চাল চুরি: শুধুই কি জনপ্রতিনিধিরা দায়ী?
প্রকাশিত : ১৩:০৮, ১৪ মে ২০২০
সম্প্রতি চাল চুরি নিয়ে দেশব্যাপী কিছু সংবাদে আমরা বিষন্ন হচ্ছি। বিরুপ প্রভাব পড়ছে জনগণের মনে আবার জনগণ এই ভেবে আশান্বিত যে সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে প্রত্যেকটি ঘটনার। এই চাল চুরির জন্য অনেকেই জনপ্রতিনিধিদের দোষারোপ করছেন।
একটা সামাজিক আন্দোলনের মতো মুখে মুখে ভাসছে, কতিপয় চেয়ারম্যান-মেম্বার চালচোর, গমচোর। কেউ কেউ জনগণের মাঝে বলাবলি করছেন, ত্রাণের চাল মেরে খাচ্ছেন জনপ্রতিনিধিরা। আসলে বাস্তবতা কি, নাকি রয়েছে আরো কিছু কার্যকারণ।
অনুসন্ধানে বেড়িয়ে এসেছে তালিকা, চালের কার্ড আর মাষ্টার রোলের নামে রয়েছে সমন্বয়হীনতা। যা হযবরল অবস্থা। ডিলারের আয়ের চেয়ে ব্যায় বেশি। অভাব রয়েছে তদারকি কর্মকর্তার। এ অবস্থায় নায্য প্রাপ্তদের অভিযোগ আছেই। আর এর দায় সরাসরি গিয়ে পড়ছে জনপ্রতিনিধিদের উপরে।
তবে আশার বিষয় এ অবস্থায় বুধবার (১৩ মে) খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার ১০ টাকায় ৩০ কেজি চালের তালিকা যাচাই বাছাই করে নতুন করে প্রকৃত গরিব ও দুস্থদের নাম অন্তরভুক্ত করে নতুন তালিকা তৈরী করার নির্দেশ দিয়েছেন।
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল- কমলগঞ্জ এলাকায় চাল চুরির একাধিক ঘটনা আমাদের সামনে উঠে এসেছে। এরমধ্যে ৩টি ঘটনায় চালসহ আটক হয়েছেন অভিযুক্তরা। একটি ঘটনায় দুইজন ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, শ্রীমঙ্গল ৫নং কালাপুর ইউনিয়নে প্রধানমন্ত্রীর খাদ্যবান্ধব কর্মসূচীর ১০ টাকা কেজির চাল দুইজন সাধারণ মানুষের (যারা ১০ টাকার তালিকায় অর্ন্তভুক্তি নন) কাছে পাওয়ায় দুইজনকে ৯০ কেজি চালসহ আটক করে শ্রীমঙ্গল থানা পুলিশ। দ্বিতীয় ঘটনা একই কর্মসূচীর ৩৮৫ বস্তা চাল এক মুদি দোকানির বাড়ি থেকে উদ্ধার করে শ্রীমঙ্গল ক্যাম্পের র্যাব- ৯ সদস্যরা। উদ্ধার করা হয় চালের বস্তাও।
তৃতীয় ঘটনা কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুরের ইসলামপুরে চালের ডিলার ও তার ছেলে আটক হয়েছেন একই অভিযোগে। সর্বশেষ ঘটনা শ্রীমঙ্গল কালাপুর ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের সদস্য ও ১,২ ও ৩ নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত মহিলা আসনের সদস্যকে একই কর্মসূচীর চাল চুরি ও অনিয়মের দায়ে সাময়িক বরখাস্ত করে ১০ দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়।
বিষয়গুলো নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও নেটিজেনদের মাঝে ঝড় উঠে। শ্রীমঙ্গল উপজেলা খাদ্য অধিদপ্তর কার্যালয় থেকে জানা যায়, সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচীর আওতায় শ্রীমঙ্গল উপজেলায় ৬ হাজার ৪৯৬ জনকে বছরে ৫ বার ৩০ কেজি করে চাল দেয়া হয়। এই প্রক্রিয়ায় প্রত্যেক ইউনিয়ন পর্যায়ে একটি কমিটি ও উপজেলা পর্যায়ে একটি কমিটির সম্পৃক্ততা রয়েছে।
ইউনিয়ন কমিটি তালিকা প্রলয়ন করবে। উপজেলা কমিটি বরাদ্দ অনুযায়ী কার্ড দিবে। এক্ষেত্রে ভোটার আইডি কার্ডের ফটো কপি ও ছবি সংগ্রহ করে দিবে ইউপি সদস্য ও মহিলা সদস্যরা। কিছু নাম দেন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানও। কার্ড হওয়ার পর কিছু উপকারভোগীকে প্রথমদিকে উপজেলায় আনুষ্ঠানিকভাবে ছবি দেখে বিতরণ করেন খাদ্য অধিদপ্তর। বাকিকার্ডগুলো ইউনিয়ন থেকে বিতরণ করা হয়। এই কার্ড দেখে চাল বিতরণের জন্য নিয়োগ করা হয় ডিলার।
শ্রীমঙ্গল উপজেলার ৯টি ইউনিয়নে মোট ২০ জন ডিলার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তাদেরকে ওয়ার্ড ভাগ করে দেয়া হয়েছে। সেই ওয়ার্ড অনুযায়ী চাল প্রাপ্তদের তালিকার একটি মাস্টার কপি চলে যায় প্রত্যেক ডিলারের কাছে। ডিলাররা ছবি দেখে মাষ্টাররোলে স্বাক্ষর বা টিপ সই নিয়ে নির্দিষ্ট দিনে কেজি প্রতি ১০ টাকা করে নিয়ে চাল বিতরণ করবেন।
আর এটি তদারকির জন্য থাকেন খাদ্য অধিদপ্তর থেকে মনোনিত উপজেলা প্রশাসনের একজন অফিসার। এখানে ইউপি সদস্যের ভূমিকা তালিকা প্রদান পর্যন্ত আইনানুগভাবেই শেষ হয়ে যায়। আর ইউনিয়ন পরিষদের গাফিলতি হতে পারে তিনি তাদের পছন্দের লোকজনের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্তি প্রদান করা নিয়ে। কিন্তু চাল চুরিতে আইনিভাবে তাদের হস্তক্ষেপ থাকে না।
এর দায় ডিলার ও ডিলারকে যারা নিয়ন্ত্রন করেন তাদের। দুইজন ইউপি সদস্য বরখাস্ত হওয়ার পর সরেজমিনে কালাপুর ইউনিয়নের ১,২ও ৩ নং ওয়ার্ডে গেলে এবং অনেকের সাথে যাদের অভিযোগের ভিত্তিতে তাদের শোকজ করা হয় তাদের সাথে কথা বলে যে বিষয়টি উঠে আসে তা হলো ডিলারের ছলছাতুরী। অধিকতর সরল ও দূর্বল প্রকৃতির মানুষরা হন তাদের লোভ লালসা ও প্রতারণা শিকার।
এমনই একজন শ্রীমঙ্গল কালাপুর গ্রামের রঞ্জিত দেব। তিনি একজন সরল প্রকৃতির মানুষ। খুব কষ্ট করে তাদের জীবন চলে। প্রায় সাড়ে ৩ বছর আগে স্থানীয় ইউপি সদস্য মুজিবুর রহমানের মাধ্যমে তিনি খাদ্যবান্ধব কার্ড পান। ডিলার আনোয়ার মিয়ার কাছ থেকে প্রথম কিস্তির চালও তিনি নেন। দ্বিতীয় মাসে চাল আনতে গেলে ডিলার তার কার্ড রেখে তার নাম বাতিল হয়ে গেছে বলে জানায়। তারাও সরল মনে তা বিশ্বাস করেন।
এ ব্যাপারে কথা হয় রঞ্জিত দেবের স্ত্রীর সাথে। তিনি জানান, প্রথমবার চাল দিয়ে ২য় বারের সময় ডিলার তাদের কার্ড রেখে দেয়। আর চাল পাননি। তবে বিষয়টি কাউকে জানাতে হবে তা তারা বুঝতে পারেননি। স্থানীয় ইউপি সদস্যকেও তারা জানাননি। এ সময় তিনি তাদের কার্ড ও তাদের নায্য চাল ফিরে পেতে সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষন করেন।
