যুর প্রশান্তিপূর্ণ আবরণে সমাহিত হতে থাকলাম। আমি চিৎকার করছিলাম যে, আমার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। তাই ডাক্তার সাহেব ডান নাকে অক্সিজেন সিলিন্ডারের পাইপ ঢুকিয়ে দিলেন। কিন্তু তাতেও কষ্ট হচ্ছিল। তাই আমি ঠিক সেই মুহূর্তে মৃত্যু কামনা করলাম। সাথে সাথে আমার মাথাটা একটু উঁচু হয়ে তৎক্ষণাৎ বালিশের ওপর পড়ে গেল। এ সময় আমার গায়ের গেঞ্জিটা যেন ডাক্তার ব্লেড দিয়ে কেটে ছাড়িয়ে আনছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম। প্রত্যেকের কথাবার্তাও শুনতে পাচ্ছিলাম, যদিও শারীরিকভাবে মৃত্যু হতে থাকায় নিজে সাড়া দিতে পারছিলাম না।

এ সময় প্রথমে আমার হার্টবিট, পরে শ্বাস-প্রশ্বাস এবং এরপরে রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে যায়। শরীর হয়ে ওঠে বরফের মতো ঠান্ডা। ডাক্তার সাহেব আমার পায়ের নিচের দিকের রিফ্লেক্স অ্যাকশন পরীক্ষা করে কিছুটা সাড়া পাওয়ায় আমাকে ক্লিনিক্যালি মৃত জেনেও চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। 

তখন আমার অটোনোমিক নার্ভাস সিস্টেম এবং কেন্দ্রীয় নার্ভাস সিস্টেম নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। নিজেকে মরণের কোলে এলিয়ে দিয়েছিলাম বলে খুবই আনন্দ লাগছিল, শ্বাসকষ্টও হচ্ছিল না। এ পর্যায়ে আমি ক্লিনিক্যালি মৃত হলেও জৈবিকভাবে জীবিতই ছিলাম। তাই দেহ মরে গেলেও স্মৃতি, চিন্তা ও কোনো কোনো অনুভূতি সক্রিয় ছিল। তখন আমার চারপাশে নিকটজনেরা কান্নাকাটি করছে।

এমন অবস্থায় আমার মেয়ে মেরী হঠাৎ গুরুগম্ভীর ও মিনতিপূর্ণ কণ্ঠে নির্দেশ দিতে শুরু করে 'আব্বা তোমাকে বাঁচতেই হবে, বাঁচতেই হবে।' তখন আমি আশ্চর্য শান্তির মধ্য দিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। এ সময় মেরীর মিনতিপূর্ণ গুরুগম্ভীর নির্দেশ আমাকে স্থবির করে ফেলল। ভাবতে লাগলাম, কেন বাঁচতে হবে? এবং একসময় দৈহিক অবস্থায় মৃত থেকেই জোরেশোরেই প্রশ্নটা করলাম, 'কেন আমাকে বাঁচতে হবে?'

এ ঘটনায় ডাক্তাররা আশ্চর্য হয়ে গেল। মেরীর নির্দেশ তখনো চলছে অবিশ্রান্ত। আমি তাই চিন্তা করতে বাধ্য হলাম যে কেন আমাকে বাঁচতে হবে। আমার অন্তরাত্মা বেঁচে থাকার জন্যে যেন একটা গ্রহণযোগ্য সূত্র আবিষ্কার করতে চাইল। আমি ভেবে দেখলাম যে, পরিবারের লোকদের জন্যে আমার আর কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু হঠাৎ মনে পড়ল অসহায় মানসিক রোগীদের কথা। আমি ছাড়া এদেশে নির্ভরযোগ্য মনোচিকিৎসক নেই। এছাড়া আরেকটা দায়িত্বের কথা মনে পড়ল। ভেবে দেখলাম মানসিক রোগীদের স্বার্থে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রস্তাবিত সাইকোলজিক্যাল ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার জন্যে আমার বেঁচে থাকা প্রয়োজন। হঠাৎ বেশ কিছুটা জোরেশোরেই বলে ফেললাম, 'আমাকে বাঁচতে হবে। ডাক্তার সাহেব আপনারা চেষ্টা করুন।' জানি না মৃত অবস্থায় কীভাবে কথাগুলো বললাম। ডাক্তাররা এটা শুনে দ্বিগুণ উৎসাহে আমাকে বাঁচিয়ে তোলার জন্যে সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করতে লাগলেন। সাথে সাথে আমি সেই অভ্যস্ত অটোসাজেশন প্রয়োগ করতে লাগলাম-

Live long, Happy strong
'ডাক্তার সাহেব এবং আমার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আস্তে আস্তে আমার অটোনোমিক নার্ভাস সিস্টেম সক্রিয় হলো। অল্পক্ষণের মধ্যেই আমার হার্টবিট, শ্বাস-প্রশ্বাস, হৃদপিণ্ডের স্পন্দন ও রক্ত সঞ্চালন শুরু হলো। প্রায় ছ’ঘণ্টা মৃত অবস্থায় থাকার পর দুপুর দুটোয় আমি পুনরায় জীবন লাভ করলাম।'

প্রফেসর এম ইউ আহমেদের এই পুনরায় জীবন লাভের ঘটনার বিবরণ রয়েছে তার ‘যৌন রোগ চিকিৎসায় মেডিস্টিক সাইকোথেরাপি’ এবং ‘লার্ন টু হিপনোটাইজ এন্ড কিউর’ গ্রন্থে। এরপর তিনি আরো প্রায় ১৬ বছর বেঁচে ছিলেন।

আপনি যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক হলে এদের মতো আপনাকেও মন-শক্তিতে বিশ্বাসী হতে হবে। এদের মতো আপনারও সম্ভাবনা অনন্ত। আপনিও এদের মতো অমূল্য সম্পদের মালিক। কিন্তু সে সম্পর্কে আপনি পুরো সচেতন নন। আর আপনার এই অমূল্য সম্পদ হচ্ছে আপনার ব্রেন-আপনার মস্তিষ্ক। 

নিউরোসায়েন্টিস্টরা বলেন, মানব মস্তিষ্ক সর্বাধুনিক কম্পিউটারের চেয়েও কমপক্ষে দশ লক্ষ গুণ বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন। তাই দামের হিসেব করলে একটি কম্পিউটারের দাম যদি ৫০ হাজার টাকা হয় তাহলে আপনার ব্রেনের দাম দাঁড়াচ্ছে কমপক্ষে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। 

আপনি সবসময় কমপক্ষে পাঁচ হাজার কোটি টাকা মূল্যের সম্পদ আপনারই ঘাড়ের ওপর বয়ে বেড়াচ্ছেন। এরপরও যদি আপনি গরিব থাকেন তাহলে আপনার দারিদ্র্যের কারণ অভাব নয়, আপনার স্বভাব। কারণ, আপনি ব্রেনের মাত্র চার থেকে পাঁচ শতাংশ ক্ষমতা ব্যবহার করছেন। আর প্রতিভাবানরা–সফল ব্যক্তিরা এই ব্রেনের ক্ষমতার ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ব্যবহার করছেন। আপনিও যদি ব্রেনের এই ক্ষমতাকে এদের মতো ব্যবহার করতে পারেন তাহলে নিঃসন্দেহে সফল ও খ্যাতিমান হতে পারবেন।

(লেখাটি কোয়ান্টাম মেথডের প্রবক্তা মহাজাতক এর মেডিটেশন বই থেকে সংগৃহীত)


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি