চাল বিক্রেতা থেকে সাফল্যের চূড়ায় হুন্দাই মালিক চুং
প্রকাশিত : ১৩:০৭, ২৭ নভেম্বর ২০২২
শিগগিরই বাংলাদেশে কার উৎপাদন শুরু করবে হুন্দাই মোটরস। গণমাধ্যমের সুবাদে সংবাদটি এখন হয়তো সকলেই জানি। কিন্তু, দক্ষিণ কোরিয়ার এই প্রসিদ্ধ কার উৎপাদক কীভাবে বিশ্বের সবচেয়ে সুপরিচিত অটোমোবাইল ব্র্যান্ডে পরিণত হলো সেই কাহিনী তুলে ধরতেই আজকের আয়োজন।
অনেক সময় বাস্তব জীবন হার মানায় রূপকথাকে। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। অনুপ্রেরণায় ভরা সেই ইতিহাস সবাইকেই উজ্জীবিত করার ক্ষমতা রাখে।
১৯৬৭ সালে হুন্দাই মোটর কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন উদ্যোক্তা চুং ইয়ু-ট্যাং। আজ কয়েক দশকের পথ-পরিক্রমায় দ. কোরিয়ার উলসানে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ইন্টিগ্রেটেড অটোমোবাইল উৎপাদক কারাখানা রয়েছে কোম্পানিটির।
কারখানার বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ১৬ লাখ ইউনিট। কর্মরত আছেন ৭৫ হাজার মানুষ। ২০১৯ সালে কোম্পানিটি আয় করে মোট ৯ হাজার কোটি ডলার!
শুধু গাড়ি নয়, অবকাঠামো নির্মাণ, ইলেকট্রনিক্স পণ্য এমনকি প্রতিরক্ষা সামগ্রীরও বড় উৎপাদক আজকের হুন্দাই ইন্ডাস্ট্রিজ।
চুং ইয়ু-ট্যাং (১৯১৫-২০০১) বর্তমান কালের উত্তর কোরিয়ার অন্তর্গত তংচোন অঞ্চলে একটি দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্মেছিলেন। বড় সন্তান হওয়ায় তিনি পারিবারিক খামারের দায়িত্ব একদিন নিজের কাঁধে তুলে নেবেন, এমনটাই আশা করতেন তার বাবা।
পারিবারিক গরুর খামারে কৈশোর জীবনটা কাটালেও পাশাপাশি প্রাথমিকের গণ্ডি পার হতে সক্ষম হন চুং। তবে নিজেদের আর্থিক দৈন্যদশা আর জীবনযাপনের মান নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাই সেই দারিদ্র্যপূর্ণ গ্রামীণ জীবন থেকে পালানোর ফন্দি কষতে থাকেন মনে মনে। ১৬ বছর বয়সেই প্রথম তংচোন থেকে পালানোর চেষ্টা করেন। চুং এবং তার এক বন্ধু সেই উদ্দেশ্যে নিজেদের কিছু মালামাল গুছিয়ে বাড়ি ছেড়ে রওনা দেন।
উপত্যকার দুর্গম ও বিপজ্জনক ১৫ কি.মি. পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে কাজের সন্ধানে উ. কোরিয়ার কোউন অঞ্চলে যান তারা। সেখানে একটি অবকাঠামো নির্মাণের কাজে দুই বন্ধু শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন।
এদিকে অনেক খোঁজাখুঁজি করে অবশেষে চুং-এর বাবা তার হদিশ পান এবং অবিলম্বে বাড়ি ফেরার আদেশ দেন। চুং অবশ্য তাতেও হাল ছাড়ার পাত্র ছিলেন না। প্রথমবার পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা সবাই একটু ভুলে যেতেই তিনি আরেকবার চেষ্টা করলেন। এবার গন্তব্য ঠিক হলো আজকের দিনের দ. কোরিয়ার রাজধানী সিউল।
পথের খরচা যোগাতে গোপনে বেঁচে দিলেন পারিবারিক খামারের গরুগুলো, সেই টাকায় কিনলেন সিউলে যাওয়ার ট্রেনের টিকিট। গোপন এই অভিযানটি প্রথমে সফল হলেও মাস দুয়েক পর আবার তার খোঁজ বের করলেন বাবা। এবারও তাকে ফিরতে হলো তংচোনে।
চুং-এর উচ্চাশা যত সহজে গুড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হবে বলে তার পরিবার ভেবেছিল, ব্যাপারটা ততো সহজ ছিল না। ১৮ বছর বয়সে তৃতীয়বার পালান তিনি। এবার রাতের অন্ধকারে ফের সিউলের পথে পা বাড়ান। সিউলে এসে টিকে থাকার জন্য যে কাজই পেতেন, সেটাই করতে লাগলেন।
এভাবে নানা ধরনের কাজ করতে করতে একবার পেলেন একটি চালের দোকানের ডেলিভ্যারি বয়ের চাকরি। নিজ যোগ্যতায় খুব শীঘ্রই নিজেকে দোকানের একজন দক্ষ কর্মীতে পরিণত করেন। তার কর্মতৎপরতায় মুগ্ধ হন দোকান মালিক। নিয়োগের ছয় মাসের মধ্যে তাই পদোন্নতি দিয়ে চুং'কে দিলেন হিসাবপত্র দেখাশোনার দায়িত্ব।
এসময় ব্যবস্থাপক হিসাবে চুং নিজগুণে অচিরেই গড়পড়তা এই চালের ব্যবসাকে দিনে দিনে আরও সমৃদ্ধ করে তোলেন। তাইতো মালিকের মৃত্যুর পর তিনিই পান দোকানের সত্ত্ব। এটাই ছিল তার প্রথম ব্যবসায় মালিক হয়ে ওঠার ঘটনা।
অবশ্য সেটাই ছিল তার অগ্রযাত্রার সূচনা মাত্র। পূর্বের নাম বদলে দোকানের নতুন নাম রাখেন কিউংগিল রাইস শপ এবং সেখান থেকে ভালো উপার্জন আসতে থাকে তার। তবে কোরিয় উপদ্বীপে জাপানি দখলদারিত্ব চলাকালে তার ব্যবসা উপনিবেশবাদী রাজনীতির কবলে পড়ে বন্ধ হয়ে যায়।
বাধ্য হয়ে আবারও গ্রামে ফিরে আসেন চুং। সেখানেই কৃষিকাজে কাটে কয়েকটি বছর। কিন্তু কৃষকের পেশা চিরতরে গ্রহণ করার ইচ্ছে তার ছিল না। আবার এক পরিকল্পনা করে চতুর্থবারের মতো গ্রাম থেকে পালালেন চুং। ফিরলেন সেই সিউলেই।
কিছুদিন ভাবনাচিন্তার পর খুললেন গাড়ি মেরামতের একটি গ্যারেজ। উদ্যোগটি সফলতা পায় এবং খুব শিগগিরই ২০ জন থেকে তার অধীনস্ত কর্মচারীর সংখ্যা ৭০ জনে উন্নীত হয়।
তবে, ১৯৪৩ সালে জাপানি দখলদার সরকার গ্যারেজটি দখল করে একটি ইস্পাত কারখানার অংশে রূপ দেয়। আরও একবার স্বপ্নহারা চুং ট্রেনে করে পাড়ি জমান গ্রামের দিকে।
হুন্দাই প্রতিষ্ঠা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯৪৬ সালে জাপানি দখলদারিত্ব থেকে স্বাধীনতা পায় কোরিয়া। যুদ্ধ-পরবর্তী কোরিয়ার পুনর্গঠনে নেওয়া হয় ব্যাপক উন্নয়ন কর্মসূচি। সেখানেই নতুন সম্ভাবনার আলো দেখলেন চুং। ফলে আবারও খামার ছেড়ে ফিরলেন সিউলে এবং হুন্দাই নামের একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করলেন। কোরিয়ায় পরমাণু চুল্লি এবং রেলওয়ে নির্মাণে একাধিক ঠিকাদারী কাজ পেল হুন্দাই।
এ কাজে তার সাহায্যে এসেছিলেন তার আপন ছোট ভাই। ইংরেজি ভাষায় নিজের দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি বড় ভাইয়ের প্রতিষ্ঠানকে মার্কিন সামরিক বাহিনীর কিছু কার্যাদেশ পাইয়ে দেন। এর ফলে আরও ফুলে ফেঁপে ওঠে চুং- এর প্রতিষ্ঠান। তারপর আর পিছনে ফিরৱতে হয়নি। হুন্দাই দিনে দিনে আকার নেয় দ. কোরিয়ার সবচেয়ে সফল আর সর্ববৃহৎ বাণিজ্যিক শিল্পগোষ্ঠীতে।
অঙ্গপ্রতিষ্ঠান কিয়া মোটরস- এর ৩২.৮ শতাংশ অংশীদারিত্ব, বিলাসবহুল গাড়ি উৎপাদনে নিয়োজিত জেনেসিস মোটর-এর শতভাগ মালিকানা এবং বৈদ্যুতিক শক্তিচালিত গাড়ি উৎপাদন উদ্যোগ ইওনিক নিয়ে গঠিত হুন্দাই মোটর গ্রুপ। কোরিয়ান ভাষায় 'হুন্দাই' শব্দের অর্থ 'আধুনিকতা' বা 'প্রগতি'। 'নিউ থিংকিং, নিউ পসিবিলিটিজ' বা 'নতুন চিন্তা, নতুন সম্ভাবনা' শীর্ষক ব্র্যান্ড স্লোগানের সঙ্গেও যা একেবারে সঙ্গতিপূর্ণ।
এনএস//