এ ব্যাপারে কথা হয় ইউপি সদস্য মুজিবুর রহমানের সাথে তিনি জানান রঞ্জিত দেব খুবই গরীব মানুষ। তিনি ১০ টাকার চালে তাদের নাম তালিকাভুক্ত করে দিয়েছেন। তবে তাদের কার্ড রেখে দিয়েছেন ডিলার। বিষয়টি কোনভাবেই তার নজরে আসেনি। রঞ্জিত দেবও জানাননি। যদি জানতেন তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতেন। তবে তিনি জানান, এখন যেহেতু তিনি জেনেছেন তার কার্ড ও চাল ফিরে পেতে সহায়তা করবেন।
তবে শ্রীমঙ্গল খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা তকবির আহমদ জানান, চাল পাওয়ার মাষ্টার রোলে রঞ্জিত দেবের নাম নেই। কার্ডে তার নাম্বার ছিলো ২৩৪ কিন্তু মাষ্টার রোলে দেখা যায় ২০১৬ ইং তার নাম্বারের জায়গায় ২৩৪ এ আছে সায়রা বেগমের নাম। আবার ২০২০ সালে সায়রা বেগম ১৯১ নম্বরে চাল তুলছেন।
চালের তালিকায় নাম আছে কিন্তু চাল পাননি কালাপুর গ্রামের ছমিরুন নেছা। কথা হয় তার সাথে তিনি জানান, ২/৩ বছর আগে তাদের গ্রামের সাদেক মিয়া তার কাছ থেকে জন্ম নিবন্ধনের কপি ও দুই কপি ছবি নিয়েছে। কিন্তু তাদের কোন কার্ড দেয়নি। এর পর বহুবার তিনি সাদেক মিয়াকে বলেছেন কার্ডের জন্য আগামীতে হবে হবে বলে এড়িয়ে যায় তিনি। তবে ইউপি সদস্য মুজিবুর রহমানের সাথে তাদের যোগাযোগ কম বলে তারা কখনও কার্ডের জন্য তার কাছে যাননি বলে জানান।
তিনি জানান, রোজা শুরু হওয়ার আগের দিন তারা জানতে পেরেছেন তাদের নামে চালের কার্ড হয়েছে কিন্তু তাদের দেয়া হয়নি। এ সময় তিনি তার প্রাপ্য চাল ও কার্ড দেয়ার দাবি করেন সংশ্লিষ্টদের কাছে।
কথা হয় চাল প্রাপ্ত সমিরণ শীল নামে কালাপুরের আরেকজনের সাথে। তিনি জানান, মুজিবুর রহমানের মাধ্যমে তিনি কার্ড পেয়েছেন চাল আনতে তাকে কেউ বাঁধা দেয়নি। তবে মাঝেমধ্যে তিনি এলাকায় না থাকায় এবং সময় মতো টাকা যোগার না করতে পারায় চাল আনেননি।
বিষয়টি অনুসন্ধানে প্রতিয়মান হয় কিছু অসাধু ডিলার ছলচাতুরি করে তারা এক এক ওয়ার্ডের ১৫/২০টি কার্ড নিজেদের কাছে রেখে দেয় এবং নিজেরাই টিপসই দিয়ে তা আত্মসাৎ করেন। শুধু আত্মসাৎ নয় অনেক সময় টাকা যোগাড় করতে না পারায় এবং বাড়িতে না থাকায় কিছু ভোক্তা চাল নিতে আসেন না। কিংবা সময়ের পরে গেলে ডিলার তাদের চাল দেন না। কিন্তু এই চাল তারা খাদ্য অধিদপ্তরকে ফেরত দেয়ার নিয়ম থাকলেও তা ফেরত দেন না। নিজেরা টিপসই দিয়ে তা আত্মসাৎ করেন। এমনকি দেখা গেছে, বস্তা থেকে ১/২ কেজি চাল সরিয়ে রেখেও ত্রিশ কেজির দাম নিয়ে বিক্রি করছে কতিপয় অসাধু ডিলার।
অন্যদিকে চালের বিষয়টি কারা নিয়ন্ত্রণ করেন। এটি খাদ্য অধিদপ্তর থেকে সরাসরি চলে যায় ডিলারের কাছে। ডিলার কার্ড দেখে তা বিতরণ করেন। এখানে আইনত জনপ্রতিনিধির কোন দায়ই নেই। চাল বিতরণের মাস্টার রোলে স্বাক্ষরও দিতে হয়না কোন জনপ্রতিনিধিদের। এখানে সঠিক মর্মে ডিলার ও তদারকি কর্মকর্তার স্বাক্ষর দিতে হয়।
এ ব্যাপারে কথা হয় শ্রীমঙ্গল উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক তকবির আহমদ জানান, ‘দুর্নীতির দায়ে কালাপুর ইউনিয়নের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচীর ডিলার আনোয়ার হোসেনকে বাতিল করা হয়েছে। তবে তিনি জানান, পুরো উপজেলায় ৬ হাজার ৪শত ৯৬ জনকে চাল দেয় হয়। তারা মাত্র দুইজন কর্মকর্তা তাদের পক্ষে সবসময় সঠিকতা যাচাই করা কষ্টসাধ্য। এখানে আরো লোকবল প্রয়োজন। সঠিক তদারকির অভাবে অনেকে সুযোগ নিচ্ছে তা স্পষ্ট হয়ে উঠে আমাদের ব্যাপক অনুসন্ধানে।
এদিকে অনুসন্ধানে বেড়িয়ে আসে দুর্নীতির অবশ্যম্ভাবী কারণ। খাদ্যবান্ধব এ কর্মসূচীর জন্য প্রতি ডিলারকে কেজি প্রতি দেড় টাকা করে কমিশন দেয়া হয়। ডিলাররা সাড়ে ৮ টাকা করে জমা দেন এবং ১০ টাকা করে বিক্রি করেন। এক্ষেত্রে দেখা যায় উপজেলায় ৬ হাজার ৪শত ৯৬ জনের জন্য ৩০ কেজি করে ১ লাখ ৯৪ হাজার ৮শত ৮০ কেজি চাল বিক্রি করে ২০ জন ডিলার পান ২ লক্ষ ৯২ হাজার ৩শত ২০ টাকা। এতে প্রতি ডিলারের গড় আয় হয় ১৪ হাজার ৬শ টাকা।
এদিকে একজন ডিলারের খরচ হিসেব করলে দেখা যায়, শ্রীমঙ্গল খাদ্য গোদাম থেকে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নে ট্রাক ভাড়া গড়ে- ৩ হাজার টাকা, চাল রাখার জন্য গোদাম ভাড়া ৫ হাজার, চাল বিতরণে শ্রমিকের বেতন ৬ হাজার টাকা, মাল ট্রাকে উঠানো ও নামানো খরচ ১৫শ থেকে ২ হাজার টাকা, খাতা পত্রসহ আনুসাঙ্গিক ব্যায় মাসে আরো হাজার টাকা। এতে দেখা যায়, একজন ডিলারের গড়ে ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা খরচ হয়। এ অবস্থায় নয় ছয় এর যথেষ্ট সম্ভাবনা থেকেই যায়।
শ্রীমঙ্গলের একজন ডিলার অমলেন্দু চন্দ জানান, এটাতে তেমন লাভ নেই। নিজের ঘর থাকায় এবং তার বড় ভাই এ কাজে সহায়তা করায় তিনি কাজটি পরিচালনা করতে পারছেন।
অন্যদিকে, সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির এ খাতগুলোকে যুগোপযোগী করে নতুনভাবে পর্যালোচনার দাবি জানান সমাজের বিশিষ্ট লোকেরা।
ইতিমধ্যে বিভিন্ন অনলাইন আ্যকটিভিস্টরা সরব হয়েছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ন্যাশনাল ডাটাবেজের মাধ্যমে উপকারভোগীদের কাছে সরাসরি জিটুপি ভিত্তিতে মোবালই ব্যাংকিং বা কিউআর কোড কার্ড প্রদানের মাধ্যমে সরকারি সহায়তা পৌঁছানোর জন্য। যার অনেকটাই সরকার ইতিবাচকভাবে দেখে, ইতোমধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছে।
অনেকেই বলছেন, এই ভুলবুঝাবুঝি ও সমন্বয়হীনতা সরকারের ভাবমুর্তির জন্য শুভপ্রদ নয়। সাধারণ জনগণের সাথে প্রতারণাকারীর অন্য কোনও পরিচয়কে প্রাধান্য না দিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত, তবে ঢালাওভাবে জনপ্রতিনিধিদের একতরফাভাবে দোষারোপ করলে বাকিরা হাতছাড়া হবে এবং স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার প্রতি জনগণ আস্থাহীন হয়ে পড়বে।
এআই//